4thPillar


‘এক প্যাকেট নিয়ে যান না দাদা, নিজেরা আলু মেখে খাবেন, কিচ্ছু হবে না’

মৌনী মন্ডল | 12-05-2020June 22, 2023
‘এক প্যাকেট নিয়ে যান না দাদা, নিজেরা আলু মেখে খাবেন, কিচ্ছু হবে না’


টক ফুচকা, মিষ্টি ফুচকা, দই ফুচকা, বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকা, হেদুয়ার ফুচকা... হরেক ফুচকার নাম শুনে জিভের সমস্ত জল বেরিয়ে প্লাবন আনলেও কিচ্ছু করার নেই এখন। কারণ করোনা জাগ্রত দ্বারে। ফুচকার সঙ্গে কোনও কালেই হাইজিন-এর কোনও সম্পর্ক ছিল না। ছিল মোহ। শত কুৎসা সত্ত্বেও আবালবৃদ্ধবনিতা কেউই এড়াতে পারেন না ফুচকার মুখরোচক মোহ। অত সহজে কি মোহ যায়? লকডাউনে সোশাল মিডিয়ায় দেখা গিয়েছে অনেকেই সেই মোহের টানে বাড়িতে ফুচকা বানিয়ে ছবি পোস্টেছেন। কিন্তু, যাঁরা কারিগর, যাঁদের ঝাঁকা বা ঠ্যালার আশেপাশে গিজগিজ করত রসনা-লোলুপ মুখ, যাঁরা এতদিন টক-ঝাল-মিষ্টির ভিন্ন কেমিষ্ট্রিতে ‘যেমন চাইবে তেমন’ স্বর্গীয় স্বাদ তুলে দিতেন পাতে, তাঁদের কী হল?

 

16 টা 20...মুচমুচে... তেঁতুল মশলা ফ্রি... ফুচকা নেবে ফুচকা... আওয়াজ শুনে তাড়াহুড়ো করে বাইরে গিয়ে দেখি একটি এগারো-বারো বছরের ছেলে ভ্যানে প্যাকেটবন্দি ফুচকা ফেরি করতে বেরিয়েছে। দুই মহিলা ছেলেটিকে দাঁড় করিয়ে দরদাম করছেন। তাঁরা বলছেন, 16 টা নয়, 20 টাকায় 20 টা দিলে নেব। ছেলেটি মাথা নিচু করে ভ্যানের সিটে নখের আঁচড় কাটতে কাটতে বলে, হবে না। ‘না’ শুনে দুই মহিলার একজন অন্যজনকে বলেন, ‘নাতনিটা এত ফুচকা খেতে ভালবাসে, এখনও ভাল করে কথা বলতে শেখেনি, মাঝেমধ্যেই বলে- দিদুন ফুক্কা’। আগে দশ টাকায় ক’টা পাওয়া যেত আর এখন 20 টাকায় প্যাকেটে ক’টা মিলছে, রীতিমত চুলচেরা হিসেব কষে নাতনির জন্য এক প্যাকেট ফুচকা কিনলেন সেই মহিলা।


আমি দাঁড়িয়ে এ সব দেখছিলাম। এরমধ্যে পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোক এসে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এর আগে কিনেছেন?

-না। লকডাউনের পর এই প্রথম এ ভাবে ফুচকা বেচতে দেখছি।

আমার উত্তর শুনে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমিও এই প্রথম। ইদানিং দোকানে অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে দেখছি এরকম প্যাকেট- ফুচকা। তারপর সরাসরি ফুচকাওয়ালা ছেলেটির কাছে জানতে চাইলেন, ‘ফুচকা বানানোর আগে হাত ধুস তোরা?’

ছেলেটি থতমত খেয়ে কী বলবে বুঝে উঠতে না পেরে বলে ওঠে, আমি দিনেশনগর ফুচকাপট্টি থেকে এসছি, ওখানে সবাই ফুচকা বানায়।

ভদ্রলোক মাস্কের আড়ালে হো হো করে হেসে উঠে বললেন, দে দেখি এক প্যাকেট। (আমার দিকে তাকিয়ে) বুঝলেন এ যা দেখতে পাচ্ছি, এমনিও মরব, ওমনিও মরব। এইটুকু ছেলে কষ্ট করে বেচতে বেরিয়েছে... ওদেরও তো বাঁচতে হবে, তাই না!

সকাল থেকেই রোদের ঝাঁঝটা একটু বেশি ছিল। ভ্যানে দেখলাম দু’ধরনের ফুচকার প্যাকেট রাখা। কিছু প্যাকেট সুন্দর করে প্যাকড, কিছু আবার সাধারণ পলিথিনে গিট বাঁধা। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, দু’রকম প্যাকেট কেন রে? বেশি-কমের ব্যাপার আছে না কি?

-না না। এইগুলো (সুন্দর করে প্যাকড করা গুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে) দোকানে দোকানে সাপ্লাই দিতে হচ্ছে। সব একই। যেটা খুশি নিতে পার।

একটা প্যাকেট তুলে নিয়ে জানতে চাইলাম, বাড়িতে কে ফুচকা বেচে?

-বাবা।

তাহলে তুই বেরিয়েছিস কেন?

-বাবা ফুচকা নিয়ে অন্যদিকে বেরিয়েছে।

ছেলেটি বলেছিল ও দিনেশনগর ফুচকাপট্টি থেকে এসেছে। আমি জায়গাটার নাম আগে কখনও শুনিনি। চিনিও না। বললাম, দিনেশনগরটা কোথায় রে?

-দিনেশনগর চেন না দিদি! অনেক দূর।

কতদূর?

-অনেক দূর। দু’ ঘন্টা টানা ভ্যান চালিয়ে এসেছি।


লকডাউনের আগে আমার এলাকায় যাঁরা ফুচকা বেচতেন, যাঁদের দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে ধনেপাতা- লেবুর গন্ধ ‘আয় আয়’ বলে ডাকত, যাঁদের হাতের ফুচকা না খেলে অনেকেরই বিকেল বা সন্ধ্যেটা হজম হত না, সম্প্রতি তাঁদেরকে দেখছি আবার ফুচকা নিয়ে বসছেন। বিকেলের বদলে সকালে। চেনা জায়গাতেই। কিন্তু এইভাবে-


তাঁদের আর কেউ বলছে না, ‘ঝালটা একটু বেশি দিও’, ‘আলুটা ঠিকমতো মাখা হয়নি’, ‘টকের পরিমানটা একটু বেশি হবে’, ‘আমাকে মিষ্টি চাটনি দিও’, ‘কী গো! ফাউ দিলে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁরা প্রত্যেকেই ‘অনেক দূর’ থেকে আসেন। কেউ প্যাকেট করা ফুচকা লোকসানে ফেরি করছেন, কেউ হতভাগ্যের মতো রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকছেন। প্রায় ফাঁকা রাস্তাঘাটে যখনই কোনও মানুষ দেখছেন, এক প্যাকেট ফুচকা নিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে নীচু স্বরে বলছেন, ‘এক প্যাকেট নিয়ে যান না দাদা, সব মশলা দেওয়া আছে, নিজেরা আলু মেখে খাবেন, কিচ্ছু হবে না’।

  


New
আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা কি অ্যালোপ্যাথদের সমান?
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের


Other Writings by -মৌনী মন্ডল | 12-05-2020

// Event for pushed the video