প্রধানমন্ত্রী হলেও নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) সবকিছুই নিজের ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যেতে ভালেবাসেন। জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকার মধ্যে সারা বছর যোগাযোগের জন্য 8.45 কিলোমিটার দীর্ঘ বানিহাল-কাজিগুন্দ সুড়ঙ্গ (Banihal Qazigund Tunnel) পথের সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধনই হোক, বা কাশ্মীরের পাল্লি গ্রামের একটি 500 কিলোওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধনই হোক, সবই তাঁর ব্যক্তিগত কৃতিত্ব হিসাবে জাহির করতে ছাড়েন না। সেই সঙ্গে তিনি কাশ্মীরের যুব সমাজকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, আগের তুলনায় তাঁদের এখন থেকে অনেক কম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। কাশ্মীরে গিয়ে মোদীর ঘোষণা, ‘এটা আমি করে দেখাব, আর এই প্রতিশ্রুতি দিতেই আমি তোমাদের কাছে এসেছি।'
প্রধানমন্ত্রী ঠিক কী প্রতিশ্রুতি দিলেন? আর তিনি কোন কোন কাজের ভিত্তিতে এই দাবি করলেন? যে বানিহাল-কাজিগুন্দ সুড়ঙ্গপথের উদ্বোধন করলেন, সেটার কাজ শুরুর জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ তো 2008 সালেই হয়েছিল (তখন তো কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায়)। সেটা এমন একটা সময় যখন এমনকি সংঘ পরিবারও মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য প্রার্থী বলে ভাবেনি। এবারের কাশ্মীর সফরে গিয়ে মোদীর আর আর এক কীর্তি একটি ক্ষুদ্র সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধন, এছাড়া জম্মু ও কাশ্মীরের ‘বঞ্চিত অবহেলিত’ মানুষদের জন্য একগুচ্ছ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন।
মোদীর ভক্তরা তাঁকে সুপারম্যান বলে বিশ্বাস করতে ভালবাসেন। তাঁদের চোখে মোদী এমন একজন নেতা, যিনি ভারতকে বিশ্বের দরবারে এমনভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন, যাতে দেশের সম্মান অনেক বেড়ে গেছে। 2024 সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি (তাঁর দাবি মতো) পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছে যাবে। আর বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলির তালিকায় ভারত পঞ্চম স্থানে উঠে আসবে। এখন ভারত ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠবে, বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তির দেশের প্রধানমন্ত্রীর কি কাশ্মীরে একটা অতিক্ষুদ্র সৌর প্রকল্প, সারা বছর যাতায়াতের উপযোগী সুড়ঙ্গপথ অথবা মহারাষ্ট্রের থানে ও দিবার মধ্যে 1.4 কিলোমিটার রেলপথে বাড়তি দু’টি রেল লাইন যুক্ত করার মতো কাজের উদ্বোধনে সময় নষ্ট করা সাজে? মোদীর এই ধরনের আরও কাজের মধ্যে রয়েছে একটি স্টেডিয়ামের আগের নাম বদলে দিয়ে নিজের নামে করা, গুজরাতের মোরবিতে 108 ফুট উঁচু হনুমান মূর্তির আবরণ উন্মোচন, আমেদাবাদের সর্দার ধামে একটি 2000 শয্যার ছাত্রী নিবাসের উদ্বোধন। এইরকম অজস্র নজির উল্লেখ করা যায়। সন্দেহ নেই, কাশ্মীরের গ্রামে সৌরবিদ্যুৎ পৌঁছনোর মতো অনেক কাজই সাধারণ মানুষের উপকারে আসবে। কিন্তু প্রতিটি জনস্বার্থের প্রকল্পের ভিত্তিস্থাপন বা উদ্বোধন কেন প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হবে? প্রধামন্ত্রীকে কি প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রচারের আলো নিজের দিকে টেনে ধরতে হবে?
আরও একটা প্রশ্ন উঠবে, এইসব তথাকথিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মোদীকে প্রায়শই নানান বেশভূষায় আবির্ভূত হতে দেখা যায় কেন? একজন প্রধানমন্ত্রীর এইরকম দেখানেপনা সাধারণ মানুষের পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তিকর তো বটেই, বিরক্তিকরও বটে। এটা কি শোভন যে, বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের প্রধানমন্ত্রীকে এখনও সড়ক ও কয়েক কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ, মেয়েদের হস্টেল নির্মাণ বা গ্রামে বৈদ্যুতিকীকরণের কাজে জুড়ে থাকতে হবে? এ সব তো হৈচৈ না করে চুপচাপ করে ফেলার কথা, যাতে বিশ্বের নজর এদিকে না পড়ে, তারা যেন এটা না বুঝতে পারে যে, বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি ভারতে সামাজিক, শিল্প পরিকাঠামো ও অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা এখনও যথেষ্ট মজবুত নয়।
যদি ভারত এখনও তার প্রতিটি গ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থা, সারাবছর যাতায়াতের উপযোগী রাস্তা গড়ে তুলতে না পারে, মেয়েদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যায় হস্টেল না তৈরি করে থাকে, শহরতলির নিত্যযাত্রীদের জন্য উপযুক্ত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব থাকে, তাহলে সরকারি অর্থ কোথায় যাচ্ছে? কোনও ভারতীয় এবং বহু দেশের অসংখ্য মানুষ এটা ভুলবে না যে, কী ভাবে করোনা মহামারীর প্রথম ধাক্কার সময় ভারতের আন্তর্জাতিক মানের জাতীয় সড়কগুলিতে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের পদধ্বনি শোনা গিয়েছিল। ওই সব পরিযায়ী শ্রমিকরা সপরিবারে অভুক্ত, তৃষ্ণার্ত ও ক্লান্ত অবস্থায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত অবস্থায় কয়েকশো কিলোমিটার হেঁটে নিজেদের গ্রামে বা গঞ্জে পৌঁছেছিল। পৌঁছতে গিয়ে অনেকে মারাও গিয়েছিল। দেশব্যাপী লকডাউনের গোড়ার দিকে যে শ্রমিক ট্রেনগুলি অন্তত 30 লক্ষ পরিযায়ীকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল, সেগুলিতে এমনভাবে তাদের ঠেসে তোলা হত, যা অভাবনীয়। এমনকি তাদের খাবার দূরে থাক, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পানীয় জলটুকুও দেওয়া হত না। এক কথায় অমানবিক।
নরেন্দ্র মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন যে, এখন থেকে কাশ্মীরের যুব সমাজ আগের তুলনায় আরও ভাল ভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। কিন্তু এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী মোদী দেশের বেকার সমস্যার মোকাবিলায় ব্যর্থ, সরকারি হিসাবেই মোদীর আমলের বেকারত্ব গত 45 বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তিনি এমন একটা সরকারের প্রধানমন্ত্রী, যা কিনা পরপর টানা 12 মাস দেশের মুদ্রাস্ফীতিতে লাগাম পরাতে পারেনি, এখন মুদ্রাস্ফীতির হার 13 শতাংশে পৌঁছে গেছে। মোদীর সরকার পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, সিএনজি (কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস), রাসায়নিক সার, জীবনদায়ী ওষুধের দাম ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। এটা এমন একটা সময়ে করা হচ্ছে যখন দেশের অধিকাংশ মানুষ আর্থিক দূরাবস্থার শিকার হয়ে এমনিতেই দিশাহারা, এবং তা নিয়ে বিশ্বের দরবারেও চর্চা হচ্ছে।
একদিকে ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনে ভারতের অতিসক্রিয় ভূমিকা, অন্যদিকে দেশবাসীর উপর ক্রমাগত আর্থিক চাপ বাড়িয়ে চলা। এই দুই মিলিয়ে মোদীর কৃতকর্ম আগের সব প্রধানমন্ত্রীর কাজের চাইতে অনেক খারাপ, তা মোদী যতই নতুন নতুন সাজে নানা প্রকল্পের উদ্বোধন করুন না কেন!