4thPillar


ভাষার স্বাধীনতা, স্বাধীনতার ভাষা

মৌনী মণ্ডল | 21-02-2020June 13, 2023
ভাষার স্বাধীনতা, স্বাধীনতার ভাষা

ভাষার সৃষ্টি সচেতনে, আবার অবচেতনেও। ভাষা নিয়ে আমরা কখনোই অতিরিক্ত সচেতন থাকি না। ভাষা প্রবহমাণ। সমস্ত কিছুর সঙ্গে ভাষার বিবর্তনও স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে গোঁড়ামি করে 'গেল গেল' রব তুললে ভাষা অচিরেই মাধুর্য হারায়; বর্তমানে বাংলা ভাষা সহ অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা যে সব কারনে বিপন্ন, তার মধ্যে এটি অন্যতম। যে ভাষায় লেখা হয়, বলা হয় বা আকার-ইঙ্গিতে বোঝানো হয়, সে ভাষা-কে হতে হবে আড়ষ্টহীন, প্রানোচ্ছল, জ্ঞাপনযোগ্য, স্বাধীন ও সহিষ্ণু।  

বিভিন্ন জনজাতির নিজেদের মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষাকে রক্ষার্থে ভাষা আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। নোয়াম চমস্কি তাঁর ভাষার উৎপত্তি ও প্রয়োগ বিষয়ক গবেষণায় বলেছেন, প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্কে মাতৃভাষা বা প্রাথমিক ভাষাকে অন্তঃস্থ করার একধরনের বিশেষ ক্ষমতা থাকে।  ভিন্ন ভিন্ন ভাষার প্রয়োজন ও তার ব্যবহার আগেও ছিল, এখনও আছে। সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন ভাষার সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে থাকা ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করা হয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, ক্ষমতায়নের জন্য যেকোনও একটি ভাষাকে নির্বাচন করা হয়।

সেরকমভাবেই সংগঠিত হয়েছিল পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন।  বাংলার পরিবর্তে আরবি অক্ষর ব্যাবহার করার যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা গ্রাহ্য না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে জমায়েত হন। পুলিস তাদের ওপর গুলি চালায়। আবদুস সালাম, রাফিক উদ্দিন আহমেদ, সইফুর রহমান, আবুল বরকত এবং আব্দুল জব্বর সহ আরও অনেকে আহত হন। সরকারের এই ঘৃন্য কাজের প্রতিবাদে ২২ তারিখ প্রায় তিরিশ হাজার মানুষ ঢাকার কার্জন প্রেক্ষাগৃহে একত্রিত হয়। এই প্রতিবাদ মিছিলের ওপরেও পুলিশ গুলি চালায় ও আরো চারজন নিহত হয়। নবাবপুর রোডের একটা মিছিলে পুলিশের গুলিতে সমাজকর্মী সফিয়ুর রহমান ও অহিউল্লা নামের এক নয় বছর বয়সি বালকের মৃত্যু হয়। ২৩ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা মৃতদের স্মরণে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। যা ভাষার জন্য মানুষের আত্মোৎসর্গের প্রতীক। ভাষাআন্দোলন ও ভাষাবৈচিত্রকে সম্মান জানিয়ে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষনা করে।

ভাষা আন্দোলনের পর কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে এসেছে সময়। ভাষার আকার-বিকার, বিস্তৃতি-বিলুপ্তি নিয়ে যথেচ্ছ কাটাছেঁড়ার পরে এখনও মানুষ মনে রাখতে চাইছে ২১ ফেব্রুয়ারি, উদযাপন করতে চাইছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এর প্রয়োজনীয়তা কী?

 

প্রয়োজনীয়তা হল, ভাষার স্বাধীনতা। ভাষাকে স্বীকৃতি, শিরোপা দেওয়ার পাশাপাশি ভাষার স্বাধীনতা নিয়েও নিরন্তর ভাবা দরকার। ভাষার অধিকারের সঙ্গে আমাদের গনতান্ত্রিক অধিকার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে র‍য়েছে। এ কথা অস্বীকার করা যায় না, ভাষা তখনও পরাধীন ছিল, এখনও তাই। খারাপ-ভালো, আমরা-ওরা, দেশ-বিদেশ –এসব থেকে এখনও ভাষাকে মুক্ত করা যায়নি। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, ইঙ্গিত-ইশারা, এমনকি নিস্তব্ধতাও যে একটি প্রকৃত ভাষা সে বিষয়ে সচেতন এবং আন্তরিক হয়ে উঠতে হবে। না হলে, এই শৃঙ্খলযুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে আরও একটা রক্তাক্ত ২১ ফেব্রুয়ারি, যা সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজের অপরিপন্থী। তাছাড়া, মাতৃভাষার জন্য তরুণদের আত্মবলিদান পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের যে কোনও ভাষার মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার। যে কারনে সারা বিশ্বে ২১ শে ফেব্রুয়ারি একটি স্মরণীয় দিন। যে দিনটিকে উল্লেখ করে লেখা হয়েছে:

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

আমার সোনার দেশের রক্ত রাঙানো ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি..

ভাষার এই বৃহত্তর আবেগকে সজীব ও স্মরণীয় করে রাখতে গেলে চেতনাকে উন্মুক্ত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভাষা শুধুমাত্র যোগাযোগের একটি সংকেত নয়; ভাষা আবেগের, ভালোবাসার, স্বাধীনতা উদযাপনের। 


New
আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা কি অ্যালোপ্যাথদের সমান?
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের


Other Writings by -মৌনী মণ্ডল | 21-02-2020

// Event for pushed the video