4thPillar


রবীন মণ্ডল: প্রথাভাঙা শিল্পের এক অনন্য কাণ্ডারী

মৌনী মন্ডল | 03-07-2020June 22, 2023
রবীন মণ্ডল: প্রথাভাঙা শিল্পের এক অনন্য কাণ্ডারী

রবীন মণ্ডলের ছবিতে ‘ফর্মাল-অ্যাসেসমেন্ট’ ছিল না: হিরণ মিত্র 

 

 আমৃত্যু মাথা নত করে কাজের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে যেতে হবে, এই বিশ্বাসের প্রতি নিজেকে আজীবন নিয়োজিত রেখেই  2019 সালে  3 জুলাই  91 বছর বয়সে প্রয়াত হন এশিয়ান কিউবিজমের অন্যতম সেরা চিত্রকর তথা প্রথাভাঙা শিল্পের এক অনন্য কাণ্ডারী রবীন মণ্ডল।

একজন শিল্পীকে বোঝেন আর একজন শিল্পীই। “অসম্ভব ভাল মানুষ ছিলেন রবীন দা। মাটির মানুষ। রবীনদাকে তাঁর কনটেম্পোরারি লোকেরা তেমন গুরুত্ব দেয়নি কখনও। আসলে যেটাকে ওরা শিক্ষা বলে মনে করে, রবীনদার সেরকম কোনও শিক্ষা ছিল না বলেই ওরা ভাবত। ছবি তো কেউ বোঝে না, খালি অন্যান্য জিনিস নিয়ে মাতব্বরি করে। আমাদের এখানে ‘ফর্মাল-অ্যাসেসমেন্ট’ বলে একটা বোকা বোকা জিনিস রয়েছে, তা-ই অন্যান্য শিল্পীদের মতো রবীনদাকে নিয়ে কেউ অত প্রচার-টচার করেনি, তা নিয়ে অবশ্য ওঁর মনে কোনও ক্ষোভ-টোভ ছিল না। নিজের মনে কাজ নিয়েই থাকতেন। যেভাবে রবীনদা ছবি নিয়ে, শিল্প নিয়ে কথা বলতেন, ওরকম স্বীকারোক্তি কারও নেই। আত্মীয়ের মতো ছিলেন। আমাদের ভীষণ ভালবাসার, শ্রদ্ধার, কাছের মানুষ ছিলেন রবীনদা।”(রবীন-স্মরণে হিরণ মিত্র)

সুন্দর নয়, ‘খ্যাঁচামার্কা’ ছবি আঁকতেই ভালবাসতেন। রেম্ব্রান্ট-কে আদর্শ ভাবতেন, বন্ধু ভাবতেন আর ভালোবাসতেন পিকাসো, মাতিস, রামকিঙ্কর, গনেশ হালুই-এর কাজ। শুধু ভারত নয়, নানা দেশেই তাঁর ছবি-ভাবনা পৌঁছেছিল।

""রবীন মণ্ডল, গনেশ হালুই, গনেশ পাইন, বিজন চৌধুরি, পরিতোষ সেন...এনাদেরকে দেখেই তো আমি বড় হয়েছি। একদম ছোট বয়স থেকেই, আর্ট কলেজে পড়ার সময় থেকেই তাঁদের প্রতি বিপুল আকর্ষণ ছিল, ভাবতেও পারিনি তাঁদের সান্নিধ্য পাব কখনও। রবীনদার সঙ্গে বিভিন্ন আর্ট ক্যাম্পে গেছি, তখন একটা জিনিস দেখেছি, রবীনদার যা এনার্জি লেভেল ছিল- আমরা হার মেনে যেতাম। সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছবি রবীন মণ্ডল এঁকে গিয়েছেন। যখন ভারতবর্ষের একটা ‘গ্রুপ অফ আর্টিস্ট’ ‘সুন্দর সুন্দর’ ছবি আঁকতে শুরু করেছিল, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে রবীনদা স্রোতের বিপরীতে সমস্ত ছবি একের পর এক এঁকে গিয়েছেন। বিভিন্ন মুখ, চেনা অথচ অচেনা এবং দৈনন্দিন দিনে প্রতিফলিত হচ্ছে সেই সব মুখ, তা নিয়ে একটা সময় রবীনদা কাজ করা শুরু করেছিলেন। সেই কাজগুলোই এমন পর্যায়ে যায় যে, সারা বিশ্বে তা সমাদৃত  হয়। প্রখর শক্তিশালী একজন শিল্পী এছাড়া একজন দারুণ মানুষ ছিলেন রবীনদা। আমরা, সমমনস্ক মানুষরা যখন মন খুলে আড্ডায় বসি, তখন কে বড়, কে ছোট সে সব মাথায় থাকে না, তখন সকলেই বন্ধু। রবীনদাকে আমরা সেভাবেই পেয়েছি। চিরকাল মনে রাখব রবীনদাকে। চিত্র শিল্পের ক্ষেত্রে তাঁর না থাকাটা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের ক্ষতি। আমি মনে করি, উনি যা দিয়ে গিয়েছেন, অর্থাৎ ওঁনার কাজগুলো মিউজিয়ামে সংরক্ষণের প্রয়োজন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এখনও অবধি যে কোনও কারণে পশ্চিমবাংলায় সেই ধরনের কোনও মিউজিয়াম গড়ে তুলতে পারেনি কোনও সরকারই। এই কাজগুলো যত্ন করে রাখা হলে তবেই তো ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছাবে।'' (রবীন-স্মরণে সমীর আইচ)  


1929 সালে হাওড়ার এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম রবীন মণ্ডলের। পড়েছেন ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে। 1968 সালে সাত-আট জন বন্ধু মিলে দিল্লির আইফ্যাক্স গ্যালারিতে ছবির প্রদর্শনী করেন, পরে উৎসাহিত হয়ে তৈরী করেন ‘ক্যালকাটা পেন্টার্স’। 1979 থেকে 1982 পর্যন্ত ললিত কলা আকাডেমির সদস্য ছিলেন। পুরস্কৃত হয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ পুরস্কারে। 2018, 30 জুন প্রকাশিত এক পত্রিকা (পরবাস)-এর সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবি নিয়ে বলা খুব শক্ত। কে কী ফিলিংস নিয়ে করছে জানি না। ওরা বলেন এর মধ্যে দুঃখ আছে, হাসি-কান্না সবই আছে। একটা লোক ছবি দেখে একটা ইমপ্রেশন নিয়ে যায়। সে যোগ-বিয়োগ করে বলবে এটা দুঃখের ব্যাপার, কি আনন্দের ব্যাপার অত কিছুর দরকার নেই। ছবি দেখে যদি সে পেয়ে যায়, তাহলে ঠিক আছে। তা নাহলে তারা বলে এ রঙ নিয়ে খেলা করেছে ভাল। যেমন জ্যাকসন পোলক। জ্যাকসন পোলকের যন্ত্রণাটা আমরা যারা ছবি আঁকি তারা বুঝতে পারি, কত যন্ত্রণার মধ্যে সে ছবিগুলো করেছে। অন্যের কাছে ওগুলো অ্যাবস্ট্রাকট পেন্টিং, কী করছে কিছুই বুঝতে পারছি না।‘


তাঁর কাজের যে সময়কাল, সেখানে যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের যে চরম মানবিক বিপর্যয়, তিনি তা চাক্ষুষ করেছিলেন ব্যক্তিজীবনে-শিল্পজীবনে; তার ছবিকে সেই চিন্তন প্রভাবিত করেছিল। 


ভবিষৎ নয়, ‘আর্ট’-এর ক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটাই সাম্প্রতিক, এমনটাই ভাবতেন। প্রতি কালেই এটা হয়ে এসেছে যে, যারা আর্ট বোঝেন তারা সেটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, যারা বোঝেন না তারা দেননি, এই ঘোর সত্যিও তিনি স্বীকার করেছেন। চাইতেন বিশাল বিশাল ছবি তৈরী করতে। দেশের শিল্প সংক্রান্ত অর্থনৈতিক তথা মানসিক মন্দা তাঁর মতো সত্যিকারের শিল্পীসত্তাকেও ব্যথিত করেছিল। এক দশকেরও বেশি সময় বাড়িতে থাকতেন একা-একা। সঙ্গী ছিল ছবি, বই আর এক সহকারী। আজীবনের রং-রেখার তাড়না নিয়ে এভাবেই চলে গিয়েছেন শিল্পী রবীন মণ্ডল। 

 


New
আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা কি অ্যালোপ্যাথদের সমান?
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের


Other Writings by -মৌনী মন্ডল | 03-07-2020

// Event for pushed the video