সম্প্রতি কোভিশিল্ড স্রষ্টা কোম্পানি কোর্টে স্বীকার করেছে যে এই ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে রক্ত জমাট বেঁধে ( যাকে Thrombosis with Thrombocytopenia Syndrome, সংক্ষেপে TTS বলা হচ্ছে) ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর ক্ষতির সম্ভাবনা আছে, এটা তারা অবগত ছিল। এই নিয়ে হুলুস্থুল, এবং নির্বাচন চলাকালীন গরম আবহাওয়া আরও গরম করে তুলেছে। কিন্তু সত্যিই এটা কোনও নতুন তথ্য ? সত্যিই কি আপনাকে চিন্তা করতে হবে, কোভিশিল্ড তো তখন নিয়ে ফেলেছিলাম , কিন্তু এখন কি হবে? আমার ও কি TTS হয়ে মারা পড়ার সম্ভাবনা আছে শিগগিরই।
যদি এমন চিন্তায় পড়েন, তাহলে বেশিদিন না, এই তিন বছর আগের অর্থাৎ যখন ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন, তখনকার স্মৃতি হাতড়াতে অনুরোধ করছি। দেখুন তো এই কথাগুলো মনে পড়ছে কিনা ?
1. “কোভিশিল্ড মোটামুটি সেফ, কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এটি সাধারণ, যেকোনও টিকা নেওয়ার পরেপরেই বহু মানুষের কম বেশি হয়ে থাকে। যেমন ক্লান্তি, মাথা ধরা, গা ব্যথা , জ্বর, কাঁপুনি, বমি। বিরল কারুর কারুর ক্ষেত্রে বেশ কয়েক দিন টানা মাথা ধরা, পা ফোলা, দৃষ্টিতে ঝাপসাভাব এই সব দেখা দিতে পারে এবং সেরকম ক্ষেত্রে ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া উচিত। অতি বিরল ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বেঁধে অর্থ TTS এর কারণে অসুস্থতা, এমন কি মৃত্যুও হতে পারে। “
2. আমরা কোভিশিল্ড নিলাম। লাখে লাখেই নিলাম। প্রথমে স্বাস্থ্যকর্মীরা, তারপরেই “কো -মরবিডি “ ওয়ালা , এবং প্রবীণ মানুষজনকে দেওয়া হল। কোভিশিল্ড দেওয়ার সাথে সাথেই মৃত্যু এরকম ঘটনা খবরে এসেছিল গোটা তিনেক।
3. এর মধ্যে ইউরোপেও অনুরূপ সংখ্যক মৃত্যুর ঘটনা ঘটল। শ খানেক লোকের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ও লক্ষিত হল। হৈচৈ হল। বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ কিছুদিনের জন্য কোভিশিল্ড টিকা ব্যবহার স্থগিত রাখল। এখানেও, আমরা যারা বুদ্ধিজীবী , এই নিয়ে তর্ক বিতর্ক করার পরেও আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে, 2021 এ দ্বিতীয় ওয়েভ এ covid এ মৃত্যুর সংখ্যার তুলনায় টিকা নেওয়ার পরের মন্দ প্রতিক্রিয়ার সংখ্যা সত্যিই নগণ্য। মনে পড়ছে ? না হলে গুগল করে একটু খেটে পুরোনো তথ্য গুলো দেখে নিন, GPT ব্যবহার করবেন না।
তাহলে নতুন কি হল ? নতুন করে কোনও মৃত্যু, কোনও মন্দ প্রতিক্রিয়া কিন্তু খবরে নেই। খবর বলছে , আদালতের সামনে কোভিশিল্ড স্রষ্টা কোম্পানি অস্ট্রাজিনিকা বলেছে যে তারা ভালো, মন্দ সব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, TTS ইত্যাদি সম্বন্ধে অবগত ছিল। তার মানে কি এরা সে তথ্য চেপে গিয়েছিল ? অবশ্যই না। তাহলে 1, 2, 3 এ যা লিখলাম, অর্থাৎ আমরা এগুলো জানলাম কি করে?
যে কোনও নতুন ওষুধের মত, নতুন ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও ক্ষতিপূরণ আইন প্রযোজ্য, অন্ততঃ পশ্চিমী দেশগুলিতে। সেই আইন অনুযায়ী, আপাত সুস্থ ( নানা টেস্টের মাধ্যমে সুস্থতা যাচাই করে নেওয়ার পর ) কোনও মানুষ যদি ভ্যাকসিন নেওয়ার পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে বা প্রাণ হারান, এবং তদন্তে যদি প্রমাণ হয় যে কাকতালীয় ঘটনা নয়, ভ্যাকসিনই এই মন্দ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাহলে ভ্যাকসিনের শিকারটি বা তার পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য। 2022 সালে অস্ট্রাজিনিকার তরফে কোভিশিল্ড সংক্রান্ত প্রথম ক্ষতিপূরণটি জায়ণ (Zion ) নামে 2021 সালে মৃত ইংল্যান্ডের এক রকসংগীত শিল্পীর পার্টনার ভিকি স্পিট কে দেওয়া হয়। 2023 এর ফেব্রুয়ারি মাসে 1987র ক্রেতা সুরক্ষা আইনের আওতায় অস্ট্রাজিনিকার বিরুদ্ধে কোভিশিল্ড থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে মামলা করেন ডজন খানেক রোগী বা তার পরিবার। সেই মামলার শুনানীর সময়ে অস্ট্রাজিনিকার তরফ থেকে সেই বিবৃতি দেওয়া হয় যা এই লেখার আলোচ্য বিষয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে
1. তিন বছর আগে কোভিশিল্ড নেওয়ার ফলে ভবিষ্যতে কি হবে তাই নিয়ে চিন্তায় ঘুম হারাবেন কিনা ? এর জবাব হল -
ক ) ডাক্তাররা বলেন টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সাধারণতঃ টিকা নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই যা হওয়ার হয়ে যায়,
খ) Covid নিজেই সারা বিশ্বের সবার মধ্যে কি কি মন্দ প্রতিক্রিয়া রেখে গেছে, তা আমাদের এখনও জানতে বাকি আছে
গ) এই মুহূর্তে তীব্র তাপপ্রবাহের মন্দ প্রতিক্রিয়া টিকার প্রতিক্রিয়ার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি।
2. প্রধানমন্ত্রী জেনে শুনে পুরো দেশকে এই বিপদের মধ্যে ফেললেন ….. দেখ না , এখন ধরা পড়ার পর ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট থেকে ছবি উধাও….
ভ্যাকসিন বানিয়েছিল বিজ্ঞানীরা। আর আমাদের দেশে এক বিলিয়নকে যথেষ্ট সহজে টিকা দেওয়া সম্ভব বিগত কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা আমাদের টিকাকরণের পরিকাঠামো। কাজেই যতই ছবিওয়ালা প্রচার চলুক না কেন, এই টিকার পিছনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কোনও কৃতিত্ব নেই। টিকা সার্টিফিকেট এই মুহূর্তে কারোর লাগছে কি ? তবুও হৈ চৈ এর কারণে অনেকেই বোধহয় সেটা আবার খুলে দেখতে গেছে এবং সরকারি বা ক্ষমতাশীল দলের কারুর নজরে পড়েছে নির্বাচনের বাজারে ওই ছবি মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট ভাঙে। প্রধানমন্ত্রীকে সমালোচনার অন্য হাজারটা বৈধ কারণ থাকতে পারে, এই প্রসঙ্গে এই মুহূর্তে ওই রাজনীতিতে না করলেও চলবে।
3. অনেকে অস্ট্রাজিনিকার বিরুদ্ধে বা সিরাম ইনস্টিটিউট এর বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইছেন। করতেই পারেন। আমাদের দেশের আইনে যদি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ থাকে, তবে তাঁদের লড়ে সেটা আদায় করতে হবে, যদিও তাঁদের ব্যক্তিগত ক্ষতি কোনওদিন কোনও মূল্যেই পূরণ করা যাবে না।
ডঃ সুস্মিতা ঘোষ বায়োটেক স্টার্টআপ ডায়াগনোরাইটের প্রতিষ্ঠাত্রী, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ কানেটিকাট থেকে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সেস এর ডক্টরেট।