4thPillar


পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীন

শিখা মুখার্জি | 25-05-2022June 10, 2023
পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীন

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সব কিছু নিয়েই ঝগড়া। বিরোধী দলে থাকলেই যেন সমস্ত ইস্যুতে বিরোধিতা করতেই হবে। এটা দায়িত্বশীল রাজনীতির পরিচয় নয়।

 

সবসময় কিছু ইস্যু এবং কিছু বিষয় এমন থাকে যেগুলোর সঙ্গে রাজ্য এবং রাজ্যবাসীর মৌলিক স্বার্থ জড়িত, তা সে যে দলই সরকারে থাকুক না কেন। পশ্চিমবঙ্গের সব শাসক দলই অভিযোগ করে যে বিরোধীরা হচ্ছে দায়িত্বজ্ঞানহীন ক্ষুদ্র স্বার্থে সব কিছুতেই বাঁধা দেয়, কোনও কিছুতেই সহায়তা করে না। রাজ্যের স্বার্থে ভুলে দায়িত্বশীল আচরণ বিরোধীরা করে না।

 

দেশের আঠাশটি রাজ্য এবং আটটি কেন্দ্রীয় অঞ্চলের সকলেই মোদী সরকারের দু'টি কাজ নিয়ে অখুশি। প্রথমটি হল সরকারি তহবিলের টাকা পেতে দেরি, যে বিলম্বটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আর দ্বিতীয়টা হল কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে পাওয়া অর্থের পরিমাণ এবং রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সাহায্যের পরিমাণ। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আমলে এই কেন্দ্রীয় অর্থ বরাদ্দ নিয়ে রাজ্যগুলোর ক্ষোভ তুঙ্গে পৌঁছেছিল। তার ফলে অ-কংগ্রেসি দলগুলোর সর্বভারতীয় সম্মেলন বা কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল দু'বার কলকাতায়। এরই ফলে ইন্দিরা গান্ধী বাধ্য হয়েছিলেন কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের বিষয়ে পুনর্বিবেচনার জন্য সারকারিয়া কমিশন গঠন করতে। কমিশনের আলোচ্য সূচির মধ্যে ছিল কেন্দ্র রাজ্য সংঘাতের সমস্ত বিষয়গুলি, যেমন কেন্দ্র রাজ্যের মধ্যে সম্পদ বণ্টন, কৃষিপণ্যের মূল্য, এমনকি রাজ্যপালের ভূমিকা।

 

পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত রাজনৈতিক দলই কখনও না কখনও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিমাতৃসুলভ আচরণ করেছে কেন্দ্রের শাসক দল যারাই হোক না কেন। এই বিমাতৃসুলভ কথাটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র। পরবর্তীকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক তাই করছেন।সবসময়ই সমস্ত রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রের থেকে পাওয়া অর্থ পাওয়া নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকে, লক্ষণীয় ভারতের সংবিধানে অর্থ কমিশনের উল্লেখ রয়েছে যার কাজটাই হল এই কেন্দ্র রাজ্যের মধ্যে সম্পদের বণ্টন কী ভাবে হবে তা ঠিক করা। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার এই মৌলিক বিষয়ই হল কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলোর মধ্যে কী ভাবে সম্পদ বণ্টন হবে এবং রাজ্যগুলির সামগ্রিক ভান্ডার থেকে কোন রাজ্য কতটা পাবে। অন্য যে সমস্ত দেশে এই ধরনের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আছে তার সর্বত্রই এই একই চিত্র দেখা যায় যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন।

 

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকারের আর্থিক বিলিব্যবস্থা নিয়ে সিপিএম বিজেপি কংগ্রেস সকলেই মুখর। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন পেট্রল ডিজেল এবং রান্নার গ্যাসের উপর তিনি ভ্যাট কমাবেন না। আর বিরোধীরা সবাই অভিযোগ করেছে শুধু ভোট বাড়ানোর লক্ষ্যে একের পর এক জনবাদী প্রকল্প নিয়ে রাজ্য সরকার ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। আর সরকারি অর্থ তছরুপ করে শাসক দলের নেতারা পুষ্ট হচ্ছে।

 

 

ভারতের ক্ষেত্রে বিরোধী দলের দায়িত্বশীল আচরণের প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে এবং বিহারের তুলনা করলেই বোঝা যায় দু'টি রাজ্যের মধ্যে কতটা ফারাক। কেরালা এবং তামিলনাড়ুতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজ্যের মধ্যে সবসময়ই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কিন্তু রাজ্যের মানুষের স্বার্থে বিশেষ করে কেন্দ্রের থেকে দাবি আদায়ের সময় ওই একই দলগুলো পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতার একটা পরম্পরা গড়ে তুলতে পেরেছে। যেমন পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে জল বণ্টন সমস্যার ক্ষেত্রে চেন্নাই থেকে সর্বদলীয় প্রতিনিধিরা দিল্লি যায়, তখন তারা আর রাজ্যের মধ্যে বিবাদের কথা মাথায় রাখে না।

 

প্রতিবেশী বিহারে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার যেমন তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় জনতা দল এবং এমনকি বিজেপিকেও জাতভিত্তিক জনগণনা (caste census) ইস্যুতে একই ছাতার তলে আনতে পেরেছেন। নরেন্দ্র মোদীর সরকার জাতভিত্তিক জনগণনার প্রতিশ্রুতি পূরণ করুক এই দাবি তোলার জন্য জোট সরকারে নীতীশ কুমারের অবস্থা দুর্বল হতে পারে জেনেও তিনি এটা করেছেন। বিহারে এই রাজনৈতিক একতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, এক বছর আগেই বিজেপি সহ সমস্ত দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে দেখা করে জাতভিত্তিক জনগণনার দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি সঠিক ভাবেই বলেছিলেন যে, একমাত্র সেনসাস থেকেই নিখুঁত ভাবে জাতভিত্তিক জনসংখ্যা জানা সম্ভব। এবং তার থেকেই জাতভিত্তিক বৈষম্য এবং বঞ্চনার অবসান ঘটানোর সরকারি নীতি নির্ধারণ সম্ভব।

 

এই ক্ষুদ্র সংকীর্ণ স্বার্থে রাজনীতির পরম্পরাকে মহৎ করে দেখানোয় পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের মধ্যে ব্যতিক্রম। দায়িত্বশীল বিরোধী হওয়ার চেষ্টা না করে, বিরোধীরা সবসময়ই যেন রাজনৈতিক চাপানউতোরে পয়েন্ট স্কোর করতে ব্যস্ত। আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় এক সময় বিরোধী দলে ছিলেন, তখন ঘূর্ণিঝড় আয়লার পর পুনর্বাসন এবং পুনর্নির্মাণের জন্য কেন্দ্র থেকে যে সাহায্য পাওয়ার কথা তা না দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেছিলেন। তাঁর দিক থেকে যুক্তি ছিল এই যে, স্থানীয় সিপিএম নেতারা ওই টাকা নয়ছয় করবে। তারও বহুদিন আগে স্বাধীনতার ঠিক পরেই বিধান চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে সংঘাত বেধেছিল সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তু জন্য পুনর্বাসনের খরচ বরাদ্দ নিয়ে।

 

বিধানসভায় বিরোধী দলের বিধায়ক সংখ্যা কত সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল বিষয়টা হল রাজ্যের মানুষের স্বার্থে বিরোধী দল কতটা আন্তরিক সেটা। প্রায় সব রাজ্যেই শাসকদলের মতো তৃণমূল কংগ্রেস নেতারাও সরকারি অর্থ গ্রহণ করে বড়লোক হয়। এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও এটা স্বীকার করেন। কিন্তু তার ফলে বিরোধী দল দায়িত্বশীল হবে না এই যুক্তি মানা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে সমস্ত রাজনৈতিক দলেরই একটা দায়িত্ব আছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নিপীড়নমূলক কাজকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। বিহারে যদি সেখানকার বিজেপি নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে গিয়ে জাতভিত্তিক জনগণনার দাবি জানাতে পারে, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলগুলো কেন প্রাপ্য বকেয়া অর্থ আটকে রাখার জন্য কেন্দ্রের উপর একসঙ্গে চাপ সৃষ্টি করতে পারবে না?

 

 তার জন্য বিরোধী দলকে যদি শাসক দলের সঙ্গে কাজ করতে হয় তাতে অসুবিধা কী? একই সঙ্গে বিরোধী দল সরকারের উপর নজরদারি করার কাজটা চালাতেই পারে।


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -শিখা মুখার্জি | 25-05-2022

// Event for pushed the video