4thPillar


আত্মনির্ভরতা আর ভারতীয় ঔষধ ভাণ্ডারের অলীক রূপকথা

সুস্মিতা ঘোষ | 04-03-2022June 24, 2023
আত্মনির্ভরতা আর ভারতীয় ঔষধ ভাণ্ডারের অলীক রূপকথা

ভারতে বিজ্ঞানের গবেষণা আজ কোথায় দাঁড়িয়ে?  গত প্রায় আট বছর ধরেই বিজ্ঞানীদের চাপ দেওয়া হচ্ছে যে মৌলিক বিজ্ঞান ছেড়ে ফলিত বিজ্ঞান ধরো, এমন কিছু বানাও, যাতে দেশের উপকার হবে। আর ‘মৌলিক বিজ্ঞান’-এর সখ যদি মেটাতেই হয়, তবে আত্মনির্ভর (Atmanirbhar Bharat) হও, গবেষণা ইত্যাদিতে যে খরচ লাগে, তা নিজেরাই তোলো। 2014 সাল থেকে শুনছিলাম Make in India স্লোগান। 2020 তে স্লোগানের ভাষাটা বদলে গেল, ‘আত্মনির্ভরতা!’ 2021-এ শুনলাম ভারত নাকি ‘বিশ্বের ঔষধ ভাণ্ডার!’ এর মধ্যে কতটুকু বাস্তব আর কতটা রূপকথা?
 
মৌলিক বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না, কারণ সেখানের কথা বলার জন্যে সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা ছড়িয়ে আছেন, এবং তাঁরা বলছেনও। আমি একটা রূপকথার জগতের কথা বলব, যার নাম techno-preneurshipবা বিজ্ঞান প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উদ্যোগ। এই জগতে আমি এখনও বিচরণ করছি, তাই সমস্ত অভিজ্ঞতাই প্রত্যক্ষ।
 
Entrepreneurship ও  innovationএর গল্প

এই শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে সারা বিশ্বে কতকগুলো শব্দ একটু বেশি করেই শোনা যেতে লাগল- entrepreneurship, innovation. শব্দগুলোর মধ্যে বেশ ক্ষমতার গন্ধ আছে - “Be your own boss'' কথাটা তো আছেই। যারা গবেষণা ইত্যাদি করতে ভালবাসে, যারা স্বাধীনচেতা, তাদের এই শব্দগুলো নাড়া দেয়। তারা ভাবে এটাই প্যাশনের স্বীকৃতির সুযোগ।
 
2010 থেকে এই হিড়িক শুরু হলেও অনেকটাই ছোট আকারের ছিল এবং ব্যাঙ্গালোর, দিল্লি, হায়দরাবাদ, মুম্বাই এবং খানিকটা পুণের মধ্যে এবং আইআইটি, IIM গুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল। Enterpreneurshipকে প্রমোট করার জন্যে 2010 এর সময় থেকেই আইআইটি ইত্যাদি জায়গায় "incubator' তৈরি হল। উদ্দেশ্য হয়তো সাধুই। মেধাবী ছাত্ররা, যারা নতুন কিছু ভাবে, বর্তমান বা আগামীদিনের সমস্যার অভিনব সমাধান দিতেচায়, কিন্তু অর্থবল ইত্যাদি কিছুই নেই, তাদের স্বপ্নকে হাত ধরে বাস্তবায়িত করার সুযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশকে স্বনির্ভর এবং উন্নত করা। উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন ছাত্রের কাজ করার জন্যে নিজের কোনও অফিস নেই, যন্ত্রপাতি নেই, টাকা নেই, ব্যবসাবুদ্ধি নেই- এইসব incubator –এ তাদের মতো অনেককে একসঙ্গে লালন করা যাবে। কম ভাড়ায় এক চিলতে অফিস, মিটিং করার জায়গা, ল্যাবরেটরি ইত্যাদি নেওয়ার সুযোগ থাকবে, এবং তার সঙ্গে এদের ট্রেনিং দেওয়া হবে কী করে ব্যবসা শুরু করতে হয়। উদ্যোগপতিদের কিছু অনুদান দেওয়া হবে, এবং বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হবে যাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসাকে বড় করা যায়। কে  না জানে ব্যবসার সাফল্যের একটা বিরাট দিক হল যোগাযোগ বা নেটওয়ার্কিং। আগে TiEর মতো মুষ্টিমেয় কয়েকটি ক্লাব ছিল উদ্যোগপতিদের নেটওয়ার্কিং-এর জন্য। এইসব incubator তার সংখ্যা বাড়াল।
 
2015-র পর এই হিড়িক প্রায় মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ল। মেক ইন ইন্ডিয়ার সঙ্গে হাত ধরে এল স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া। সমস্ত বড় ক্যাম্পাসওয়ালা শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে incubator খুলতে বলা হল। সবার মুখেই এক কথা- উদ্যোগপতিরা যদি যথেষ্ট আন্তরিক হয়, যদি লক্ষ্যে স্থির থাকে,  তবে unicorn হওয়া অর্থাৎ একশো কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের কোম্পানিতে পরিণত হওয়া শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষা! বলাই বাহুল্য পাশাপাশি বেসরকারি incubatorএবং নেটওয়ার্কিং ক্লাবও কিন্তু চালু হয়ে গেল। এদের কাজই হল সেই এক বিলিয়নের স্বপ্নকে ফেরি করা। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন incubator গুলির ভাড়া ইত্যাদি অনেক সময়ে নামমাত্র, এবং ট্রেনিং অনেক সময়ে ফ্রি। সরকারি অনুদান পেলে এই খরচগুলো তার থেকেই পুষিয়ে যায়। যারা সরকারি অনুদানের খবর জানে না, বা পায়নি, তাদের খোঁজে এই বেসরকারি ক্লাব বা incubator গুলো। এদের চাঁদাও বেশি, ভাড়াও বেশি, কিন্তু যারা এদের কাছে প্রথম আসে, তাদের এই টাকাটা সম্ভবত নিজের পকেট থেকেই দিতে হয়। কোভিড আসার পরে এই প্রাইভেট ক্লাবগুলির কী অবস্থা পুরোটা বলতে পারব না, কিন্তু 2019 এর শেষে সরকারি অনুদানে প্রায় সমস্ত বড় সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে incubator তৈরি হয়েছে, এবং হাতে গোনা কয়েকটিকে বাদ দিলে বেশির ভাগই খালি।
 
2019-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতের অর্থনীতি ভীষণ শক্তিশালী এরকম একটা গল্প চালু ছিল। বেশ কিছু উদ্যোগপতিও করে খাচ্ছিল। কিন্তু তাদের কীসের ব্যবসা? লিস্ট করলে পাওয়া যায় সফ্টওয়্যার (fintech, edutech, medtech etc.), মালপত্র সাপ্লাই, সার্ভিস সাপ্লাই, শিক্ষা, অল্টারনেটিভ মেডিসিন, হসপিটালিটি, ভ্রমণ, ফ্যাশন, এন্টারটেইনমেন্ট এবং টাকা খাটানোর। এই সব কোম্পানির উপভোক্তা বা ক্রেতা হল ভারতের জনসংখ্যার ওপরের 2 কী বড়জোর 3 শতাংশ- যাদের পারিবারিক রোজগার বছরে 10 লাখ বা তারও বেশি। আর এক ধরনের লোক এন্ত্রেপ্রেনিউরের দলে নাম লিখিয়েছে- মধ্যবয়সী কিছু প্রাক্তন টপ ম্যানেজমেন্ট-এর মানুষ, যাদের মনে হয়েছে অন্যের হয়ে বিজনেস ডিলগুলো কেন করব, নিজের জন্যেই তো করতে পারি।
 
2019-এর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে কিন্তু ভারতের অর্থনীতির ওপরের চকচকে মোড়কে ফাটল ধরতে শুরু করল।গাড়ির ব্যবসায় মন্দা...গাড়ি কোম্পানিতে ছাঁটাই...কিন্তু স্টার্ট আপের চোখ ধাঁধানো গল্প চলছেই। প্রাইভেট incubator বা coworking space এর ব্যবসায় অনেকেই টাকা ঢেলেছে। এমনকি চিনের কোম্পানি WeWorkও ভারতের বিভিন্ন শহরে ঝাঁ চকচকে coworking এর কেন্দ্র, যাকে নাকি ওরা colivingও বলে, খুলেছে।
 
তারপর এল করোনা এবং খুলে গেল প্যান্ডোরার বাক্স
 

শ্বাস দিয়ে ছড়ায় এরকম রোগ কিন্তু পৃথিবীতে চিরকালই ছিল এবং থাকবেও। টিবি কিন্তু আজও আছে, এবং সমাজের সব স্তরের মানুষের হয়। কিন্তু টিবি নিয়ন্ত্রণ বলতে কিছু সেলিব্রিটিকে দিয়ে টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া ছাড়া সচেতনতা নেই। আর  artificial intelligence  (AI)-এর অতি হিড়িকে ‘সচেতন’ মানুষের মাথায় ঢোকানো হয়েছে, যে মানুষের স্বাস্থ্য সম্পূর্ণভাবেই খুব শিগগিরই AI দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ওই যে স্মার্ট watch বেরিয়েছে, তার একটা কিনলেই সব রোগ নির্ণয় হয়ে যাবে। ডাক্তারের দরকার নেই। ব্লাড টেস্ট ইত্যাদির দরকার নেই। ডাক্তারি পড়ানোর কী দরকার- প্রতিষ্ঠিত হতে 35 পেরিয়ে যাবে। বায়োলজি পড়ার দরকার কী, বাজে মুখস্থ করা সাবজেক্ট। তার চেয়ে ছোট্টবেলা থেকে কোডিং শেখাও- AI/AR/MLএরাই তো ভবিষ্যৎ। এই যখন জনগণের মতামত তখন রোগ প্রতিরোধ করতে যে বেসিক স্বাস্থ্য আর বায়োলজির জ্ঞান লাগে, সেটা জনগণ হয় শেখেনি, নয় ভুলে মেরে দিয়েছে। স্বাস্থ্য বলতে মানুষ শুধু পরিষ্কার করা বোঝে- বিজ্ঞাপনগুলো সেটাই পাখি পড়া করে শেখায়।
কাজেই যা হওয়ার তাই হল- করোনা সেই যে ছড়িয়েছে, তারপর আর পালানোর নাম গন্ধ নেই।
 
যখন লকডাউন শুরু হল, তখন বোঝা গেল আত্মনির্ভর ভারতের হাতে কিছুই নেই। করোনা আটকানোর প্রতিষেধক হল মাস্কের পরেই টেস্ট করে কারা কারা বাহক চিহ্নিত করে তাদেরকে আলাদা রাখা। কিন্তু diagnostics সেক্টরে ভারতের কোনওদিনই আত্মনির্ভরতা নেই। 2014-র আগে সরকারি গবেষণাগারের কিছু কিছু বিজ্ঞানীর HIV টেস্ট বাজারে এসেছিল বটে। কিন্তু তারপর থেকে সরকারি গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা আত্মনির্ভর হওয়ার মতো কোনও গবেষণা করতে চান না, কারণ বৈজ্ঞানিক তথ্যে নতুনত্ব না থাকলে গবেষণাপত্র লেখা হবে না। সেটা না হলে পদোন্নতি হবে না। যেসব বিজ্ঞানী উদ্যোগপতি হতে চেয়েছে, তাদের অনেকে কিন্তু ভারতের diagnostics সেক্টরের বিশাল ফাঁকটা ভরাট করার সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়েছিল। সরকার তাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল প্রথম দিকে। কিন্তু তাদেরই পছন্দ করা হয়েছিল, যাদের কাজ বা পদ্ধতির মধ্যে নতুনত্ব আছে। যুক্তিটা খারাপ নয়- নতুনত্ব থাকলে intellectual property তৈরি করা যায়, যেটা দেখে বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করে। এখন এই সব টেস্টের কোনও উপকরণই ভারতে তৈরি হয় না, ভারতে তৈরি করতে গেলে আবার গবেষণা করতে হবে, এবং সেই গবেষণায় পেটেন্ট হবে না, গবেষণাপত্র হবে না, কাজেই টাকা সরকার দেবে না। বিনিয়োগকারীরা? তাদের বয়ে গেছে গবেষণার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কিছুতে টাকা দিতে। কারণ তাদের টাকা খাটিয়ে সহজে এবং তাড়াতাড়ি পয়সা করার অন্য অনেক উপায় আছে এবং সেটাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
 
2014-র আগে কিন্তু ঘটনাটা ঠিক এরকম ছিল না। বড় বড় শিল্পে গবেষণা করার জন্যে 175 শতাংশ ট্যাক্সে ছাড় ছিল। Blue sky প্রজেক্ট অর্থাৎ জনহিতকারী কোনও পণ্য উদ্ভাবনের গবেষণায় এ অনেক ইনসেন্টিভ ছিল। ছোট সংস্থারও ট্যাক্সে ছাড় দেখিয়ে দান পাওয়া সহজ ছিল, কারণ কার গবেষণা এসব ছাড় পাওয়ার উপযোগী, সেসব স্থির করত বিজ্ঞান দপ্তর। 2015-র পরে এ সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে নিল অর্থ দপ্তর। আর একটা সুযোগ ছিল গবেষণার টাকা জোগাড় করার- শিল্পপতিদের corporate social responsibility খাতে লভ্যাংশের 2 শতাংশ নাকি খরচ করতেই হবে। খরচ করতেই হবে, কিন্তুঅডিটের কোনও দরকার নেই। কাজেই খরচ আদৌ হল কিনা কে দেখতে যায়! সরকার তো খুদকুঁড়োর বেশি দিতে পারে না। বেসরকারি কেউ-ও দেবে না, কারণ সরকার কি সত্যি সত্যি চায় তারা দিক? কাজেই গবেষণার খরচ তোলার মতো কোনও উৎসই নেই। অর্থাৎ, আত্মনির্ভর হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় গবেষণা হবে না। হয়ওনি। কাজে কাজেই করোনা যখন ভারতে ছড়াচ্ছে, তখন ভারতের হাতে প্রায় কোনও টেস্টই নেই।


আত্মনির্ভরতা আর ভারতীয় ঔষধ ভাণ্ডারের অলীক রূপকথা


ভারতের নিজস্ব টেস্টের “গল্প”
 
অনেকের গত বছরের হেডলাইন এবং সোশাল মিডিয়া ফরওয়ার্ডগুলো মনে পড়তে পারে। কোনও স্টার্ট আপ নাকি ভারতের আত্মনির্ভরতার ধ্বজা ধরে কোভিড টেস্ট কিট বানিয়েছে। কোনও কোনও বিজ্ঞানী নাকি পৃথিবীর মধ্যে সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে নাকি এমন কোভিড টেস্ট বানিয়েছে যে সে জনপ্রিয় গোয়েন্দার মতো কোভিড খুঁজে বার করতে পারে, এবং একজন ‘ভগবান’রূপী শিল্পপতি সেটিকে বাজারে আনার ব্যবস্থা করছেন- এসব টেস্ট তারপর কোথায় গেল?
 
স্টার্টআপটি আগেও যা করত, এখনও তাই করছে- বিদেশ থেকে রাসায়নিক বা টেস্ট কিটের মাল মশলা আমদানি করার পর রিপ্যাক করে বিক্রি করা, কিন্তু ‘প্রথম কিট’ বানানোর পুরস্কার হিসেবে অনেক সরকারি আনুকূল্য, কারখানার জমি ইত্যাদি পেয়ে গেছে। “আবিষ্কার”এখন ওয়েবসাইটের ঝকমকে একটা শব্দ। ভারতে বসে আবিষ্কার করে দেড় বছরে বাজারমাত করা একমাত্র আলাদিনের জিনের পক্ষে সম্ভব। বরং বিদেশি কিটকে “আমার জিনিস” নাম দিয়ে ঘরে বসে করার টেস্ট বিক্রি করা অনেক সহজ – সরকারই যেখানে অনুকূল। নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন অনেকেই তুলেছে, কিন্তু বিকল্পের তো কোনও সুযোগ নেই!
 
আগেই বলা হয়েছে যে, diagnostics এর ক্ষেত্রে ভারত ভীষণভাবে পরনির্ভরশীল। মাল মশলা যা লাগে, তার বেশিরভাগই কিন্তু গরমে নষ্ট হয়ে যায়।এমনিতেই সেগুলো যখন আমদানি করা হয়, বন্দরে ঠিক ভাবে না রাখায় এবং লাল ফিতের কারণে 50 শতাংশ বা তার বেশিই নষ্ট হয়ে যায়। এই কারণেই অনেক সময়েই টেস্টের রিপোর্ট ঠিক মতো সাহায্য করতে পারে না। করোনাকালে ঠিক এই কারণেই অসংখ্য ফলস রেজাল্ট পাওয়া গেছে। ফলস নেগেটিভরা অজান্তে অনেককে সংক্রমিত করেছে। আর ফলস পজিটিভদের অকারণ দুশ্চিন্তা ও হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। এই একই ধরনের মালমশলা রাসায়নিক পদার্থ আবার গবেষণাতেও লাগে। সরকারের আত্মনির্ভরতার স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে আইন জারি হয়েছে যে, সদুত্তর না পাওয়া গেলে কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠান (প্রায় সমস্ত গবেষণাগারই সরকারি) কিছুই আমদানি করতে পারবে না। পোয়াবারো কিন্তু বেসরকারি ব্যবসায়ীদের, কারণ তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই। তারা মনের সুখে আমদানি করে ভারতীয় লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করে যাচ্ছে!
তাহলে এটাকে কি আত্মনির্ভরতা, স্টার্টআপ বিপ্লব বলা হবে?
 
Innovation এর নাকি ছড়াছড়ি?
 
আবার innovation প্রসঙ্গে আসি। সরকার এবং নানা মিডিয়াতে এই প্রসঙ্গট খুব ফলাও করে বর্ণনা করা হয়। সব সময়ই শুনতে পাওয়া যায় ‘অমুক এই প্রাইজ পেল’, ‘অমুককে অমুক বিখ্যাত ম্যাগাজিন শ্রেষ্ঠ উদ্যোগপতির তকমা দিয়েছে।‘ এরচেয়ে একটু কম শোনা যায় ‘অমুক তার স্টার্ট আপের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছে।‘ আর সব থেকে কম শোনা যায় যে অমুকের স্টার্ট আপ একটি বিখ্যাত কোম্পানি অধিগ্রহণ করেছে।
 
আসলে আত্মনির্ভরতা নয় বা দেশভক্তি নয়,  তরুণ উদ্যোগপতিদের শেখানো হয়, তাদের আবিষ্কার বা উদ্ভাবনার কাজ ঠিক ততটা অবধিই করা যায় যখন তার ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বা তার গোটা স্টার্ট আপটাই কাউকে বিক্রি করে দেওয়া যায়। খুব কম কয়েকজন এতই মেধা দেখায় যে বড় কোম্পানি তার স্টার্ট আপ কেনা অর্থাৎ acquire করার সময়ে প্রতিষ্ঠাতাকেও অংশীদার হিসেবে রাখতে চায়। ইনকিউবেটর থেকে “ব্যবসা শেখার “ ট্রেনিং দিতে যাদের ডাকা হয়, তাদের বেশিরভাগই মাইনে করা – জীবনে ব্যবসা করেনি বা তাদের শুধুমাত্র কন্সালটেন্সির ব্যবসা- ট্রেনিং  করিয়ে খায়। কিছু কিছু “সফল “ উদ্যোগপতিকে কখনও কখনও বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডাকা হয় - “সফল” কারণ হয় সে বিনিয়োগ জোগাড় করতে পেরেছে, না হলে তার স্টার্ট আপ acquired হয়েছে। ট্রেনিং-এর সঙ্গে আর যেটা খুব বেশি করে হয়, সেটা হল অনুষ্ঠান এবং প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বেশিরভাগ সময়েই খ্যাতি -  নানা মিডিয়ার আলোতে প্রচার – কখনও সখনও সেটা দেখে বিনিয়োগপতিরা আকৃষ্ট হতে পারে। আর্থিক পুরস্কার খুব কম থাকে – থাকলেও সেটা উদ্যোগপতিদের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার মান বাড়াবার পক্ষে ভাল- দেশের আত্মনির্ভরতা বা সার্বজনীন সমস্যার সমাধান করার পক্ষে একেবারেই যথেষ্ট নয়।
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা না বললেই নয়। করে খাওয়া উদ্যোগপতিদের আর একটা বিরাট অংশ আছে মিডিয়াতে- যাদের অনেকে আবার পয়সার বিনিময়ে innovator ইত্যাদিদের ফিচার করে, কিন্তু আসলে যে সেটা ‘বিজ্ঞাপন’ সেই কথাটা বলে না।
 
আমাদের দেশের আত্মনির্ভরতার এই গল্পটা কিন্তু পুরোটা চিরকালের নয়। আগে আমাদের দেশ অনেক বেশি আত্মনির্ভর ছিল। অনেক ওষুধই বা ওষুধের কাঁচামাল, যাকে active pharmaceutical ingredient বা API বলা হয়, আমাদের দেশেই বানানো হত। এখন কতটা বানানো হয় সন্দেহ আছে, কারণ চিন অবিশ্বাস্য কম দামে বস্তাবস্তা API চোখের নিমেষে চালান দিয়ে দিতে পারে। কী দরকার কারখানা চালানোর হ্যাপা বয়ে বেড়ানোর!
 
অনেকে বলবেন কী দরকার বানানোর।ওষুধপত্র ঠিকঠাক পেলেই তো হল?  আমাদের সন্তানরা তো সেলস এবং মার্কেটিংয়ের কাজে যথেষ্ট দুধেভাতে থাকছে…
আগেই বলেছি, বিশেষ করে ওষুধ, টেস্ট ইত্যাদি আমদানি করার বিপক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হল আমদানি ও পরিবহণজনিত বিলম্বের কারণে গুণমান নষ্ট হয়ে যাওয়া। হামেশাই হয় এবং হচ্ছে, যেটা অনুচ্চারিত সত্য। পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হওয়ার ফল আমরা ভোগ করছি কোভিডের প্রথমদিকে, যখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধ ছিল। তারপরে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দোরে কড়া নাড়ে...
  
 
(ড: সুস্মিতা ঘোষ ডায়াগনোরাইট-এরপ্রতিষ্ঠাত্রী এবং জৈব-রসায়নবিদ। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের প্রাক্তন পোস্ট ডক্টরাল ফেলো। সুস্মিতার ডায়াগনোরাইট একটি সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত স্টার্ট-আপ সংস্থা, যার লক্ষ্য সকলের জন্য সুলভে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ডায়গনস্টিক্স)
 


New
আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা কি অ্যালোপ্যাথদের সমান?
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের


Other Writings by -সুস্মিতা ঘোষ | 04-03-2022

// Event for pushed the video