স্বাধীনতার 75 বছরে দাঁড়িয়ে আজ বড় মনে পড়ছে সেই মানুষটির কথা, যিনি সারাক্ষণ চিন্তা করতেন পরাধীন ভারত কী করে আত্মনির্ভর হবে। কারণ আত্মনির্ভরতাই প্রকৃত স্বাধীনতা এনে দেয়। তিনি স্বাধীন ভারত দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু রেখে গেছেন এমন কিছু ফর্মুলা , যা আজও প্রাসঙ্গিক। আজও তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করলে এক মনে প্রাণে স্বাধীন জাতির বিকাশ সম্ভব। এবং তা সত্যিই এতই স্বাধীন যে তার জন্য মিথ্যা প্রচারের কোনো আশ্রয় নিতে হয় না।
তিনি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ।
তাঁর "আত্মচরিত" এর মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন, "বাল্যকাল হইতেই আমি অর্থনৈতিক সমস্যার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছি এবং পরবর্তী জীবনে শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চার ন্যায় উহা আমার জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়া গিয়াছে। কেবল সমস্যার আলোচনা করিয়াই আমি ক্ষান্ত হই নাই, আংশিকভাবে কর্মক্ষেত্রে উহার সমাধান করিতে চেষ্টা পাইয়াছি।"
কি ছিল তাঁর এই ফর্মুলাতে ?
তিনি বলছেন পরীক্ষায় ভাল নম্বর, ফার্স্ট হওয়া ইত্যাদি মেধার পরিচয় - এই ভ্রান্ত ধারণা মেকলে ভারতবাসীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দুটো বই মুখস্থ করে ডিগ্রি লাভের মোহ ত্যাগ করতে হবে। এই ডিগ্রির মোহের জন্য বিশেষতঃ বাঙালি কায়িক পরিশ্রমের কাজকে নিচু চোখে দেখে, এবং ফলে অনেকেই বেকার থাকে। বাঙালির একমাত্র পছন্দের পেশা হল কলম পেষা, এবং এই পছন্দের জন্য সে পরমুখাপেক্ষী, সে অন্যের দাস। তার প্রভু তাকে কম পয়সায় যত পারে শোষণ করে আর সে কৃতার্থ চিত্তে সেই শোষণ বংশ পরম্পরায় চলতে দেয়। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। স্বাধীন ব্যবসা এই শোষণ থেকে মুক্তি এবং কর্ম সংস্থানের উপায় হতে পারে।
উদাহরণ তিনি নিজের জীবনেই একেবারে বাতেকলমে করে দেখিয়েছেন। একদম শূন্য থেকে বেঙ্গল কেমিক্যালের সৃষ্টি। রাজাবাজারের মাংসের দোকানে ফেলে দেওয়া গরুর হাড় থেকে ক্যালসিয়াম ফসফেটের ব্যবসা। এই গরুর হাড় নাম মাত্র মূল্যে বিদেশে রপ্তানি হত, এবং ওষুধে ব্যবহারের জন্য ক্যালসিয়াম ফসফেট হিসেবে আমদানি হত বহুমূল্যে। পুরো চ্যানেলটা শর্টকাট করে আত্মনির্ভরতা এনে দেখিয়ে দিলেন- দেশের ই কাঁচা মাল থেকে দেশজ পণ্য – অবং তা একেবারে বিশ্বমানের। শুধু তাই নয়, সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড ইত্যাদি রাসায়নিক পণ্য, যাদের দেশের ও বিশ্বের বাজারে প্রচুর চাহিদা আছে, তাদের উৎপাদনের পদ্ধতিকে আধুনিকীকরণ করে উৎপাদন ক্ষমতা বহুগুণ বাড়ালেন , সঙ্গে ব্যবসাও। এক এক করে বহু ওষুধের উৎপাদনও শুরু করলেন বেঙ্গল কেমিক্যালে। তিনি বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সময়ে কিছু রাসায়নিক উৎপাদনের কারখানা দেখে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে বেঙ্গল কেমিক্যালের কারখানা আধুনিকীকরণ করার জন্য আইডিয়া নিতে বিদেশ গিয়ে দেখলেন, সাধারণ রাসায়নিকের কারখানা যদি বা শিল্পপতিরা দেখাতে চায়, কোনো ওষুধের কারখানায় তাঁর মত বিজ্ঞানীর প্রবেশাধিকার নেই, কারণ সেখানে গোপন ফর্মুলা বা ট্রেড সিক্রেট ফাঁস হয়ে যেতে পারে। কাজেই, বেঙ্গল কেমিক্যাল এ প্রস্তুত সমস্ত ওষুধ উৎপাদন সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রেও তাঁদের সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর হতে হল। এতে অসুবিধে তেমন হয়নি কারণ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রর মত বিজ্ঞানী যেখানে কর্ণধার, গবেষণা সেখানে দুরূহ হতে পারে না।
ব্যবসা করার জন্যে তিনি স্বতন্ত্রভাবে কিছু বাঙালি যুবককে মূলধনের যোগানও দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা তাঁর মুখ রক্ষা তো করেই নি, তাঁকে ঋণের জালে জড়িয়েও ফেলেছিল। এই লজ্জা আমাদের জাতীয় লজ্জা।
তাঁর দ্বিতীয় ফর্মুলা ছিল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভারতকে শ্রেষ্ঠ আসনে উন্নীত করা। তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল যে ভারতীয়দের বুদ্ধিবৃত্তি যথেষ্ট - বিজ্ঞান চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ ভারতে তৈরি করতে পারলেই ভারত বিশ্বে বিজ্ঞানে উজ্জ্বল স্থান অধিকার করতে পারবে। তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং পরে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে জন্ম দিয়েছিল এক ঝাঁক তরুণ রসায়নবিদের , যাঁদের অত্যন্ত উন্নত মানের গবেষণা তখন সারা পৃথিবীতে আলোচিত হত। এঁদের মধ্যে কেউ বা কিছুটা উচ্চ শিক্ষা বিদেশে করে দেশে ফিরে এসেছেন, কেউ বা শুধু মাত্র ভারতেই শিক্ষা লাভ ও গবেষণা করেছেন। কিন্তু এঁদের গবেষণার মান কিন্তু সেই একই - যা বিশ্বের বড় বড় রসায়নবিদদের আলোচনার বিষয় বস্তু হয়। বিশ্ববিখ্যাত নেচার পত্রিকা নাম দিল ভারতে একটি রাসায়নিক গোষ্ঠী অর্থাৎ Indian School of Chemistry- র উদ্ভব হয়েছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের গুরুকুলে। এঁদের মধ্যে নীলরতন ধর, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রিয়দারঞ্জন রায়ের নাম তখন রসায়নবিদ মহলে মুখে মুখে ফিরত। বীরেশচন্দ্র গুহ, যিনি ভারতে প্রাণ-রসায়নচর্চার পথিকৃৎ এবং ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা, তিনিও প্রফুল্লচন্দ্রর ছাত্র। স্বাধীন ভারতের প্রথম যুগের প্রতিটি রসায়ন চর্চা কেন্দ্রের শীর্ষে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই আচার্য রায়ের ছাত্র। ব্যতিক্রম হয়েও ব্যতিক্রম নন শান্তি স্বরূপ ভাটনগর, যিনি কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ-এর (CSIR ) প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আচার্য রায়েরই শিষ্য স্বল্পায়ু অতুল্য ঘোষের ছাত্র - সেই হিসেবে তিনি নিজেকে আচার্য রায়ের প্রশিষ্য বলে দাবি করেছেন।
কাজেই প্রফুল্ল চন্দ্র স্বাধীন ভারত দেখে না যেতে পারলেও তিনি যে “মানস নেত্রে মহৎ জাতির নব অভ্যুদয়” দেখেছিলেন তা বাস্তবায়িত হয়েছিল।
তাঁর তৃতীয় ফর্মুলা ছিল, বাঙালি হিসেবে বাঙালির ক্ষয় ক্ষতি রোধ করা। তিনি অত্যন্ত যন্ত্রণা নিয়ে বাঙালির চরিত্রের সমালোচনা করেছেন- বাঙালি অলস, আত্মম্ভরী এবং স্বজাতির মধ্যে অসদ্ভাব, অসহযোগিতা ও কলহের কারণে আত্মঘাতী। পাশাপাশি তিনি দেখেছেন, বাংলা যেন অন্য সবার চোখে কামধেনু- তা সে ইংরেজ ই হোক বা ভারতের অন্য প্রদেশ জাত ব্যবসায়ীই বা কর্মী হোক- সবাই বাংলাকে শুষে নিয়ে নিজেদের ভিটেকে সমৃদ্ধ করছে, বাঙালি প্রতিবাদ তো করছেই না, বরং নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে তাদেরকে সহযোগিতা করছে। অথচ তিনি দেখেছিলেন পশ্চিমা পার্শি ইত্যাদি বণিকেরা মুনাফার জন্যে নানা ভাবে ইংরেজকে হস্তগত করে আইন এমন ভাবে নিজেদের স্বার্থে পরিবর্তিত করেছে, যাতে জাতির এবং বাঙালির আসলে ক্ষতিই হয়েছে। এদের অনেকেরই দেশপ্রেম ছিল ছদ্ম মুখোশ, যেখানে আবেগপ্রবণ বাঙালি সত্যিকারের দেশপ্রেমী হয়ে আত্মত্যাগ করতে দ্বিধা করেনি। তাঁর এই ফর্মুলাকে প্রাদেশিকতা কিছুতেই বলা চলে না, কারণ তিনি বাঙালির স্বার্থে অন্যদের ক্ষতি করার আহবান দেন নি, বলেছেন বাঙালিকে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে দোহন বন্ধ করতে। এই দোহন বন্ধ করলে ভারত জাতি হিসেবে নিজেই পূর্ণতা পাবে।
তিনি বলে গেছেন “বাঙালি তথা ভারতবাসী কেন পশ্চাৎপদ থাকিবে, তাহাদের জাতীয় জীবন কেন পূর্ণতা লাভ করিবে না, তাহার কোন কারণ আমি দেখিতে পাই না।”