বর্ষণমুখর বিকেলে বর্ষার সঙ্গে ভাব বিনিময় হচ্ছিল। বর্ষার রূপকে দেখে মনে হচ্ছিল, তার শৈলী একই সঙ্গে গথিক এবং মিস্টিক। সৃষ্টির কোন আদিকাল থেকে এই উত্তপ্ত মাটিকে সে সিক্ত করেছে, শীতল করেছে। তার সৃষ্টির গোপন পথ ধরে এগিয়ে গেছেন কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ। বরষে বরষে বর্ষা এলেও তার রহস্য উন্মোচিত হয়নি কখনও। সে এখনও আকুল করে, এখনও কাঁদায়। তার শান্ত শীতল বারিপাতে উষ্ণ অশ্রুধারা পথ খুঁজে নেয়। প্রখর গ্রীষ্মে ফুটিফাটা শরীরে টলটলে জল জমে, হাওয়ায় দোলে লাল শালুকের কুঁড়ি। এতেও কত বিরহ আছে। বর্ষা জানে একে ফোটাতে কত বিরহ ব্যথা সইতে হয়।
কদমগুলো অনাদরে পড়ে আছে। সামনের গাছটা ন্যাড়া, টানা বৃষ্টিতে পাতাগুলো পচে গেছে মাটির ভেতরে। সব মিলিয়েও একটা মিষ্টি, স্নিগ্ধ গন্ধ। অবসরে তার ঘ্রাণ নিই। শরীরও তো এমনই। কতবার পচে, গলে, কতবার বেআব্রু হয়ে শুধু অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার সাজিয়ে নেয় নিজেকে। তবুও সে এই বর্ষা, এই গাছ, এই অনাদরে পড়ে থাকা কদমের মতোই পবিত্র, স্নিগ্ধ। শতেকবার কর্ষিত হওয়ার পর তাকে আমরা উর্বরা বলি।
মাটির শরীরে ভাঙন ধরে, বর্ষায় ফুলেফেঁপে ওঠা নদীর করাল গ্রাসে বিলীন হয় যাবতীয় সৌন্দর্য, গর্ব, ঐতিহ্য। বর্ষা আব্রু রক্ষা করে, আবার ক্ষণে ক্ষণে বেআব্রুও করে দেয় কত কিছুকে। উত্তর কলকাতার তস্য গলির পুরনো শ্যাওলা ধরা একটা বাড়িতে ‘খেলা হবে’ দেওয়াল লিখনের পলেস্তরা খসে গিয়ে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ বেরিয়ে পড়ে। পলিক্লিনিক থেকে বেরিয়ে কোনও এক কুন্তী তার অনাকাঙ্ক্ষিত কৌন্তেয়কে পুরসভার ভ্যাটে ফেলে চলে গিয়েছিল। সাফাইকর্মীদের কর্মবিরতিতে ভ্যাট উপচে পড়ে রাস্তার জমা জলে সব ভেসে গেছে। বর্ষাই জানে এই কৌন্তেয় কোনওদিন লক্ষ্যভেদ করতে পারবে কিনা।
পাশের বাড়ির রেডিওতে সূচিত্রা মিত্র কী বলিষ্ঠ ভাবে বাজছেন— ‘বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা।' যে ভাসাচ্ছে, নিঃস্ব করছে, এভাবে তার স্তুতি তো সবাই করতে পারে না। আমরা পারি বলে বেশ একটা গর্ববোধ হয়। সেলুকাস যথার্থই আলেকজান্ডারকে বলছেন, ‘রাজাধিরাজ, এ দেশে বর্ষাকাল না এলে প্রাণীজগতের এই পূর্ণ বিকশিত রূপ আপনি দেখতেই পেতেন না।' ছাতায় মুখ লুকিয়ে যুগলেরা ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে। বড়ুচন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে মনে পড়ে গেল—‘আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন, বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ বান্ধন।' বর্ষা তো এভাবেই বাঁধন ঘোচায়, সে সীমাহীন, স্পর্ধাহীন। মন্দির, মসজিদ, মেথরপাড়া, পতিতালয়, সব জল থইথই। কোন ডাঙাতে যে পা রাখি!
‘পথের পাঁচালী’ সিনেমায় দুর্গা অপুকে নিয়ে ভিজছে, আবহে রবিশংকরের সুরের মূর্ছনা। পুকুরের জলে বৃষ্টির ফোঁটা, শালুকগুলো দুলছে। একটু পরেই দুর্গা জ্বরে ভুগে মরে যাবে, জানি। তবু দৃশ্যটা দেখতে বড় ভাল লাগে, দুর্গা তো আর কোথাও এতটা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। সৃষ্টি আর লয় যেন হাত ধরাধরি করে চলে বর্ষায়। সৃষ্টি যতটা সঙ্গোপনে হয়, ধ্বংস ঠিক ততটাই প্রকট হয়। তবু বর্ষার বল্গাহীন জলে ভাসতে চায় সবাই। ‘হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।' বর্ষার জল হালে শুকিয়ে আসা অলকানন্দার দু'কূল ছাপালে, আরও অকৃপণ হয়ে ভালবাসা যায়, বিরহী সেটা জানে। তখন এই অলকানন্দায় আর মরা শরীর ভাসে না, লাল শালুক ফুল ভাসে।