অল্ট নিউজের মহম্মদ জুবেরকে যেনতেন প্রকারে কারাবন্দী করে রাখতে বদ্ধপরিকর সরকার। সীতাপুর মামলায় পাঁচ দিনের জামিন পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লখিমপুর খেরির পুলিস 153A ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে নতুন একটি ওয়ারেন্ট জারি করেছে। আইপিসির 153A ধারা (বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করা) এখন মুড়িমুড়কির মতো যে কোনও ব্যক্তি, যাঁকে সরকার মনে করছে বিপজ্জনক, তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিকতম অভিযোগটি 2021 সালের মে মাসের যখন জুবের একটি টুইটে স্থানীয় একটি চ্যানেলের ভিডিও ভুয়ো প্রমাণ করেছিলেন। টুইট মে মাসের, এফআইআর করা হয়েছে সেপ্টেম্বরে যার কোনও কপি জুবেরকে দেওয়া হয়নি, কোনও নোটিশও জারি করা হয়নি। সুতরাং জুবেরকে এখন দিল্লি, সীতাপুর, লখিমপুর খেরি তিনটি মামলার জটে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাঁদের ঘৃণা-বক্তব্য তিনি প্রকাশ্যে এনেছিলেন কিংবা যাঁদের ভুয়ো খবর ফাঁস করেছিলেন তাঁরা বহাল তবিয়তে, অথচ জুবের কারাগারে!
সুপ্রিম কোর্ট সীতাপুর কেসে জুবেরকে জামিন দিলেও সেটির কপি স্থানীয় থানায় পৌঁছায়নি, অথচ জি নিউজের সঞ্চালক রোহিত রঞ্জনের আবেদনে সাড়া দিতে শীর্ষ আদালত কিন্তু বিন্দু মাত্র দেরি করেনি। অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে তাঁরা আদেশ জারি করেছেন যে কোনও রাজ্যের পুলিশ তাঁকে পয়লা জুলাই তিনি যে ভুয়ো ভিডিও প্রচার করেছিলেন সেটার জন্য গ্রেপ্তার করতে পারবে না। সেই ভিডিওটি কী ছিল? সেটি দেখে মনে হয় রাহুল গান্ধী উদয়পুরের খুনিদের ক্ষমা করার জন্য অনুরোধ করছেন। আসলে তিনি কিন্তু ওয়েনাড়ে তাঁর অফিস ভাঙচুর করা এসেফাই ছাত্রদের ক্ষমা করতে বলছিলেন। অনুষ্ঠানের পরের দিন রোহিত রঞ্জন ভুল স্বীকার করেছেন, অনেকটা ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’র মতো। মাঝের 24 ঘণ্টার মধ্যে ঐ ভিডিও ভাইরাল হয়ে বহু লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে, সেটার দায় কে নেবে? আদালত অবশ্য সেটা বিচার্য বিষয় মনে করেনি।
তার আগে ছত্তিসগড় পুলিশ যখন রোহিতকে তাঁর বাড়িতে গ্রেপ্তার করতে যায় তখন তো রীতিমতো নাটক হয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি কৃষক আন্দোলন সম্পর্কিত একটি টুলকিট গ্রেটা থুনবার্গের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য কী ক্ষিপ্রতার সাথে দিল্লি পুলিশ ব্যাঙ্গালোর থেকে কুড়ি বছরের তরুণী দিশা রবিকে তাঁর পরিবারের অজান্তে তুলে নিয়ে এসেছিল। প্রধানমন্ত্রীকে সমালোচনা করার জন্য আসাম পুলিশ সুদূর গুজরাট থেকে জিগ্নেশ মেওয়ানিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু রোহিতের ক্ষেত্রে ছত্তিশগড় পুলিশ তাঁর বাড়ির সামনে পৌঁছানো মাত্র নয়ডা পুলিশ সেখানে পৌঁছে যায় এবং দুপক্ষে প্রায় ধ্বস্তাধস্তি হয়। নয়ডা পুলিশ রোহিতকে একটি মামুলি ধারায় গ্রেপ্তার করে অন্য রাজ্যের পুলিশের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করে। পুলিশ, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থার পক্ষপাতদুষ্টতা আজ অত্যন্ত স্পষ্ট, প্রকট।
জুবেরের গ্রেপ্তার তো হাস্যকর! তিনি 2018 সালে একটি টুইট করেছিলেন যাতে 1983 সালের ছবি ‘কিসি সে না কহনা’র একটি পোস্টার নিয়ে মজা করা হয়েছে। জুবের নুপুর শর্মার ঘৃণা-মন্তব্য প্রকাশ্যে এনেছিলেন, চার বছর আগের একটা টুইটকে অজুহাত করে তাঁকে শিক্ষা দেওয়া হল। কিন্তু তাহলে 2017 সালে হরিয়ানার বিজেপি আইটি সেলের অরুণ যাদব যিনি একই ভাবে নুপুর শর্মার মতো ধর্মীয় আক্রমণ করেছিলেন, তাঁকে কেন গ্রেপ্তার করা হবে না। জুবের গ্রেপ্তার হওয়ার পরে অরুণ যাদবকে গ্রেপ্তারের দাবীতে 50 হাজার টুইট হয়। বিপদ বুঝে বিজেপি তড়িঘড়ি হরিয়ানার ঐ আইটি প্রধানকে সমস্ত দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়।
সম্প্রতি এনবিডিএসএ (নিউজ ব্রডকাস্টিং স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি) 2020 সালে জি নিউজ, জি হিন্দুস্তান, ইন্ডিয়া টিভি, এবং আজতক চ্যানেলকে উমর খালিদের বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল চালানোর জন্য তিরস্কার করেছে। যে অপপ্রচার এই চ্যানেলগুলি উমরের বিরুদ্ধে করেছিলো, তা চমকপ্রদ তো বটেই, আরও গুরুত্বপূর্ণ তা ছিল পুরোপুরি উদ্দেশ্যপূর্ণ। উমরকে খলনায়ক হিসাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, যেমনঃ ‘উমর খালিদ মাস্টারমাইন্ড অফ দিল্লি রায়টস’, ‘উমর খালিদ ইজ আ টেরোরিস্ট’ ইত্যাদি। এনবিডিএসএ চ্যানেলগুলিকে সাত দিনের মধ্যে এই সব ভিডিও মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তাতে কী হল? প্রথম কথা উমরের নাম তো দেশজুড়ে আতঙ্কবাদীর খাতায় উঠে গেল, এর দায় কে নেবে? দ্বিতীয়ত রোহিত রঞ্জন তো ভুল স্বীকার করে পার পেয়ে গেছেন, এই চ্যানেলগুলি কি প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করবে এবং তাতে কি উমর কারাবাস থেকে মুক্তি পাবেন? এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি উমর সম্পর্কে দিল্লি হাই কোর্টের মন্তব্য উল্লেখ করতে হয়। আদালত বলছে অমরাবতীতে দেওয়া উমরের বক্তব্য রুচিহীন হতে পারে কিন্তু তা জঙ্গি কার্যকলাপ নয়। প্রসঙ্গত উমরের ঐ বক্তব্য বিজেপি আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য বিকৃত করে একটি টুইট করেন যার ভিত্তিতে সরকারি উকিল বারবার উমরকে আদালতে জঙ্গি, দেশদ্রোহী হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। উমরের বক্তব্য যদি জঙ্গি কার্যকলাপ না হয়, তাঁর বিরুদ্ধে যদি মিডিয়া ইচ্ছাকৃত ভাবে লাগাতার অপপ্রচার করে থাকে, তাহলে কোন যুক্তিতে তাঁকে এখনো জেলে আটকে রাখা হবে, কোন যুক্তিতে তাঁর ওপর ইউএপিএর মতো একটা দানবীয় আইন প্রয়োগ করা হবে?
অথচ যতি নরসিংহানন্দ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় ভয়ঙ্কর সব কথা বলে বেড়াচ্ছেন। হরিদ্বারে একটি জনসভায় তিনি মুসলিমদের গণহত্যা করার ডাক দিয়েছিলেন। এর জন্য তিনি গ্রেপ্তার হোন কিন্তু মাসখানেক বাদে জামিন পেয়ে যান। জামিনের মূল শর্ত্ত ছিল তিনি কোনধরনের বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন। কিন্তু নরসিংহানন্দের মতো মানুষরা জানেন সরকার তাঁদের কেশাগ্রও স্পর্শ করবে না। তাই কোনও তোয়াক্কা না করে তারপরেও তিনি হিমাচল প্রদেশে এবং দিল্লিতে প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে পুনরায় গণহত্যার হুমকি দেন। বজরং মুনি বারবার কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে মুসলিম মহিলাদের গণধর্ষন করার হুমকি দিয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন, কিছু দিন বাদে জামিন পেয়ে গেছেন, আবার একই কাজ করেছেন। পুলিশ প্রশাসন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থেকেছে। এই দুজনকে জুবের ‘হেটমঙ্গার’ বলেছেন, ভুলটা কি বলেছেন? এটা আমাদের গণতন্ত্রের লজ্জা যে এডিশনাল সলিসিটার জেনারেল, এস ভি রাজু তথাকথিত এই ধর্মগুরুর হয়ে আদালতে সাফাই গেয়েছেন। তাঁর মতে বজরং মুনি সীতাপুরের একজন শ্রদ্ধেয় মহান্ত, প্রচুর মানুষ যাঁর অনুগামী, তাঁকে ঘৃণা-মন্তব্যকারী বলাটা নাকি সমস্যাজনক!
ঘৃণা-বিতরণকারীরা যখন বিনা বাধায় বিদ্বেষের বীজ বপন করে চলেছেন, তখন এলাহাবাদের গণ্যমান্য অধিকার কর্মী জাভেদ মহম্মদকে 11 জুন গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁকে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর পরিবার জাভেদের অবস্থান জানার জন্য সরকারের কাছে বারবার মিনতি করেন। সরকার নিশ্চুপ, যেন জাভেদের অস্তিত্ব সম্পর্কেই তাঁরা অবহিত নন। প্রায় দশ দিন বাদে তাঁরা মিডিয়া সূত্রে জানতে পারে তিনি দেওরিয়া জেলে বন্দি আছেন। 10 জুন শহরে নুপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্যকে কেন্দ্র করে গোলমাল হয়েছিল, জাভেদ কিন্তু সমাজমাধ্যমে মুসলিম জনতাকে শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ করতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁকেই গ্রেপ্তার করা হল, তাঁর স্ত্রীর বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল।
দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এখন কতটা ভীত, অসহায় তা জাভেদের কন্যা আফরিন ফতিমা, যিনি সিএএ-এনআরসি আন্দোলনের একজন পরিচিত মুখ ছিলেন, তাঁর মর্মান্তিক বর্ণনা থেকে জানা যায়: বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সন্ধ্যার জমাটি বিতর্ক সভাগুলিতে এখন আমাদের পরিবারের মুখ, আমরা ষড়যন্ত্রের কারবারি, আমরা ‘দেশ-বিরোধী’, ‘জিহাদি’। আমি হত্যা ও ধর্ষনের হুমকি পাই। যেহেতু আমার মুখ এখন সবার কাছে পরিচিত, তাই আমি বাইরে বেরোতে ভয় পাই। তিনি লিখছেন আমাকে গ্রেপ্তার করার কোনও প্রয়োজন নেই কারণ আমি এমনিতেই ঘরে সিঁটিয়ে আছি।
বুলডোজার রাজ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট কিছু মন্তব্য করেছে, বলেছে বেআইনি বাড়ি ভাঙতে হলে আগে নোটিশ দিতে হবে, আইন মেনে উচ্ছেদ অভিযান করতে হবে। ওই টুকুই! জাভেদ মহম্মদ যদি অপরাধীও হন তাঁর স্ত্রীর বাড়ি কেন ভাঙা হল? এর জন্য যাঁরা দায়ী তাঁদের কি কোনও সাজা হবে না? জাভেদের স্ত্রী পারভিন ফতিমা কি ক্ষতিপূরণ পাবেন না? আদালত মৌন!
সুপ্রিম কোর্ট নুপুর শর্মাকে কড়া ভাষায় তিরস্কার করেছে, বলেছে তাঁর জন্য সারা দেশজুড়ে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে, দেশবাসীর কাছে প্রকাশ্যে টিভিতে তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত। দিল্লি পুলিশ এতদিন কী করেছে, বিচারকরা জানতে চান। কেন এফআইআর সত্ত্বেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি?
সুপ্রিম কোর্ট গুলবার্গ সোশাইটি মামলাতেও পিটিশনকারীদের সম্পর্কে অনুরূপ ভাবে কড়া অবস্থান নিয়েছে। বিচারকদের মতে তিস্তা শেতলবাদ 16 বছর ধরে দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্যে তাওয়া গরম করে রেখেছেন এবং আদালত নজিরবিহীন ভাবে নির্দেশ দিচ্ছে যে যাঁরা এইভাবে আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। দুটি তিরস্কারের মধ্যে মস্ত একটা ফারাক আছে। প্রথম ক্ষেত্রে শীর্ষ আদালত মৌখিক ভাবে ভর্ৎসনা করেছেন, পর্যবেক্ষণ করেছে মাত্র, কোনও নির্দেশ নয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বিচারকরা লিখিত ভাবে তাঁদের রায়ে উল্লেখ করছেন যে, পিটিশনকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এই রায় হাতিয়ার করে এরপরে অমিত শাহের বিবৃতি তারপরেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিস্তা ও শ্রীকুমার গ্রেপ্তার।
বিচারব্যবস্থাও কি আজ আপোষকামী হয়ে পড়ছে? ‘মোদিস ইন্ডিয়া: হিন্দু ন্যাশানালিজম এন্ড দ্য রাইজ অফ ইথনিক ডেমোক্রেসি’ নামক সাড়াজাগানো বইটির লেখক ক্রিস্টোফার জাফ্রেলট বলছেন ভারতের বিচারব্যবস্থা শাসকের হাতিয়ার হয়ে গেছে। তিনি এর জন্য তিনটি কারণ উল্লেখ করছেন। প্রথমত বিচারব্যবস্থায় আরএসএস ব্যাপক ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। কলেজিয়াম সিস্টেম যেটার মাধ্যমে অতীতে বিচারকদের নিয়োগ করা হতো সেটা মোদী সরকার পালটে দিয়েছে। খাতায় কলমে কলেজিয়াম এখনো আছে কিন্তু বাস্তবে সরকার তাঁদের ঘনিষ্ঠ বিচারকদের নিয়োগ করে। দ্বিতীয়ত অনুগত বিচারকদের অবসরের পরে বিভিন্ন লাভজনক সংস্থায় নিয়োগ করে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। নামোল্লেখ করার প্রয়োজন নেই, কারণ তাঁরা খুবই পরিচিত। তৃতীয়ত প্রত্যেক বিচারকের ফাইল সরকারের কাছে আছে, তাঁদের ঠিকুজিকুষ্ঠী সরকারের জানা, একটু বেগড়বাই করলেই সেগুলো বার করে ব্ল্যাকমেইল করা হবে। চতুর্থ কারণটি সম্প্রতি বোঝা গেল যখন নুপুর শর্মাকে তিরস্কার করার জন্য জাস্টিস সূর্য কান্ত এবং জে বি পার্দিওয়ালাকে কুৎসিত ভাবে ট্রোল করা হল। গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভটিতেও এখন ভক্তদের রমরমা। পরিস্থিতি উত্তরোত্তর কঠিন হচ্ছে।
#altnews #mahammadjubeir #democracyinindia #savedemocracy