প্রথম কথা: চপ নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণা নিয়ে যারা হাসাহাসি করছে তারা অর্থনীতি শাস্ত্রে আধুনিক গবেষণা বিষয়ে কিছুই জানেন না।
দ্বিতীয় কথা: ওই গবেষণাপত্রের উপরে ‘মুখ্যমন্ত্রীর চপশিল্প ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে’ কথাটি যে শিক্ষক লিখেছেন, তিনি চাটুকারিতায় ডক্টরেট উপাধি পাওয়ার যোগ্য হতে পারেন, কিন্তু তিনিও প্রামাণ্য সর্বজনগ্রাহ্য গবেষণার বিষয়ে কিছুই জানেন না।
দুটো না জানা অবশ্য দু ধরনের। প্রথম দলে যারা, তারা এই বিষয়ে নিজেদের সময় এবং (ইন্টারনেট ও ডিভাইস ব্যবহারের জন্য) সামান্য কিছু হলেও অর্থ ব্যয় করে এই বিষয়ে মন্তব্য করছে। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সরকারি, মানে সাধারণ মানুষের পয়সায় বেতনভোগী একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কাজটা করেছেন। প্রথম দলভুক্তদের তাই মার্জনা করা যায়, দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যক্তিটিকে করা যায় না।
একটা বাস্তবে করা হয়েছিল এমন সমীক্ষা
আপনার সারাটা জীবন কেমন কেটেছে? মানে কতটা ভাল, কতটা মন্দ, নিজের প্রত্যাশার তুলনায় একশোর মধ্যে কত নম্বর আপনি নিজেকে দেবেন? এই পরীক্ষাটা করা হয়েছিল বিশ্বের একটা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু দল মানুষকে নিয়ে। এই দুটি দল সব বিষয়ে সম্পূর্ণ একই রকম। অর্থাৎ আর্থিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থান, কাজের ক্ষেত্র, বয়স, লিঙ্গানুপাত, পারিবারিক চিত্র, জীবনের অভিজ্ঞতা সমস্ত বিচারেই এক। বিজ্ঞানসম্মত এলোমেলোভাবে randomly শুধু এদের দুটি দলে ভাগ করা হল। এক একটি দলকে এক একটি ঘরে ঢুকিয়ে ওই কত নম্বর দেবেন প্রশ্নটার উত্তর দিতে বলা হল। একটি শুধু ছোট্ট তফাৎ করা হল। প্রথম দলের লোকরা ঘরে ঢুকে যে যার জায়গায় বসে লিখতে শুরু করল, আর দ্বিতীয় দলের লোকদের লেখা শুরু করার আগে একটা করে ছোট্ট চকোলেটের টুকরো খেতে দেওয়া হল। অতি সামান্য একটি সাধারণ চকোলেট একলেয়ার্স ধরা যাক।
সার্ভে শেষ হওয়ার দুটি দলের উত্তর যাচাই করে দেখতে বসলেন সমীক্ষকরা। দেখা গেল জীবনের 35/40 বছর হুবহু একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরেও দ্বিতীয় দলের লোকরা তাদের নিজেদের জীবন সম্বন্ধে অনেক ভাল মূল্যায়ন করেছেন। এতটাই দুটি দলের মধ্যে নিজেদের জীবন সম্পর্কে মূল্যায়নের ফারাক যে সমীক্ষক-গবেষকরা তা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তিন মিনিটে খাওয়া হয়ে যায় এমন একটি এক টাকা দামের চকোলেট মধ্যবয়সী, সচ্ছল, প্রাজ্ঞ, সচেতন মানুষদের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে মূল্যায়ন বদলে দিল!
প্র্শ্ন: আজ রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাসক দলের স্তাবক এবং চাটুকারিতায় দক্ষ এক শিক্ষক এই সমীক্ষাটা করে তার ফল প্রকাশ করলে কী হত?
উত্তর: সোশ্যাল নিডিয়ায় তা নিয়ে হাসাহাসি হত, যেমন চপ শিল্পের উপর গবেষণা নিয়ে হচ্ছে।
প্র্শ্ন: বাস্তবে ওই গবেষণাটির পরিণতি কী হয়েছিল
উত্তর: গবেষণাটি হয়েছিল অর্থনীতি চর্চায় বিশ্বের অন্যতম অগ্রগণ্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রধান গবেষক ছিলেন রিচার্ড থেলার। এই জাতীয় বিষয়, যাকে আজকাল আচরণভিত্তিক অর্থনীতি বা Behavioural Economics বলা হয়, জ্ঞানচর্চার সেই শাখায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য 2017 সালে রিচার্ড থেলার অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান।
নোবেল পুরস্কার বনাম চাটুকারিতার জন্য প্রোমোশন
হ্যাঁ, সত্যিই নোবেল পুরস্কার! তারও দুই বছর পর 2019-এ বাংলার ছেলে অভিজিৎ বিনায়কের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারও এই ধরনের একেবারে বাস্তবের মাটি থেকে হাতে করে তুলে আনা জ্ঞানের উপর কাজের ফলেই। তবে অর্থনীতির এই শাখার চর্চায় সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কার সম্ভবত তারও অনেক আগে, 2002 সালে ড্যানিয়েল কাহনেম্যানের। চারপাশে তুমুল ঢক্কানিনাদের মধ্যে থেকেও কী করে আবর্জনা বাদ দিয়ে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় অর্জুনের মতো টিয়াপাখির চোখকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করা যায়, সে বিষয়ে কাহনেম্যান ও সহযোগীরা এখনও লিখে চলেছেন (সহযোগীদের নিয়ে লেখা তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই Noise)।
তবে এত কিছুতে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষকের গৌরব বোধ করার কণা মাত্র কারণও আমরা দেখছি না। একটি বৌদ্ধিক সম্পদ, গবেষণাপত্র (হোক না তা সামান্য মাস্টার্স স্তরের) যেই মুহূর্তে কোনও ব্যক্তির ভাবনার সঙ্গে যুক্ত বলে লেখা হয়, সেই মুহূর্তে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চার জগতে তার মূল্য কমে যায়। আর যার নাম করা হচ্ছে তিনি যদি রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হন, তবে সেটা হাস্যকর চাটুকারিতায় পরিণত হয়। চপশিল্প নিয়ে আলোচ্য তথাকথিত গবেষণাপত্রটি যা হয়েছে।
গবেষণা, সত্যিকারের রিসার্চ, জ্ঞান অন্বেষণের জন্য হতে পারে। চপ শিল্প কীভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিস্তার লাভ করেছে এবং তাতে সংশ্লিষ্ট সকলের জীবনে কী অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে – এটা একটা চমৎকার গবেষণার বিষয়। এই গবেষণাপত্রটি ড্যানিয়েল কাহনেম্যান বা রিচার্ড থেলারের অনুপ্রেরণায় হয়েছে বললে আমরা চমৎকৃত হতাম। তার জায়গায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম লিখে ওই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিজের মূর্খতা ও চাটুকারিতা বৃত্তির উপর স্থায়ী শিলমোহর এঁটে দিয়েছেন।
#ChopShilpoResearchPaper #chopshilpo #chopindustry #raiganjuniversity