সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি, ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে।
তুমি সদা যার হৃদে বিরাজ দুখজ্বালা সেই পাসরে—
সব দুখজ্বালা সেই পাসরে।
লকডাউনে গৃহবন্দি থাকার সুবাদে কিছু অলস চিন্তা এসে মনে জাঁকিয়ে বসেছে, কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। অগত্যা, মনের ভার সভার মাঝে নামিয়ে দিয়ে হালকা হওয়ার চেষ্টা। প্রথমেই একটি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ - আলোচ্য বিষয়ে চর্চার যোগ্যতা ও অধিকার, কোনওটাই আমার নেই। শাস্ত্র (বা যে কোনও আলোচ্য বিষয়ে) চর্চার ক্ষেত্রে অধিকারী-অনধিকারী ভেদ চিরায়ত ভারতীয় প্রথা। কিন্তু এই অকালে অনেক কিছুই উল্টে পাল্টে যাচ্ছে, আমিও তাই কিঞ্চিৎ অনধিকার চর্চায় ব্রতী।
পরিচিত বন্ধুমহল জানেন যে সঙ্গীতের জগতে প্রবেশাধিকার থেকে আমি বঞ্চিত। আমার ভূমিকা নিতান্তই শ্রোতার। এই শ্রোতার ভূমিকা পালন করতে গিয়েই মাঝে মধ্যে সংশয়ে ক্লিষ্ট হচ্ছে মন। কীভাবে, তা খুলে বলা যাক। যে গানের কথা দিয়ে শুরু করেছি, তার প্রথম শব্দটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই - সত্য। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গানে, প্রবন্ধে এবং অন্য রচনায় বারবার এই শব্দটির মুখোমুখি হয়েছি আমরা। এই সত্য বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা এখানে ব্যাখ্যা করব না। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আইনস্টাইনের দীর্ঘ আলোচনায় এই সত্য ও তার সংজ্ঞা নিরূপণের বিষয়টিকে দুই ভিন্ন চিন্তাজগতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা হয়েছিল। এ নিয়ে পার্থ ঘোষের সম্পাদনায় একটি চমৎকার প্রবন্ধসংগ্রহ রয়েছে (Einstein, Tagore and the Nature of Reality", Routledge, London 2017)। তাতে নির্মলাংশু মুখোপাধ্যায়ের একটা চমৎকার লেখা আছে। কৌতূহলী পাঠক নেড়েচেড়ে দেখতে পারেন।
রবীন্দ্রনাথের সত্যের স্বরূপ ও তার নানাভাবে প্রকাশের মধ্য থেকে সংশয়ক্লিষ্ট মনে কিছু প্রশ্ন উঠছে বলেএত কথার অবতারণা। এই সব প্রশ্ন উঠছে, কারণ রবীন্দ্রনাথের লেখা গানে সত্যের জয়গান যে ভাবে গুরুত্বপূর্ন স্থান অধিকার করে রয়েছে, তাতে কিছু প্রশ্ন এড়ানো যাচ্ছে না।
তিনি তো বলেই খালাস:
মোরা সত্যের 'পরে মন আজি করিব সমর্পণ
জয় জয় সত্যের জয়।
কিন্তু এই সত্য কি নিখিল বিশ্ব সম্পর্কে কোনও বৈজ্ঞানিকের অনুসন্ধান লব্ধ বস্তুনিষ্ঠ সত্য? নাকি, তিনি যেমন দাবি করেছেন - আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে...। অর্থাৎ, কবির এই সত্য অনেকাংশে একজন দ্রষ্টার সত্য। সংক্ষেপে বলা যাক, আইনস্টাইনের একটা বক্তব্য ছিল, এই যে জাগতিক বিশ্ব, তার অস্তিত্ব মানুষ থাকুক বা না থাকুক, থাকবে। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য, বাহ্যিক জগতের অস্তিত্ব একান্তভাবে দ্রষ্টার উপর (এ ক্ষেত্রে মানুষের উপর) নির্ভরশীল।
আমরা জানি, একদা ব্রাহ্মসমাজের অগ্রগণ্য পুরুষ রবীন্দ্রনাথের মনন উপনিষদের দর্শনচিন্তায় পুষ্ট ও আধুনিক বিশ্বজনীন মানবিকতাবোধে সমৃদ্ধ। তাঁর ঈশ্বরচিন্তায় তাই সম্ভবত বারবার বৈপরীত্যের প্রকাশ ঘটে - একদিকে, ঈশ্বর তাঁর প্রভু, এবং প্রিয়। অন্যদিকে, এই ঈশ্বরকেই তিনি রেনেসাঁ পরবর্তী মানসিকতার ধারক ও বাহক হিসাবে অনায়াসে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন –
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে।
রবীন্দ্রনাথের জন্মের অন্তত ত্রিশ বছর আগে আর এক দ্রষ্টাপুরুষ ধরাধামে অবতীর্ণ হন। রামকৃষ্ণ পরমহংস বেদান্তের ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনার চেষ্টায় উপমা ও রূপকের সাহায্য নেন। অদ্বৈতবেদান্ত চর্চা করলেও অচিরেই তিনি ভক্তিমার্গের যাত্রী হন। রবীন্দ্রনাথের কাছে সত্য যদি অভীষ্ট গন্তব্য হয়, তা হলে রামকৃষ্ণের কাছে সত্য কোনও চূড়ান্ত গন্তব্য নয়। রামকৃষ্ণের সত্য ঈশ্বরের সান্নিধ্যে আসা বা তাকে দর্শন করার পথে অবলম্বন মাত্র। অর্থাৎ, রামকৃষ্ণের এই সত্য আর রবীন্দ্রনাথের সত্য একই অর্থের দ্যোতক নয়। রামকৃষ্ণের কথামৃত ও অন্যান্য বই থেকে জানা যায়, রামকৃষ্ণ নিরাকার ব্রহ্মের (অদ্বৈত বেদান্ত) সাধনা থেকে ভক্তির পথে কালীর পূজক হয়ে ঘোষণা করেন, নিরাকার ও সাকার, একই ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। যে হেতু রামকৃষ্ণ একজন ধর্মপ্রচারক, তাই তাঁর কথায় জ্ঞানমার্গীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রকট (বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রামকৃষ্ণের আলাপচারিতা দ্রষ্টব্য)। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সত্যান্বেষণ থাকলেও তাঁর ধর্মপ্রচারের সেই দায় নেই। বরং তাঁর ঈশ্বর একান্তই ব্যক্তিগত অনুভবের personal God। কিন্তু এই ঈশ্বরচিন্তাও কোনও এক জায়গায় স্থাণু নয়। কখনও সে আমাদের পরিচিত সামন্ততান্ত্রিক সমাজের গোষ্ঠীপতির মতো শাসনকর্তা। তাকে সখা, মিতা বা বন্ধুর মতো পাওয়া যায় না। তিনি একজন patriarch, পিতা। যার কাছে ভালবাসার আবদার চলে না, অনুনয় করতে হয়:
তুমি আমাদের পিতা,
তোমায় পিতা বলে যেন জানি,
তোমায় নত হয়ে যেন মানি,
তুমি কোরো না কোরো না রোষ।
এই ঈশ্বরের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় নাই। কারণ:
তোমা হতে সব সুখ হে পিতা, তোমা
হতে সব ভালো।
কিন্তু এই ঈশ্বরকে সব নিবেদন করে রবীন্দ্রনাথের মন সম্ভবত তৃপ্ত হয়নি। একদা উপনিষদের প্রভাবে প্রভাবিত রবীন্দ্রনাথ – ‘যদি ঝড়ের মেঘের মতো আমি ধাই চঞ্চল-অন্তর/ তবে দয়া করো হে, দয়া করো, দয়া করো ঈশ্বর।।’ লিখলেও তাঁর ঈশ্বরচিন্তা আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল রেখে বিবর্তিত হয়ে চলে। এই আধুনিক ধর্মচিন্তা গড়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে কেন্দ্র করে। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ (বাইবেল থেকে শুরু করে হিন্দুদের পুরাণ) জড় ও জীবজগতের সৃষ্টির যে আখ্যান উপহার দেয়, ডারউইনের মতো একাধিক বিজ্ঞানীর হাত ধরে সমাজ তা বর্জন করার পথে এগোচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জিজ্ঞাসা বিজ্ঞানীদের মতো সৃষ্টি তত্ত্বের ব্যাখ্যায় নয়, উদ্দেশ্য নিয়ে। কোন মহতী উদ্দেশ্য নিয়ে এই জড়জগৎ ও প্রাণীজগতের সৃষ্টি হল? কে করল, তার চাইতে কেন কোন উদ্দেশ্যে করা হল, সেটা তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তোমার কাছে এই মিনতি/ যাবার আগে জানি যেন/ আমায় ডেকেছিল কেন/ আকাশ পানে নয়ন তুলে / শ্যামল বসুমতী।/
কেন নিশার নীরবতা/
শুনিয়েছিল তারার কথা/ পরানে ঢেউ তুলেছিল /
কেন দিনের জ্যোতি।
আর এই প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই খুঁজে পেয়েছেন। সৃষ্টির পিছনে এই মহতী উদ্দেশ্য যাই হোক, তার কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। অন্যভাবে বললে,নিখিল বিশ্ব ঈশ্বরকে ঘিরে নয়, মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। ঈশ্বর এখানে অনুঘটক মাত্র। গোড়ায় আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আলোচনায় সত্য সম্পর্কে কবির দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছিলাম। শুধু মনে করিয়ে দিই, আইনস্টাইনের কাছে বহির্জগতের অস্তিত্ব ব্যক্তিনির্ভর না হলেও রবীন্দ্রনাথের কাছে তা গ্রাহ্য নয়। বরং তাঁর মতে, মানুষের নিরীক্ষণ ও স্বীকৃতি ছাড়া এই বহির্জগতের অস্তিত্ব অপ্রমাণিত। ...আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর...
বীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তায় এই পরিবর্তন একদিক থেকে দেখলে যুগান্তকারী। কারণ, তাঁর ঈশ্বর আর আগের মতো সর্বশক্তিমান, প্রয়োজনে ভক্তের দোষ দেখে রুষ্ট, শাস্তিবিধানের অধিকারী থাকছে না। এখন থেকে তার অস্তিত্ব একান্তভাবে ভক্তজনের উপর নির্ভরশীল। এক কথায়, ঈশ্বর ও তার ভক্তজনের মধ্যে সম্পর্কটা পিতা পুত্রের পরিবর্তনে পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্কে বদলে যায়। তাই ঈশ্বর এখন বন্ধু, সখা ও মিতা। শাসনকারী পিতার আসন থেকে বন্ধুর সমমর্যাদার আসনে নেমে আসার পরে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর আর সর্বশক্তিমান রইলেন না। তাই রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে স্মরণ করিয়ে দেন,
তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভরে
নিশিদিন অনিমেষে দেখছ মোরে
আমি চোখ এই আলোকে মেলব যবে তোমার ওই চেয়ে থাকা সফল হবে।
এই কথাটাই আর এক কবি কিছুটা সাদাসিধেভাবে বলেছেন:
শুনহ মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।