কাগজে কলমে বিরোধী প্রার্থী অবশ্যই আছেন। বিজেপি বিরোধীদের সম্মিলিত প্রার্থী যশবন্ত সিনহা। কিন্তু সত্যি কতটা বিরোধী? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদ পওয়ার প্রমুখ ‘বিরোধী’ দিল্লিতে বৈঠক ইত্যাদি করে বেশ একটা বিরোধী বিরোধী ভাব দেখালেন বটে, কিন্তু প্রকৃত রাজনৈতিক বিরোধিতা কোথায়?
প্রথমত, তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা নেওয়ার সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার করলেও, যশবন্ত সিনহা কি সঙ্ঘ পরিবারের ভাবাদর্শের মৌলিক বিরোধী? অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় অর্থ এবং পররাষ্ট্রের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ দফতর সামলেছেন প্রাক্তন আইএএস যশবন্ত। মোদী জমানায় বিজেপি-তে সুবিধা করতে না পেরে এবং বিদেশে রাষ্ট্রদূতের কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়েই তাঁর বিজেপি বিরোধিতা, এমনই বলেন সমালোচকরা। কট্টর সঙ্ঘীদের মতো সংখ্যালঘু বিদ্বেষ হয়তো তাঁর মজ্জায় নেই, কিন্তু বিপরীত কোনও দৃঢ় রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য আছে, এমন প্রমাণও তো নেই। খাঁটি আমলার মতো বরং সুবিধা মতো যখন যেখানে তখন সেখানে যুক্ত হওয়ার মতো নমনীয়তা তাঁর সম্ভবত আছে। যে নমনীয়তা দ্রৌপদী মুর্মুর থেকেও নরেন্দ্র মোদী প্রত্যাশা করতে পারেন। বেশি বই কম নয়! অতএব, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যিনিই জিতুন তিনি হবেন নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি-র লোক! মোদী-শাহ জুটির সাফল্য এখানেই। যিনিই জিতুন, তাঁদের লোক! বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তাঁদের রাজনাতির বড় সাফল্য এটাই: নিজেরা খেলার নিয়মটা এভাবে ঘুরিয়ে দিতে পেরেছেন যে বিরোধীরা নাকে দড়ি দিয়ে সেই নিয়ম মেনে খাটান খাটতে বাধ্য হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার 75 বছর পূর্তির ক্ষণে একজন আদিবাসী মহিলাকে প্রার্থী করে বিজেপি যে রাজনৈতিক বার্তাটি দিচ্ছে, তাকে উপেক্ষা করতে পারে কোন মূর্খ? এর আগে একবারই মাত্র মহিলা রাষ্ট্রপতি পেয়েছে ভারত – পশ্চিম ভারতের উচ্চবর্ণ ক্ষমতাধর শ্রেণীর প্রতিনিধি, আইনজীবী থেকে ক্ষমতার রাজনীতিতে আসার চেনা পথের পথিক প্রতিভা পাটিল। রাষ্ট্রপতি পদটির যত দূর অবনমন তাঁর জমানায় হয়েছিল তার কোনও তুলনা আছে কিনা জানা নেই আমাদের। বিদেশের থেকে পাওয়া রাষ্ট্রপতির যাবতীয় উপহার যে রাষ্ট্রের সম্পত্তি, তাও স্মরণে ছিল না তাঁর। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার দ্বারা সেই কলঙ্ক অনেকটাই মুছে দিতে পেরেছিলেন। এবারের দ্রৌপদী মুর্মু মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, জনজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে কেউই অতীতে প্রার্থী পর্যন্ত হতে পারেনি, নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি তো দূরের কথা। ওড়িশা থেকেও কেউই কখনও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হননি। যশবন্ত সিনহার 84-এর তুলনায় দ্রৌপদীর বয়স মাত্র 65, অনেকটাই কম। সুতরাং দ্রৌপদী মুর্মুর মনোনয়ন যাকে বলে ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ শুধু নয়, ‘পলিটিক্যালি পারফেক্ট’ সিদ্ধান্ত!
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিরোধীদের ব্যর্থতার আরও একটা মাত্রা রয়েছে। দ্রৌপদী মুর্মু কিন্তু গতবারের রামনাথ কোবিন্দের মতো একেবারে ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি নন, এমন নয় যে তাঁর নাম কোনও চর্চার মধ্যেই ছিল না। বরং গত দুই সপ্তাহ ধরে তাঁর নাম নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে নিবিড় চর্চা চলছে। অর্থাৎ তিনি যে সম্ভাব্য প্রার্থী সেটা জেনেও বিরোধীরা কোনও পাল্টা উপযুক্ত রাজনৈতিক প্রার্থী দিতে পারল না। শরদ পওয়ার, ফারুখ আবদুল্লা, বা গতবারের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পরাজিত গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর বাইরে কারও নাম ভাবার সাহস পর্যন্ত হল না বিরোধী শিবিরের তথাকথিত সবথেকে ফায়ারব্র্যান্ড নেত্রীর! তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে কে বেশি গতানুগতিকতায় আবদ্ধ তার প্রতিযোগিতা ছাড়া কী হল এতে? সুতরাং, ক্রিয়া বিজেপি-র, প্রতিক্রিয়া অন্যদের – এই তত্ত্বও আরও মজবুত হল। উপরন্তু প্রতিক্রিয়াও সমান ও বিপরীত হল না!
অতএব মনোনয়ন দাখিলের আগেই জিতে গেলেন দ্রৌপদী মুর্মু।
#DraupadiMrmu #YashbantSinha #President_Election