"তুমি কি করতে এখানে এলে, এ তো সব করে ফেলেছো। আর কি শিখবে?'... শান্তিনিকেতনে কলাভবনের ছাত্র হওয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত-অজ গাঁয়ের দীনহীন একটি ছেলে 1925 সাল নাগাদ তার আঁকা কয়েকটি ছবি সঙ্গে নিয়ে যখন সেখানকার এক দিকপাল মাস্টারমশাইকে দেখাচ্ছে, সেই সময় মাস্টারমশাই সেই ছেলেটির হাতের কাজ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাকে বলেছেন এ কথা। মাস্টারমশাইয়ের চোখ বলে কথা, তিনি সেদিনই অন্তর্দৃষ্টিতে বুঝেছিলেন এ ছেলে নিশ্চয়ই একদিন হয়ে উঠবে আপামর বাংলা, সমগ্র দেশ তথা গোটা বিশ্বের অনন্যতম শিল্প-কারিগর, শিল্প-বাহক। সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিকপাল মাস্টারমশাইটি ছিলেন নন্দলাল বসু এবং ছাত্রটি- রামকিঙ্কর বেইজ।
রামকিঙ্কর লকডাউন দেখে যাননি। তবে তিনি দেখে গিয়েছেন বিশ্বযুদ্ধ, দুঃখ, দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, খরা, বন্যা। তাঁর কাজেও রয়েছে সেসবের প্রতিফলন। যা মূর্ত হয়ে উঠেছে এই সময়ে, শিল্প যেভাবে অমরত্ব পায়।
25 মে ছিল তাঁর জন্মদিন। প্রতি বছরই তাঁর জন্মদিনে দেবভাষা - বই ও শিল্পের আবাস আয়োজন করে রামকিঙ্কর উৎসবের। এ বছর তার অন্যথা হওয়ার কারন, বিশ্বব্যপী মহামারী, তার জেরে লকডাউন এবং সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিঘাত। তবে লকডাউনে মানুষ যেভাবে সোশাল মিডিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, সেইদিকটা পর্যবেক্ষণ করেই দেবভাষা-পরিচালকগণ সিদ্ধান্ত নেন যে, প্রদর্শনী বন্ধ না রেখে তাঁরা ফেসবুক এবং ইউটিউবের মাধ্যমে চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবেন। তাই তাঁরা আয়োজন করেছে একটি অনলাইন প্রদর্শনী – সপ্তরথী। সাত সপ্তাহে সাত জন বিশিষ্ট শিল্পীর ছবি প্রদর্শিত হবে এখানে। ফেসবুকেই প্রকাশিত হচ্ছে প্রদর্শনীর প্রয়োজনীয় আপডেট এবং ছবি দেখার ইউটিউব লিংক। প্রথম সপ্তাহে, অর্থাৎ 25 থেকে 31 মে পর্যন্ত প্রদর্শিত হয়েছে বর্ষীয়ান শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। 1 জুন থেকে প্রদর্শিত হচ্ছে শিল্পী সুজিত দাসের ছবি। এই দু:সময়েও তাঁদের এই উদ্যোগ নি:সন্দেহে অভিনব এবং শিল্প-অনুরাগীদের তেষ্টা নিবারণের সহায়ক হয়ে উঠেছে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মন ছিল না তাঁর, শুধু সুযোগ খুঁজতেন আর ভালবাসতেন একাগ্র হয়ে ছবি আর ভাস্কর্য গড়তে। তাঁর ছবি-ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি এমনটা নয়, যেমনটা আমরা দেখেছি গ্যালিলিও, সক্রেটিস, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ভ্যান গখ, পল গগ্যাঁ, স্ক্রিমিনস্কি -বিশ্ববিখ্যাত এ সমস্ত শিল্পীদের শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেও। বিষয়কে খুঁটিয়ে দেখে নাড়িয়ে চাড়িয়ে তা অভাবনীয় ভাবে পেশ করা শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে এবং সময়ের বাঁধাধরা নির্মিত নিয়মকে ভাঙাই হল শিল্পীদের কাজ, তাঁদের মতো অসংখ্য শিল্পীই তা করেছিলেন, করে চলেছেন এবং বলাই বাহুল্য 'বিতর্কিত' বলে উল্লেখিত-অবহেলিত হয়েছিলেন, এখনও হন; রামকিঙ্কর ছিলেন সেরকমই এক শিল্পী, সুদূর পথের অভিযাত্রী। সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল তাঁর নিজস্ব ধ্যানধারনা। রামকিঙ্করের স্বগোক্তিতে উঠে এসেছে, ‘বন্ধুগণ, আমি একজন অতি সংকীর্ণ অথচ বিরাট পথের মুক্তিপথিক। সাধনা ছাড়া এ শিল্পের পথে চলা অসম্ভব। প্রায় সকল সাধনার পথ একই, যদিও সাধনার পথই বিরুদ্ধশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ একটি ছদ্মবেশী কুহেলিকা স্বাধীন মানসিকতাকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা করে। তাদের হাত থেকে বাঁচবার চেষ্টায় একটি নিরন্তর দুর্ভাবনা থাকে......লীলায়িত প্রাণ উৎসের পাশে ছন্দোবদ্ধ কাঠামোর জন্ম মৃত্যুর খেলা কী সুন্দর! দেখতে দাও। কী আঁকব? মূর্তের কী গড়ব? তবু ছাড়বে না পাগলের প্রলাপের মতন।'