4thPillar


করোনা মোকাবিলায় রাজ্যে কেন্দ্রীয় টিম বিপজ্জনক প্রবণতা

তপন দাস | 23-04-2020June 15, 2023
করোনা মোকাবিলায় রাজ্যে কেন্দ্রীয় টিম বিপজ্জনক প্রবণতা

করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সমস্যার মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে এক অনাবশ্যক বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় লকডাউন সংক্রান্ত নির্দেশাবলী যথাযথ বলবৎ হচ্ছে না, এই রিপোর্টের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার দুটি টিম পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়েছে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে রাজ্য সরকারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। স্বভাবতই, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই পদক্ষেপকে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী বিবেচনা করেছে। রাজনৈতিক বিতর্কে রাজ্যপালের অংশগ্রহণ বিষয়টি জটিলতর করেছে। 


রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরেও যে প্রশ্ন অনুচ্চারিত থাকল তা হল, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর এই সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত বা আইন সম্মত? কেন্দ্রীয় সরকারের যে আদেশনামায় পর্যবেক্ষক দল গঠিত হল সেখানে বলা হয়েছে যে, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইন 2005 (National Disaster Management Act, 2005) অনুযায়ী গঠিত জাতীয় ব্যবস্থাপক কমিটি (National Executive Committee) দেশ জুড়ে লকডাউন এবং সেই সংক্রান্ত বিধিনিষেধ বলবৎ করে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে। কিন্তু কোনও কোনও জেলায় বিধিনিষেধ যথাযথ পালিত না হওয়ার কারণে বিপদের আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছে। তাই, কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইন, 2005-এর 35 নম্বর ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী পর্যবেক্ষক দল গঠন করেছেন। সুতরাং উল্লেখিত আইনে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার চরিত্র এবং সীমা নির্ণয় প্রয়োজন। বিপর্যয় মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্দেশ্যেই 2005 সালের ডিসেম্বর মাসে এই আইন প্রণয়ন  করা হয়। এই আইনে বিপর্যয়ের সংজ্ঞা নির্ধারিত আছে। এই আইনে বিপর্যয় মোকাবিলা অর্থে বিপর্যয় প্রতিরোধ, প্রশমন এবং বিপর্যয় চলাকালীন বা বিপর্যয়ের আশঙ্কায় উদ্ধার, ত্রাণ বণ্টন, পুণর্বাসন, পুণর্নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ে নিরন্তর ধারাবাহিক এবং সংহত পরিকল্পনাকে বোঝানো হয়েছে। 


এই আইন বলে জাতীয় স্তরে বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন পদাধিকার বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। এছাড়াও আছেন প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত অনধিক নয়জন সদস্য। বিপর্যয় মোকাবিলায় সময়োচিত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ, নীতিনির্ধারণ, পরিকল্পনা এবং প্রয়োগ এদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ বিপর্যয় চলাকালীন কিংবা বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকলে সেটা প্রতিরোধ এবং প্রশমনে এই কর্তৃপক্ষ সমস্ত ব্যবস্থাপনা করবে। এক্ষেত্রে, ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের নয়, আইন ক্ষমতা দিল এক নির্দিষ্ট কতৃপক্ষের হাতে।


এই আইনেই বলা হয়েছে যে, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করবার জন্য জাতীয় স্তরে সচিব পর্যায়ের অফিসাদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ব্যবস্থাপক কমিটি (National Executive Committee) থাকবে। আইনে এই কমিটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কমিটি জাতীয় কর্তৃপক্ষকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে: নীতি প্রণয়ন, প্রয়োগ, পর্যাচলোনা এবং তত্ত্বাবধান করবে। এছাড়াও বিপর্যয় মোকাবিলায় যুক্ত অন্য সমস্ত কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে আদেশ-নির্দেশ অথবা উপদেশ দিতে পারবে এই কমিটি। বিপর্যয় মোকাবিলায় জাতীয় কর্তৃপক্ষের সমস্ত নির্দেশ যথাযথ প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা, সেটা দেখবার দায়িত্ব এই কমিটির। 


এ ছাড়াও এই আইন বলেই প্রতিটি রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ তৈরি হয়েছে। তার সহায়তার প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ধাঁচে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থাপনা কমিটি (Executive Committee) আছে। এই কমিটির অন্য দায়িত্ব ছাড়াও জাতীয় নীতি রূপায়ণ এবং বলবৎ করবার দায়িত্ব আছে। এর নিচে আছে জেলা কর্তৃপক্ষ। জাতীয় নীতি রূপায়ণের ভার এদের উপরেও ন্যস্ত আছে।


এই আইনের সামগ্রিক বিচারে দেখা যায় যে, বিপর্যয় মোকাবিলা বিষয় যা কিছু প্রয়োজনীয়, সেটা রূপায়ণের, প্রয়োগের এবং তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব আইন দ্বারা স্থাপিত কয়েকটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর ন্যস্ত আছে। স্বভাবতই, প্রশ্ন ওঠে তাহলে এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা কতটুকু? এই আইনের 35 নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অন্যান্য ধারা সাপেক্ষে (Subject to the provision of this Act) কেন্দ্রীয় সরকার বিপর্যয় মোকাবিলায় যে কোনও ব্যবস্থা, যা তাদের মতে প্রয়োজনীয়, সেই ব্যবস্থা নিতে পারবেন। 


তাহলে কি এটা বলা যাবে একই বিষয়ে দুটো সংস্থা সমান্তরাল ক্ষমতা প্রয়োগ করবে? আইনের এমন ব্যাখ্যা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। যখন কোনও একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিশেষ সংস্থা স্থাপিত হয়, তখন অন্য কোনও সংস্থার একই বিষয়ে সাধারণত সমান্তরাল ক্ষমতা থাকে না। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা এক্ষেত্রে সহায়ক। ইংরাজিতে যাকে বলে Supplimental। অর্থাৎ বিপর্যয় মোকাবিলায় নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে কাজ করতে অপারগ, কেন্দ্রীয় সরকারকে সেই সমস্ত কাজ করবার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। 35(2) নম্বর ধারায় নির্দিষ্ট কাজের যে তালিকা আছে, সে তালিকা থেকেও এটাই দেখা যাবে। অন্যথায়, পরস্পর বিরোধী পদক্ষেপ গৃহীত হতে পারে। অন্তত সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।


কেন্দ্রীয় সরকার যদি বিপর্যয় মোকাবিলায় সমান্তরাল ক্ষমতার অধিকারী হয়, তবে এই আইনে স্থাপিত সমস্ত কর্তৃপক্ষ এবং কমিটি অর্থহীন আলঙ্কারিক পদে পরিণত হবে। পশ্চিমবঙ্গের কোনও কোনও জেলায় লকডাউন যথাযথ পালিত হচ্ছে না, এই অভিযোগ জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ বা তাদের অধীনস্থ জাতীয় ব্যবস্থাপক কমিটি করেননি। তারা এই বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ প্রস্তাবও করেননি। লকডাউন সংক্রান্ত নির্দেশাবলী যারা ঘোষণা করলেন, বিচ্যুতির খবর তাদের কাছে যায়নি। হটাৎ করে টিম পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন্দ্রীয় সরকার। এক্ষেত্রে, কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত কর্তৃপক্ষ এবং কমিটির ক্ষমতা ছাপিয়ে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন। সবচেয়ে বড় কথা ক্ষমতা থাকলেই ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায় না। ক্ষমতা প্রয়োগের প্রাক শর্ত, এই প্রয়োগ ন্যায়সঙ্গত এবং যুক্তিসঙ্গত কিনা। 


কেন্দ্রীয় সরকারের এই অতি সক্রিয়তা বিশেষত আইন দ্বারা স্থাপিত কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পিছনে এক ভয়ানক অশুভ ইঙ্গিত আছে। এই সর্বগ্রাসী ক্ষমতার আস্ফালনও অন্য এক জাতীয় বিপর্যয়ের ইঙ্গিতবাহী।

 

(লেখক প্রাক্তন বিচারক)


New
আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা কি অ্যালোপ্যাথদের সমান?
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের


Other Writings by -তপন দাস | 23-04-2020

// Event for pushed the video