সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা কেন্দ্রের যুক্তি অনুসারে 1870 সালের সিডিশন আইন অপরিহার্য। এই আইন বজায় রাখার অনভিপ্রেত ফল হল এর অপব্যবহার। সুপ্রিম কোর্টকেই এখন ঠিক করতে হবে, তারা কি এই অপব্যবহার চলতে দেবে নাকি ভবিষ্যতে তা বন্ধ করতে উদ্যোগী হবে।।
অ্যাটর্নি জেনারেল কেকে বেনুগোপাল 5 মে সুপ্রিম কোর্টে বলেছেন যে, সিডিশন আইনের শাস্তিমূলক ধারাগুলি দেশ এবং নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য অত্যাবশ্যক। সিডিশন আইনের প্রয়োজনীয়তা এবং এই আইন না থাকলে দেশ ভেঙে পড়বে বলে মোদী জমানার বিশ্বাসকে সম্প্রতিকালে প্রশ্ন করেছে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি এনভি রমণার বক্তব্য, "এটি একটি ঔপনিবেশিক আইন, যা তৈরি হয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করার জন্য। আর ব্যবহার করা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধী, বাল গঙ্গাধর তিলকদের মতো মানুষদের কন্ঠরোধ করার জন্য।'
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট 2009 সালে করোনার্স এবং জাস্টিস অ্যাক্ট (Coroner's and Justice Act), 2009-এর থেকে 73 নং ধারাটি অপ্রয়োজনীয় বলে বিপুল ভোটে বাদ দিয়ে দেয়। ব্রিটিশ আইনমন্ত্রী ক্লেয়ার ওয়ার্ড বলেন, "সিডিশন (দেশদ্রোহ) এবং দেশদ্রোহমূলক এবং অবমাননামূলক বক্তব্য হল, আদি যুগের অপরাধ। এইগুলো হচ্ছে সেই সময়কার, যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আজকের মতো অধিকার বলে গণ্য করা হত না।'
নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার যদি আইনত অবশ্যমান্য হয়, তবে তার সঙ্গে একইসঙ্গে সিডিশন নামক অপরাধ থাকতে পারে না। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং তখনকার গর্ডন ব্রাউন সরকারের অবস্থানটা ছিল, "এই দেশে এই ধরনের বাতিলযোগ্য আইন থাকাতে যুক্তি হিসাবে ব্যবহার করে অন্য দেশে একই ধরনের আইন বহাল রেখেছে, যেগুলোর সাহায্যে আসলে রাজনৈতিক মতবিরোধ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে দমন করা হচ্ছে।'
সুতরাং, সিডিশন অ্যাক্ট বজায় রাখার পক্ষে মোদী জমানার জোরালো সওয়াল আসলে সক্রিয় ভাবে এই আইনের অপব্যবহার করার পক্ষে সওয়াল, যাতে রাজনৈতিক মতবিরোধ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে দমন করা যায়। এই আইন প্রত্যাহারের পক্ষে যে বিপুলসংখ্যক কেস ফাইল করা হয়েছে, তার থেকেই বোঝা যায় যে, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক, সিভিল লির্বার্টি গ্রুপ এবং নাগরিকরা বিশ্বাস করেন যে, যেভাবে মোদী জমানা এবং বিভিন্ন রাজ্যের শাসকদল গুলো সমালোচনা ও বিরোধী স্বর দমনে এই আইন ব্যবহার করছে, তাতে এটি খারিজের সময় হয়ে গেছে।
সিডিশন অ্যাক্টের অপব্যবহারের সমস্যার সূত্রপাত ঔপনিবেশিক যুগে, যখন এই আইনে বাল গঙ্গাধর তিলকের বিচার হয়েছিল। এই আইন সংক্রান্ত আলোচনায় অপব্যবহার প্রসঙ্গই ক্রমাগত ঘুরে ফিরে এসেছে। 1962 সালের কেদারনাথ সিং বনাম বিহার সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সূত্র ধরেই মোদী প্রশাসন বলছে, সিডিশন আইন হল সুপ্রতিষ্ঠিত আইন। ওই মামলাতেও কিন্তু মূল বিষয় ছিল আইনের অপপ্রয়োগ। গত 60 বছরে সিডিশন অ্যাক্ট নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যত মামলা হয়েছে, তার সমস্তই অপব্যবহার সংক্রান্ত। যে আইন 150 বছর ধরে কেবল অপব্যবহারই হয়ে এসেছে, তা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে কোনও যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
দেশের প্রধান বিচারপতি এনভি রমণা বারবার বলেছেন, কেন এই আইন প্রত্যাহার করা হবে না? তিনি বলেছেন, "সরকার অনেক নতুন নতুন আইন আনছে।' যার মানে হল একই ধরনের কালা কানুন সাম্প্রতিক কালে আরও তৈরি হয়েছে বর্তমান মোদী প্রশাসন এবং তার আগে প্রধানত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন শাসনে।
বেআইনি কার্যকলাপ নিরোধক আইন (UAPA)-কে 2019 সালে মোদী সরকার সংশোধন করেছে। একই বছরে জাতীয় নিরাপত্তা আইন (NIA) তৈরি করা হয়েছে, যাতে শুধু UAPA মামলাই নয়, এছাড়াও 1) মানুষ কেনাবেচা (Human Trafficking), 2) জাল নোটের কারবার, 3) নিষিদ্ধ অস্ত্রের কারবার, 4) সাইবার সন্ত্রাস এবং 5) বিস্ফোরক বস্তু আইন (1908) ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সিডিশন আইনের অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি রমণা বলেছিলেন, "আমরা যদি আইনের এই ধারার ব্যবহারের ইতিহাস দেখি, তাহলে দেখব এতে যেন একটা গাছ কাটার বদলে একজন কাঠুরেকে পুরো বন কাটার ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।' অর্থাৎ আইনের যে প্রভূত অপব্যবহার হয়েছ্ব সে কথাই তিনি বলছেন।
অ্যার্টনি জেনারেল কেকে বেণুগোপাল সুপ্রিম কোর্টে আইনের অপব্যবহার রোধ করতে নির্দেশিকা বেঁধে দেওয়ার কথা বলেছেন। এটা অসম্ভব। এই আইনের অপব্যবহারই প্রায় নিয়ম। 1962 সালে সুপ্রিম কোর্ট যখন এই বিষয়ে প্রথম অভিযোগ শুনেছিল, তখন থেকেই এইরকমই হয়ে এসেছে।
যদি 60 বছরে আইনের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হয়ে থাকে, তবে আইনটাকে খারিজ করাই একমাত্র পথ। সিডিশন আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। ভারতে ইতিমধ্যেই একাধিক আইন আছে, যা 1870 সালের এই আইনের মতোই কঠোর, এমনকি কঠোরতরও। এই আইনে শুধু মাত্র শাসকদলের বিরুদ্ধে আপত্তিকর কথা বলার জন্য জামিন অযোগ্য মামলায় গ্রেফতার এবং অভিযুক্তকে আদালতে না হাজির করে জেলে রাখা ইত্যাদির সংস্থান আছে।
মোদী সরকার যেমন এসব করছে, তেমনই মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরের সরকার শিবসেনা প্রধানের বাড়ি 'মাতোশ্রী'র সামনে হনুমান চাল্লিশা শোনানোর জন্য মহারাষ্ট্রের রানা দম্পতিকে এই আইনে গ্রেফতার করেছে।
সিডিশন আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহারের অজস্র নিদর্শন আছে। নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে একটি নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য কর্ণাটকের একটি স্কুলের বাচ্চাদের এই সিডিশন আইনেই অভিযুক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে!
আরও পড়ুন:কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ধন্দ
ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার, উমার খালিদ এবং অরিন্দম ভট্টাচার্যকে এই আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বর্ষাধিক সময় ধরা চলা কৃষক আন্দোলনে কৃষক নতাদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা রুজু করা হয়েছিল। শুধুমাত্র পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লেখার জন্য 49 জন চলচ্চিত্র নির্মাতা, বুদ্ধিজীবী, অভিনেতা, সঙ্গীতশিল্পীর বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে আছেন অপর্ণা সেন, কঙ্কনা সেন শর্মা, আদুর গোপালকৃষ্ণন, শ্যাম বেনেগাল, মণিরত্নম, শুভা মুদগল, রামচন্দ্র গুহ প্রমুখ দিকপাল ব্যক্তিরা।
স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান, এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কারবিজয়ী গ্রেটা থুনবার্গের বিরুদ্ধেও এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। এমনকি নবনীত কৌর, দিশা রবিদের এই আইনে গ্রেপ্তার করাও হয়েছে।