উনবিংশ শতক জুড়ে তখন অবিভক্ত বাংলার জেলায় জেলায় গ্রন্থাগার স্থাপিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে 1836 সালে কলকাতায় ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি (Calcutta Public Library) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত স্থানীয় গ্রন্থাগারগুলির মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে এবং গ্রন্থাগার আন্দোলনকে আরও ত্বরান্বিত করতে 1924 সালে বেলগাঁওতে ‘সর্বভারতীয় পাবলিক লাইব্রেরি কনফারেন্স’ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের (Chittaranjan Das) সভাপতিত্বে এই মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, দেশের প্রতিটি প্রদেশে (এখনকার রাজ্যের সমতুল) একটি করে গ্রন্থাগার পরিষদ বা লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলা হবে। এরই ফলশ্রুতিতে 1925 সালের 20 ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে All Bengal Library Association প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই বিশেষ দিনটিকে স্মরণে রাখতে প্রতি বছর 20 ডিসেম্বর তারিখটি রাজ্যে গ্রন্থাগার দিবস হিসাবে পালন করা হয়। মহামারীর প্রাবল্য যখন আগের তুলনায় অনেক কম, স্কুল-কলেজ, দৈনন্দিন কাজকর্ম যখন ক্রমশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে, তখন রাজ্যের লাইব্রেরিগুলির হালহকিকত কী? তা-ই একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছিল 4thPillar WeThePeople। ঝাঁকিদর্শনে অবশ্য নৈরাশ্যের ছবিটাই বেশি ধরা দিল।
কোভিডের প্রকোপ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় বিধিনিষেধ শিথিল করে দেওয়া হলেও, লাইব্রেরি সপ্তাহে 6 দিনের পরিবর্তে 3 দিন খুলছে— সোম, বুধ ও শুক্রবার। এতে গ্রন্থানুরাগী, অনুসন্ধিৎসু পাঠক যেমন দৈনন্দিন বই পড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনই গবেষক কিংবা উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যথেষ্ট পরিমাণে বই ও অন্যান্য নথিপথ ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তা ছাড়া মহামারীকালের অনেক আগে থেকেই তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ আর আগের মতো লাইব্রেরি-মুখো হচ্ছে না, তারা তাদের অবসর কাটানোর ভিন্ন ভিন্ন উপায় খুঁজে নিয়েছে।
ভুবনায়নের দুর্বার স্রোত, সহজলভ্য ইন্টারনেটের মায়াময় জগত, সিলেবাস-কেন্দ্রিক পড়াশোনা আর সরকারের দায়সারা মনোভাবই কি এখনকার প্রজন্মের কাছে লাইব্রেরিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারছে না? বঙ্গীয় লাইব্রেরি পরিষদ (Bengal Library Association)-এর সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণপ্রিয় মজুমদার বলছিলেন, সরকারি তরফে উদ্যোগ যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও, বইয়ের প্রতি আসক্তি বা টান তৈরি না হওয়ার দরুন আজকালকার ছেলেমেয়েরা লাইব্রেরিতে আসছে না। সরকার, লাইব্রেরির পরিচালন সমিতির উদ্যোগের কথা জানাতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘‘জেলায় জেলায় যে অজস্র বইমেলা হচ্ছে, সেখান থেকে বিপুল অঙ্কের বই কিনছে জেলার লাইব্রেরিগুলো। তাই বই কেনার জন্য ব্যয়বরাদ্দ কমে গিয়েছে, এমনটাও বলা যাবে না।’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগের ভূতপূর্ব প্রধান, প্রফেসর অমিতাভ চ্যাটার্জির বক্তব্য খানিক সমন্বয়ী। তাঁর মতে, লাইব্রেরিকে বাঁচাতে সরকারকে যেমন উদ্যোগী হতে হবে, তেমনই পাঠকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তাঁর আক্ষেপ, ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন আর টেলিভিশনের চক্রব্যূহে পড়ে অভিভাবকেরা সন্তানদের কাছে বই পড়ার প্রয়োজনীয়তার দিকটা তুলে ধরতে পারছেন না। যে কোনও বিষয়ে নির্ভুল, অভ্রান্ত ও বিস্তারিত তথ্য পেতে যে বইয়ের বিকল্প নেই, তা আজকের প্রজন্ম বুঝছে না বলে আক্ষেপ তাঁর।
উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ গ্রন্থাগারের প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক স্বাগতা দাশ মুখার্জি অবশ্য এই বিষয়ে সরকারী ঔদাসীন্যকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, সরকার লাইব্রেরিগুলির সম্প্রসারণ ও উন্নতি চায় না। লাইব্রেরি থাকুক, মুক্তচিন্তা থাকুক— সরকার এমনটা চায় না বলেই তাঁর মত। বক্তব্যের স্বপক্ষে তিনি জানালেন, রাজ্যের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে প্রায় 4000 পদ ফাঁকা থাকলেও বহু বছর ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। তাই, বহু গ্রন্থাগারিককে একইসঙ্গে একাধিক লাইব্রেরি সামলাতে হয়। তাঁর সংযোজন, শহরের মুষ্টিমেয় কিছু লাইব্রেরিতে অল্প কিছু গবেষণা-গ্রন্থ থাকলেও, গ্রামীণ গ্রন্থাগারগুলিতে কিছু মনোরঞ্জক গ্রন্থ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না।
প্রায় অনুরূপ মন্তব্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রাক্তন সম্পাদক শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর কথায়, নয়ের দশকে বাম সরকারের আমল থেকেই রাজ্যে নতুন কোনও গ্রন্থাগারকে সরকারের তরফে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তাঁর আক্ষেপ, যে টাকা পুস্তক কেনায় ব্যয় করা যেত, তা উৎসব-মেলায় ব্যয় করা হচ্ছে। শক্তিসাধনবাবু রাজ্যে লাইব্রেরি-সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেন।
তবে কি মানুষ সত্যিই বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? ইন্টারনেটের অমোঘ আকর্ষণ কি মানুষকে গ্রন্থবিমুখ করে তুলছে? পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের সম্পাদক, অগ্রণী পুস্তক প্রকাশক সংস্থার কর্ণধার ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের মত অবশ্য একটু স্বতন্ত্র। তাঁর কথায়: ‘‘বিগত কয়েক বছরে ব্যক্তিগত ভাবে মানুষ বই বেশি কিনেছে, কিন্তু লাইব্রেরিগুলি বই কম কিনেছে। তাই সব মিলিয়ে বই বিক্রি খুব বেশি কমেনি।’’
আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘ব্যক্তির অবশ্যকরণীয় একটি কাজ হল, লোকালয়ে অবস্থিত লাইব্রেরির সঠিক অবস্থানটি জেনে নেওয়া।’ নৈরাশ্যের মাঝে আশার কথা এই যে, সংখ্যাতত্ত্ব বলছে, মানুষ বই পড়ছে, অন্তত বই বিক্রি কমছে না। কিন্তু লাইব্রেরির গুরুত্ব তাতে কমে না। দুষ্প্রাপ্য বিভিন্ন বই পেতে, মুক্তচিন্তা, জ্ঞানের আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের গুরুত্ব এই একবিংশ শতকেও এক ছটাক কমেনি। কিন্তু এই গ্রন্থাগার রক্ষায় পাঠক থেকে সরকার, কারও কি কোনও দায় থাকবে না? পানীয় জল, স্বাস্থ্য কিংবা শিল্পের মতো গ্রন্থাগারের পরিষেবা প্রদানের নিরিখে কোনও একদিন সরকার বদলে যাবে না?