4thPillar


সুন্দরের হীন অপমান সুন্দরবন জুড়ে

বিতান ঘোষ | 14-12-2021May 10, 2023
সুন্দরের হীন অপমান সুন্দরবন জুড়ে

যার সব ভেসে যায়, সে খড়কুটো নিয়ে বাঁচে। আর যার খড়কুটোটুকু'ও থাকে না? বহতা সময়ের সঙ্গে সে-ও ভেসে যায়। কিন্তু এ ভেসে যাওয়া কোনও ব্যক্তিবিশেষের নয়, মধুকর ডিঙা নিয়ে চাঁদবণিকের ডুবে যাওয়াও নয়। এ এক আস্ত জনপদের কালগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার আখ্যান। সেই গল্পই শোনাচ্ছিলেন মৌসুনি দ্বীপের (Mousuni Island) আলমগীর মিঞা, সুজন মণ্ডলেরা।

 

হতাশ দৃষ্টিতে সামনের অতল জলরাশির দিকে তাকিয়ে সুজন মণ্ডল বলছিলেন, ওইখানে তাঁর গোয়ালঘর ছিল, ওইখানটা ছিল তুলসিমঞ্চ। উদ্দাম জলরাশির কাছ থেকে পিছোতে পিছোতে প্রায় 700 মিটার দূরে সরে এসেছে সুজনের পরিবার। তবু দুর্যোগের দিনে বিনিদ্র রাত কাটে তাঁদের। শ্বাপদের মতো এগিয়ে আসতে চায় জলস্রোত। ওঁরা জানেন না পিছোতে পিছোতে কোথায় গিয়ে থিতু হবেন।

 

 আলমগির মিঞা সুন্দরবনের প্রবীণ মানুষ। বহু সুখদুঃখের ঘটনা চাক্ষুষ করেছেন নিজের ছানি পরা চোখ দু'টো দিয়ে। শহরের লোক ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন শুনে জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে বলছিলেন, “সব ফুরিয়ে যাওয়া নিয়েও বেঁচে আছি আমরা। এককালে জমি, বাড়ি সব ছিল, এখন প্রকৃতির দয়ায় বেঁচে থাকা।” বিহ্বলতা কাটিয়ে আলমগির বলে যান, “ছেলেপিলেরা বুঝে গেছে রিং বাঁধ জল রুখবে নে৷ তাই কাজকম্মোর জন্য সব ভিনরাজ্যে। আমরা যারা এই জায়গার মায়া কাটাতে পারিনি তারাই শুধু রয়ে গেলুম।”

 

 তবে কি সরকারি উদ্যোগ ও সাহায্যের কোনও সুফলই মেলে না, এই জলজঙ্গলের দেশে? সম্প্রতি স্থানীয় পঞ্চায়েতের উদ্যোগে মৌসুনি দ্বীপে রিসর্ট হয়েছে। ছুটির মরশুমে পর্যটকদেরও আনাগোনা লেগে থাকে সেখানে। রিসর্টগুলি বেসরকারি উদ্যোগে তৈরি হলেও স্থানীয় ছেলেপুলেরা পর্যটকদের টোটো-সওয়ারি হয়ে কিংবা চায়ের দোকান দিয়ে ভালমতোই ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতে পারছে। সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবাদে অতিরিক্ত কিছু সুযোগসুবিধাও মিলছে। কিন্তু দক্ষিণরায়ের দেশে ঘরের ছেলেরা ঘরে ফেরার সাহস দেখাচ্ছে না এখনও।

 

 সুজন বলছিলেন, সুন্দরবন অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা দেখেছে। কিন্তু ‘ইয়াস'-এর সময় যে প্রবল জলোচ্ছ্বাস বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রকৃতির রোষানলে তলিয়ে যাওয়াই এই দ্বীপভূমি এবং দ্বীপভূমির বাসিন্দাদের ভবিতব্য। সুজনদের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা ও পরিবেশবিদদের পূর্বানুমান প্রায় মিলে যায়, যখন সুন্দরবনের আয়ুষ্কাল আগামী দুই দশক— এমন আশঙ্কাবার্তা প্রায় সর্বত্রই শোনা যায়।

 

 জোয়ার-ভাটার জলের টানে যাদের ললাটলিখন হয়, তারা এই দ্বীপভূমিতে থাকল কি থাকল না, তা সরকারের তরফে জানার চেষ্টা হয় না। ক্রমশ শূন্য হয়, নিঃস্ব হয় সুন্দরবন।

 

প্রকৃতির ক্রমবর্ধমান খামখেয়ালিপনার শিকার যাঁরা, অর্থাৎ যাঁরা ক্লাইমেট রিফিউজি (Climate Refugees), তাঁদের নিয়ে কি বিদগ্ধমহলে কিংবা জনসাধারণের মধ্যে যথেষ্ট আলোচনা হয়? এই প্রশ্নই উঠে এল মহানির্বাণ ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের একটি আলোচনা সভায়। সেখানে জনৈক সাংবাদিক খানিক বিদ্রুপের সুরেই বললেন, “ভোটের আগে আমরা এত বড় সুন্দরবনের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে বা বোঝার ভান করে কী উপায়ে এমন প্রাজ্ঞের মতো কে জিতবে, কে হারবে বলে দিই, তা আমার বোধগম্য হয় না।” তাঁর সংশয়ী সংযোজন, নিজেদের দায় ব্যতীত কলকাতার প্রান্তে লেগে থাকা সুন্দরবনের খোঁজখবর কি আমরা আদৌ নিতে চাই?

 

 রাজনৈতিক অভিবাসন নিয়ে গাদাগুচ্ছের নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়, নাগরিক সভাসমিতি, রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল হয়। কিন্তু আমাদেরই কৃতকর্মে বদলে যাওয়া প্রকৃতির ছোবল থেকে একটা প্রান্তিক জনপদকে বাঁচাতে আমরা উদ্যোগী হই না। ভেবেও দেখি না, তটরেখা ভাঙলে অদূর ভবিষ্যতে ক্ষমতার সাতমহলাও সুরক্ষিত থাকবে না। তখন স্বখাত সলিলে ডুবে মরা ছাড়া করণীয় কিছু থাকবে না। সুন্দরবন আর সুন্দরবন ছেড়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলা মানুষ সেই মরণের ডঙ্কাই যেন বাজিয়ে দিয়ে যায়।


New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -বিতান ঘোষ | 14-12-2021

// Event for pushed the video