রমুজ লেবু কলা... ঝিঙে পটল কুমড়ো... রুই কাতলা বোয়াল... এখন প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর অবধি নাগাড়ে এই শব্দগুলোই শোনা যাচ্ছে এলাকায়। কিছু চেনা কিছু অচেনা মুখ ভ্যানে করে বয়ে বেড়াচ্ছে এই শব্দগুলো, বেচার জন্য। করোনার প্রত্যক্ষ প্রকোপ না থাকায় পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবকদের তত্ত্বাবধানে এলাকার দোকান-বাজার এতদিন কম-বেশি খোলাই ছিল। দু’দিন আগে এলাকায় এক করোনা পজিটিভ রোগীর সন্ধান পাওয়ায় সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশি নজরদারিও তুঙ্গে। আমরা এখন কন্টেনমেন্ট জোনের ভিতরে।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে শুনলাম পাশের বাড়ির কাকু কারও উদ্দেশে বলছেন, “এবার বাড়িতে বসেই যা সব্বোনাশ হওয়ার হবে দেখছি! সক্কাল সক্কাল টাকার শ্রাদ্ধ করে একগাদা বাজার করে ফেললাম। কী আর করব! সারাক্ষণ কানের কাছে কোনও না কোনও ফেরিওয়ালা এটা লাগবে, ওটা লাগবে, সেটা লাগবে হাঁক পেড়ে চলেছে। হাঁকডাকের চোটে এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে, মাঝেমধ্যে সব থাকতেও মনে হচ্ছে কিছু নেই। আগে দশটা দোকান ঘুরে দরদাম করে বেছে বেছে বাজার না করলে চলত না, এখন বাড়িতে বসে বেশি দামে অপ্রয়োজনীয় বাজার করে ফেলছি। কী দিনকাল এল! এভাবে কতদিন চলবে জানি না ভাই!”
দু’দিন হল মা আবার পেটের সমস্যায় জর্জরিত। প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালি ঘরে অরুচি থেকে শুরু করে পেট ফাঁপার ইনস্ট্যান্ট রেমেডি ‘পেঁপে- কাঁচকলা- জ্যান্ত মাছ’-এর পথ্য। অন্য সময় হলে, বাজার থেকে জ্যান্ত মাছ কিনে আনতাম। কিন্তু সে পথ এখন বন্ধ। বাড়ির সামনে যাঁরা মাছ বিক্রি করতে আসছেন, তাঁদের কাছে শুধু বড় বড় রুই-কাতলা-বোয়াল। তাই কান খাড়া করে ছিলাম কখন সব্জিওয়ালা আওয়াজ দেবে, একটু কাঁচা পেঁপে আর কাঁচকলা কিনব। সব্জিওয়ালা নয়, জানালার বাইরে শুনতে পেলাম তরমুজ লেবু কলা... মানে, ফলওয়ালা এসেছে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, আমার ফ্ল্যাটেরই তিনতলার জেঠিমা উপর থেকে নেমে এসেছেন ফল কিনতে। এতদিন উপর থেকে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজার করতে দেখেছি জেঠিমাকে, হঠাৎ নীচে নেমে বাজার করছেন দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম। জানালার প্রায় গা ঘেঁষে ফলওয়ালা তাঁর ফলের গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই ওঁদের কথাবার্তা স্পষ্ট কানে আসছিল।
জেঠিমা বলছিলেন, “আমাদের হয়েছে যত জ্বালা... ছেলেমেয়ে কেউ কাছে নেই, বুড়ো-বুড়ির সংসার, তার উপর রোগে জর্জরিত শরীর নিয়ে ওঠানামা করতে হচ্ছে। উপরে বসে বসে কি আর সব হয়? এই তো কালই একজনের থেকে সব্জি কিনলাম, পোকা বেগুন, চারটে পচা আলু দিয়ে গেছে। তাই আজ নিজেই নীচে নেমে এলাম। পয়সা দিয়ে খারাপ জিনিস কিনব কেন? তারপর আগে চেনা লোকদের কাছেই বাজার করতাম- বিশ্বাস ছিল, এখন তো প্রত্যেকদিনই নতুন নতুন লোক আসে। কাকে বিশ্বাস করব? তুমিও দেখছি নতুন।”
কানে এল ফলওয়ালা একটু ইতস্তত হয়ে বলছেন, ‘’ ঠিকই তো মাসিমা। যা দিনকাল পড়েছে। আমি কি আর ভেবেছিলাম, অটো ছেড়ে ফল বেচতে হবে! দু’মাস হল অটোটা পড়ে আছে। সদ্য লোন নিয়ে কেনা অটো। ব্যাঙ্ক থেকে ইএমআই-তে ছাড় দিয়েছে বলে এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। লকডাউন খুললে অটোর ধাক্কা সামলাব কী করে ভাবছি। আমরা তো তবু কিছু একটা করে পেট চালাচ্ছি, আমার এক বন্ধু, সেও অটো চালাত, লকডাউনের পর সাইকেলে মাস্ক ফেরি করে সংসার চালাচ্ছিল। ক’দিন আগে ঘুষঘুষে জ্বর হওয়ায় প্রতিবেশীরা সন্দেহ করে হাসপাতালে যেতে বলে। হাসপাতাল থেকে নর্মাল জ্বর হয়েছে বলে ওষুধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু পাড়ার লোক ভয় পেয়ে তাকে একঘরে করে দিয়েছে, রোজগারের সব রাস্তা বন্ধ। আমরা বন্ধুরা মিলে যতটা পারছি সাহায্য করছি। আশেপাশের ক্লাব থেকে চাল-ডাল-আলু পাচ্ছে মাঝে মাঝে।“
এতকিছু শোনার পর হতভম্ব হয়ে সান্ত্বনার সুরে জেঠিমা বললেন, “জানি না বাবা, চারিদিকে এসব কী অনাসৃষ্টি শুরু হয়েছে! আমায় এক ডজন কাঁঠালি কলা আর অল্প করে আঙুর দাও। তোমার কাছে বেলও আছে দেখছি। একটা দিও। একটু দেখে দিও বাপু, খারপ না বের হয়।”
জেঠিমার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফলওয়ালা বলে ওঠেন, “আমার ফোন নম্বরটা নিয়ে নিন। কিছু খারাপ বের হলে আপনি শুধু ফোন করে দেবেন, আমি পাল্টে দেব, পয়সা লাগবে না। এ লাইনে নতুন, ভাল-মন্দ আমিও বুঝতে শিখিনি। চিন্তা করবেন না মাসিমা, ঠকাব না। এ বাজারে ভাগ্যের কাছে আমরাই তো ঠকে গেছি।”