জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে শীর্ষ প্রশাসকবৃন্দ, আপন বৈরাগ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া এই দেশে গোটা দেশের যুব সমাজের একটা বড় অংশ নিষ্কাম হয়ে গেছেন। মহামারীর অভিঘাতে দেশের অর্থব্যবস্থা যখন টালমাটাল, তখন 2017 থেকে 2022 সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে ভারতে শ্রমে নিযুক্ত মানুষের হার কমতে কমতে 40 শতাংশে এসে ঠেকেছে। যেটা আগে ছিল 46 শতাংশ। আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যে, এই সময়ের মধ্যে 2 কোটিরও বেশি মহিলা কাজ ছেড়েছেন!
CMIE-র রিপোর্টে আরও বলা হচ্ছে, ভারতের শ্রমযোগ্য প্রায় 90 কোটি মানুষের অর্ধেকেরও বেশি শ্রমবিমুখ হয়ে উঠেছেন, অর্থাৎ তাঁরা কাজ করতে চাইছেন না। 2017 থেকে 2022 সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে ভারতে শ্রমে নিযুক্ত মানুষের হার কমতে কমতে 40 শতাংশে এসে ঠেকেছে। যেটা আগে ছিল 46 শতাংশ। আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যে, এই সময়ের মধ্যে 2 কোটিরও বেশি মহিলা কাজ ছেড়েছেন! CMIE প্রধান মহেশ ব্যাস একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, দেশের কর্মজীবী মানুষের অন্তত 60 শতাংশ কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়, এমনকি পছন্দমতো কাজের অভাবে তারা নতুন কোনও কাজ খুঁজতেও উৎসাহী নয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দাবি করা হচ্ছে, কোভিড-কালের সংকট পেরিয়ে আবার চাঙ্গা হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু দেশে কর্মসংস্থানের ছবিটা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। স্বাধীনতার পর দেশে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ— ফেব্রুয়ারি, 2022-এ এই হার 8.10 শতাংশ, যা গত 46 বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এমন নয় যে, প্রাক কোভিড কালে দেশের অর্থনীতি খুব ভাল জায়গায় ছিল। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি আরও শোচনীয় করেছে। CMIE রিপোর্ট বলছে, 2020 সালের মে-জুন মাসে দেশে যখন কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ চোখ রাঙাচ্ছে, তখন প্রায় 22 কোটি 7 লক্ষ মানুষ কাজ হারান। অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত ঠিক কতজন মানুষ কাজ হারিয়েছেন, সেই বিষয়ে সরকারের তরফে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। কেন্দ্রের পর্যায়ক্রমিক শ্রমজীবী সমীক্ষায় (Periodic Labour Force Survey) যেহেতু শুধু সংগঠিত ক্ষেত্রেরই মূল্যায়ন করা হয়, তাই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের ছবিটি CMIE-র মতো সংস্থার পরিসংখ্যান থেকেই জানা যায়।
এখান থেকেই স্পষ্ট যে রাজ্য কিংবা রাজনৈতিক দল ভেদে কোনও শাসকেরই কর্মসংস্থানের বিষয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। তাদের দায়সারা মনোভাবই বেকারত্বের প্রধানতম কারণ। দেশের সরকারগুলি যেমন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে, তেমনই নিয়ম মেনে শূন্যপদগুলিতেও কোনও নিয়োগের পথে হাঁটেনি।
কেন্দ্রীয় সরকার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপারে এতটাই অসংবেদনশীল যে, সম্প্রতি রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ড (RRB) তাদের NTPC (Non-Technical Popular Category) পদে নিয়োগের জন্য পরীক্ষার যে বন্দোবস্ত করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে পরীক্ষার্থীদের প্রায় 400-500 কিলোমিটার দূরে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। অনেক পরীক্ষার্থীর কাছেই কার্যত যেটা অসম্ভব। অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশে পিওন পদে 62টি শূন্য আসনের জন্য 93,000 জন চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেছেন, যাঁদের মধ্যে 3700 জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী, 28,000 জন স্নাতকোত্তর এবং 50,000 জন স্নাতক। অথচ এই পদে আবেদন করার ন্যূনতম যোগ্যতামান পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ! অতিরিক্ত দক্ষতা হিসাবে সাইকেল চালাতে জানতে হবে। শুধু চাকরির স্থায়িত্ব আর সম্মানজনক বেতনের জন্য যেভাবে বিপুল সংখ্যক চাকরিপ্রার্থী এই পদের জন্য আবেদন করেছে, তা থেকেই দেশে কর্মসংস্থানের হাঁড়ির হাল প্রকট হয়।
পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থানের বেহাল অবস্থাটাও বেআব্রু হয়ে পড়েছে। তৃণমূল সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পাদন করার জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন (PSC)-কে প্রভূত ক্ষমতা দিয়েছিল এবং পূর্বতন স্টাফ সিলেকশন কমিশনকে (SSC) PSC-র সঙ্গে অঙ্গীভূত করে দিয়েছিল। বাৎসরিক ভাবে একটি WBCS (West Bengal Civil Service) বা পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনিক কৃত্যকের পরীক্ষা নেওয়া ব্যতীত PSC দীর্ঘদিন বড় কোনও নিয়োগের পথে হাঁটেনি। পরীক্ষার্থীদের একজনের কথায়, ""2020 সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপ (Mains)-এর ফলাফলই এখনও প্রকাশ করতে পারেনি পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এদিকে 2022 সালের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার নোটিফিকেশন বেরিয়ে গেছে। আমরা কোথায় যাব?''
2019 সালে ভারতীয় রেল রিক্রুটমেন্ট বোর্ড (RRB) তাদের অ-কারিগরি বিভাগে (Non-Technical Popular Categories, সংক্ষেপে NTPC) বিপুল কর্মীনিয়োগের কথা ঘোষণা করে। সেই মোতাবেক এই পরীক্ষার প্রথম ভাগের কম্পিউটার নির্ভর পরীক্ষাটি (Computer Based Test, সংক্ষেপে CBT) হয়েছিল। তিন বছর পরে এই পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপ CBT-2 2022 সালের মে মাসের 8 থেকে 10 তারিখের মধ্যে হওয়ার কথা। পরীক্ষার্থীরা তাঁদের আবেদনে নিকট পরীক্ষাকেন্দ্র হিসাবে রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের কলকাতা কিংবা মালদহ জোনের কথা বললেও তাদের গুন্টুর কিংবা গুয়াহাটিতে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে।
অন্যান্য রাজ্যের পরীক্ষার্থীদেরও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমনিতেই দেশে কয়লার ভাঁড়ারে টান পড়ায়, বহু প্যাসেঞ্জার ও দূরপাল্লার ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। তার ওপর অল্প সময়ে অধিকাংশ ট্রেনেই সংরক্ষিত আসন মিলছে না, অতএব পকেটের টাকা খরচ করে অসংরক্ষিত আসনেই পরীক্ষা দিতে যেতে হবে পরীক্ষার্থীদের। পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রেলের বৈধ টিকিট কাউন্টার থেকে অসংরক্ষিত আসনের টিকিট কাটলে এবং সঙ্গে পরীক্ষার অ্যাডমিট থাকলে সচরাচর জরিমানা করা হয় না। মেয়েদের অনেকের বক্তব্য, বাড়ি থেকে একা অত দূরে গিয়ে পরীক্ষা দিতে যাওয়া সম্ভব নয়। মূলত নিরাপত্তাবোধের অভাব থেকেই একটা বড় অংশের মহিলা পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের কাছে পরীক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানালেও, কর্তৃপক্ষ সবিনয়ে জানিয়েছে, পরীক্ষার সূচি ও স্থান পরিবর্তন সম্ভব নয়!
CMIE-র একটা রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে, দেশের যুব সমাজের একটা অংশ সম্পূর্ণ ভাবে বেকার না হলেও, তাদের নির্দিষ্ট কোনও পেশা নেই। সুস্থায়ী চাকরি বা পেশার পরিবর্তে এরা নিজেদের মতো করে অর্থ সংস্থান করার চেষ্টা করে। স্বল্পমেয়াদী ও বিক্ষিপ্ত আয়ের লক্ষ্যে মূলত রাজনৈতিক দলগুলির হয়ে কাজ করতেই এদের বেশি দেখা যায়, যাতে লাভবান হয় রাজনৈতিক দলগুলি। সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নীকরণ, নয়া শ্রম আইন কিংবা চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগের পথ অবলম্বন করায় দেশের চাকরিপ্রত্যাশী যুবসমাজ এমনিতেই বিভ্রান্ত। তাই এখনও মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি স্থায়ী সরকারি পদ আছে, সেগুলোয় নিযুক্ত হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা আরও বেড়েছে। কোভিড বুঝিয়ে দিয়েছে, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে চাকরি ও বেতনের নিশ্চয়তা দিতে সমর্থ সরকারি চাকরি। এমন অসহায়তার মাঝে সরকারের স্রেফ ছেলেখেলা করার মানসিকতাও ফুটে উঠছে উপরিউক্ত ঘটনাগুলি থেকে।
যে NTPC-র পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপ, Computer Bases Test (CBT) 2-এর পরীক্ষাস্থল পরিবর্তন নিয়ে পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ, সেই NTPC পরীক্ষার প্রাথমিক পর্বে অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিহারে রেল রোকোর ডাক দিয়েছিলেন পরীক্ষার্থীরা। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, 2019 সালের ঘোষণায় একটি কম্পিউটার নির্ভর পরীক্ষা (CBT)-র ভিত্তিতে গ্রুপ-ডি পদে কর্মী নিয়োগের কথা বলা হলেও, রেল কর্তৃপক্ষ পরে এই পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপ (CBT-2)-এর কথা ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পরীক্ষার্থীরা দাবি তোলে যে, প্রাথমিক পর্বে নির্বাচিত পরীক্ষার্থীদেরই অবিলম্বে নিয়োগ করতে হবে। রেল কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক ভাবে তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেও, পরীক্ষার্থীদের অনমনীয় অবস্থানে তারা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হয়। বর্তমানে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে বিষয়টি।
মামলার জটে আটকে আছে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াও। সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের কাজে বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি— নানা ঘটনায় হাইকোর্ট পরপর সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। তার প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। রাজ্যে শিক্ষকের অভাবে স্কুলগুলি ধুঁকতে বসেছে, অন্যদিকে খোদ নিয়ামক সংস্থা স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC)-এর বিভিন্ন কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধেই নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, SSC-র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের কথা বললেও না আঁচিয়ে ভরসা রাখতে রাজি নন চাকরিপ্রার্থীরা। তাঁদের একজনের বক্রোক্তি, ""বি-এড কলেজগুলিতে ভর্তির জন্য উৎসাহিত করতেই এমন নিষ্ফলা দাবি বারবার করা হয়।''
দেশের প্রশাসকরা প্রায়ই আত্মনির্ভরতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাঠ দিচ্ছেন। কেউ চায়ের দোকান দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তো কেউ আবার পকোড়া ভাজার। কিন্তু মহামারী পরবর্তী সময়ে দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্র এতটাই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে যে, চাকরি ও বেতনের নিশ্চয়তার জন্য সকলেই সরকারি চাকরির দিকে ছুটছে। নতুন শ্রম আইন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা পরীক্ষানিরীক্ষা এবং প্রস্তাবিত আইনে শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী নানা সংস্থানও বিভ্রান্ত করছে তরুণ চাকরিপ্রার্থীদের। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়ার কথা বললেও, তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের নানা ভাবে অসহযোগিতা করার অভিযোগ উঠছে। ব্যাঙ্কের ঋণ পেতে নানা ঝক্কি পোহানোর কথা জানাচ্ছেন এই ব্যবসায়ীরা।
যে দেশে মোট জনসংখ্যার 65 শতাংশই 35 অনূর্ধ্ব, সেই দেশের যুব সমাজের 23 শতাংশই (ILO-র 2019 সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী) যখন কর্মহীন থাকে, তখন মনে পড়ে যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের "ছন্নছাড়া' কবিতার সেই অমোঘ পঙক্তি-
""ওরা যে নেই রাজ্যের বাসিন্দে–
ওদের জন্যে কলেজে সিট নেই,
অফিসে চাকরি নেই,
কারখানায় কাজ নেই,
ট্রামে-বাসে জায়গা নেই...।''