4thPillar


বাপের দায়ে মেয়ের ঘাড়ে খাঁড়া

শিখা মুখার্জি | 21-05-2022June 10, 2023
বাপের দায়ে মেয়ের ঘাড়ে খাঁড়া

কলকাতা হাইকোর্ট মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই নেকড়ে আর মেষশাবকের গল্পটা। জলঘোলা করার জন্য মেষশাবক দোষী সাব্যস্ত হল নেকড়ের বিচারে। বেচারি মেষশাবকের যুক্তি হল, সে তো আছে স্রোতের নিচের দিকে, তাতে উপর দিকে জলঘোলা হবে কী করে? নেকড়ের জবাব ছিল, তাহলে তুই না তোর বাবা নিশ্চয়ই জলঘোলা করেছিল আগে! এই ধরনের বিচার প্রসঙ্গেই 2018 সালে সুপ্রিম কোর্টের তখনকার প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র বলেছিলেন, ""প্রাচীনকে সরিয়ে নতুন ভাবনাকে স্থান দিতেই হবে। স্বাধীনতার পথ মসৃণ করার জন্য সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ঝেড়ে ফেলতে হবে।''

 

কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ, রাজ্যের প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীকে "শিক্ষক হিসেবে গণ্য করা যাবে না'। তাঁর নির্দেশে আরও বলা হয়েছে যে, তিনি যা বেতন পেয়েছেন তা সরকারকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এই নির্দেশের অর্থ একাধারে যে রাজ্য সরকারের তাঁর বাবা মন্ত্রী, সেই সরকারের পাপের জন্য তাঁকে শাস্তি দেওয়া; এবং অন্য হাতে, শ্রমের বিনিময়ে তাঁর মজুরি পাওয়ার মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করা। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র স্বাধীনতার স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ""স্বাধীনতার অধিকারকে ক্রমাগত এবং অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে রক্ষা করতে হবে, যাতে তা ক্রমশ আরও প্রসারিত এবং বিকশিত হতে পারে।'' বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ বিচারপতি মিশ্রের ভাবনার সম্পূর্ন পরিপন্থী

 

প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের ওই নির্দেশের  প্রেক্ষাপট ছিল খাপ পঞ্চায়েত। ওই ধরনের সংবিধান বহির্ভূত এবং স্বঘোষিত সমাজের মাতব্বরদের তৈরি করা সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা বা ক্যাঙারু কোর্টকে তিনি সম্পূর্ন সংবিধান বিরোধী বলে রায় দিয়েছিলেন। যদি হাইকোর্টের মতো উচ্চ আদালতের নির্দেশ গ্রাম্য সালিশি সভার মতো হয়, যেখানে ব্যক্তির অপরাধের জন্য তার পরিবারকে শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে আইনের শাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। ভারতের সংবিধানে মৌলিক নীতি হিসেবে ব্যক্তির দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা এবং আইনের চোখে প্রত্যেকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের অপরাধের জন্য অঙ্কিতা অধিকারীকে দায়ী সাব্যস্ত করা বিস্ময়কর। 

 

একদিকে যখন মামলার বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তখন তার মধ্যেই অঙ্কিতা অধিকারীকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তের কিছুতেই ব্যাখ্যা করা যায় নাএর ফলে ব্যক্তি অঙ্কিতা অধিকারীকে একমাত্র যেন তাঁর বাবার কন্যা হিসেবে দেখা হল, যে বাবার বিরুদ্ধে হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত হচ্ছেএকজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি এবং নাগরিক হিসেবে তাঁর পরিচয় গণ্য করা হল না। এখান থেকে আরও প্রশ্ন ওঠে, পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের অপরাধ কি আইনের চোখে প্রমাণ হয়েছে? এই মামলার রায় কি ঘোষণা হয়েছে? অঙ্কিতা যে নিয়োগ পদ্ধতিতে কারচুপি করেছেন, তা কি সমস্ত সন্দেহের উর্ধ্বে প্রমাণ হয়েছে? সব কয়টি প্রশ্নের উত্তরই হল না। 

 

স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতি নিয়ে কোনও রায় আদালত এখনও দেয়নি অথচ সেই দুর্নীতিরই একটা অংশ বলে যেটাকে বলা হচ্ছে সেই অংশে অঙ্কিতা অপরাধী সাব্যস্ত হলেন এবং তাঁকে বেতন ফেরত দিতে বলা হল। এটা কেমন বিচার হল? সরকারি কাজকর্ম চলে প্রতিষ্ঠিত বিধির ভিত্তিতে। অঙ্কিতার থেকে টাকা সরকার কীভাবে ফেরত নেবে? রুলের বাইরে গিয়ে সরকার কোনও কাজ করতে পারে না। যদি করে তাহলে সিএজি রিপোর্টে তা ধরা পড়বে এবং বিধিভঙ্গ বলা ধরা হবে। 

 

 

দেশের শাসন প্রক্রিয়ার সমস্ত অঙ্গই এই বিধির ভিত্তিতে চলে। বিচার ব্যবস্থাও তাই। অঙ্কিতাকে তাঁর বেতনের টাকা ফেরত দিতে বলার মধ্যে সরকার পরিচালনার বিধি সম্পর্কে গভীর অজ্ঞতার প্রমাণ মেলে। এটা একটা সস্তা চটকদার গিমিকের মতো। যেন সাধারণ মানুষকে খুশি করার জন্য একটা নির্দেশ গণপিটুনির সময়ে জনতার মানসিকতা (mob psychology) ঠিক এভাবেই কাজ করে। এ যেন জনতার আদালতের বিচার। যেরকম টেলিভিশনে হয়ে থাকে। যেখানে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অযৌক্তিক এবং বেআইনি পারফরম্যান্সই প্রাধান্য পায়, আর সভ্য সমাজের সংবিধান সম্মত গণতন্ত্রের পরাজয় ঘটে

 

অঙ্কিতা অধিকারী শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির দায়ে দোষী হতেই পারেন, এবং হলে আইন মোতাবেক শাস্তিও পেতেই পারেন। কিন্তু এখনই তাঁকে যেভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সেটা আর যাই হোক ভারতীয় সংবিধান অনুসারে বিচারব্যবস্থার যেভাবে কাজ করা উচিত, তা নয়।

 


New
পহেলগাম থেকে মুর্শিদাবাদ – এক বিদ্বেষের রাজনীতি
আপনি নিজে কজন মুসলমানকে চেনেন?
নিজবাসভূমে পরভাষী


Other Writings by -শিখা মুখার্জি | 21-05-2022

// Event for pushed the video