পশ্চিমবঙ্গে গত 11 বছর ধরে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস কি এখন রাজনৈতিক দিক থেকে কিছুটা কোনঠাসা? সম্প্রতি দলের দুই হেভিওয়েট নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অনুব্রত মণ্ডল দুর্নীতির দায়ে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট বা ই ডি এবং সি বি আইয়ের হাতে সপার্ষদ গ্রেফতার হওয়ার পর জনমানসে এবং শাসক দলের প্রতিক্রিয়া দেখে কিছুটা সেরকমই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের অনেকের সম্পর্কেই নিয়মিত “কাট মানি” বা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আকাশে বাতাসে ভাসছিল। মাত্র দু’বছর আগে ঘূর্ণিঝড় আমফান সুন্দরবন সহ দক্ষিণবঙ্গের মানুষের ঘরবাড়ি তছনছ করে ক্ষতি করার পরে ত্রাণের টাকা দুর্গতদের না দিয়ে ব্যাপক হারে লুঠ করার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে। সেই সময় শাসক দলেরই একাধিক সাংসদ ও নেতা এই কাট মানি কালচার যে দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিকড় গজিয়েছে, সে কথা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন। সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে সামাল দিতে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও প্রকাশ্যেই কাট মানির নিন্দা করতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু দোষী নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এবার পার্থ এবং অনুব্রত কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে দুর্নীতির দায়ে ধরা পড়ার পরে বোঝাই গেল, দলকে কাট মানি বা তোলাবাজি থেকে মুক্ত করা দূরে থাক, এই দুর্নীতি এখন দলের ওপর তলাতেও পৌঁছে গেছে।
এতদিন সাধারণ গরিব মানুষ নিজেদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা থেকে বুঝছিল যে তাদের জন্য নির্দিষ্ট বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে উপকার পেতে হলে আয়ের একটা অংশ নিয়মিত শাসক দলের নেতা-কর্মীদের হাতে তুলে দিতে হবে। সরকারি চাকরি (যার মধ্যে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি অন্যতম), 100 দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনা থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রকল্পে তাদের প্রাপ্য টাকার একটা অংশ এ ভাবেই তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল। এ ভাবে গরিব মানুষদের ভাতে মেরে শাসক দলের নেতাকর্মীরা যে বেআইনিভাবে বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হচ্ছিল সেটাই এবার সামনে এসে গেছে। এখন আর হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো আলগা অভিযোগ নয়, শাসক দলের নেতাকর্মীরা যে লুঠ করে চলেছে সেটা সাধারণ মানুষও দেখতে পাচ্ছেন। এর ফলে ইতিমধ্যেই সাধারণ মানুষের মনে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে, তার প্রমাণ আদালত চত্বরে বিচারাধীন পার্থ ও অনুব্রতকে দেখে সাধারণ মানুষ “চোর, চোর” রব তুলছেন। কলকাতা ও বিভিন্ন জেলার রাস্তায় এখন বিরোধীরা মিছিল বার করে এই গোটা দুর্নীতির কাণ্ডের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ভাইপো অভিষেকের ঘনিষ্ঠ যোগের অভিযোগ করছেন। এতদিন রাজ্যে বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নানা সময় নানা অভিযোগ তুললেও স্বয়ং মমতা এবং অভিষেকের বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে সাহস পেতেন না। এখন তাঁরা তা করতে পারছেন। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হল, আগে সরকার ও শাসক দলের বিরুদ্ধে এই ধরনের প্রকাশ্য মিছিল করার চেষ্টা হলে রাজ্য পুলিশ এবং দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস তা গায়ের জোরে দমন করত। এখন আর সেটা হচ্ছে না।
এই প্রসঙ্গে বীরভূম জেলার সি পি এম নেতা গৌতম ঘোষের অভিজ্ঞতাটা ইঙ্গিতবাহী। গৌতমবাবু 2018 সালে দলের তরফে পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে তৃণমূলের সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনীর হাতে আক্রান্ত হন এবং গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। সেটা ছিল বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডলের রাজত্বের কাল। তখন পঞ্চায়েত বিরোধীশূন্য করার চেষ্টায় বিরোধীদের নমিনেশন জমা দেওয়া ঠেকাতে রাস্তায় রাস্তায় সশস্ত্র ‘উন্নয়ন’ দাঁড়িয়ে থাকত। জেলায় কোথাও তৃণমূল বিরোধী মিছিল বার করার চেষ্টা করলেই পুলিশ তা বাতিল করত। জেলা সদর সিউড়িতে গিয়ে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কোনও প্রতিনিধিদল গিয়ে দেখা করতে চাইলে দেখা মিলত না। নিচুতলার কোনও কর্মীর কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়ে ফিরে আসতে হত। এবার অনুব্রত গ্রেফতার হওয়ার পরে জেলা বামফ্রন্ট কয়েকটি দাবিদাওয়া নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চায়। এবার কিন্তু চটজলদি উত্তর আসে, বামনেতারা তাঁদের যখন সুবিধা হবে তখনই দেখা করতে আসতে পারেন। জেলা প্রশাসন তাঁদের সময় দিতে প্রস্তুত। বাস্তবিক, অনুব্রতের গ্রেফতারির পরে একের পর এক বিরোধী মিছিল বোলপুরের নিচুপট্টিতে অনুব্রতের বিশাল বাড়ি ও দলীয় কার্যালয়ের সামনে দিয়ে তৃণমূল বিরোধী স্লোগান দিয়ে ঘুরে বেড়ালেও কী পুলিশ, কী তৃণমূল কর্মীরা, কেউই বাধা দিতে এগোয়নি।
প্রশাসনের তরফে এই যে আগের মতো শাসক দলের দলদাস হিসাবে কাজ করা থেকে কিছুটা সরে এসে নিরপেক্ষ থাকার প্রবণতা শুরু হয়েছে, তার একটা কারণ অবশ্যই কয়লার চোরাচালান, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি এবং গরু, বালি ও পাথরের চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক নেতাদের ধরার সঙ্গেই পুলিশ ও আমলাদের নিয়েও টানাটানি শুরু হয়েছে। সি বি আই ইতিমধ্যেই কয়লা কাণ্ডে যুক্ত সন্দেহে অন্তত নয় জন আই পি এস অফিসারকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছে। আরও কাউকে কাউকে ডাকা হতে পারে বলে ইঙ্গিত রয়েছে। এই অবস্থায় নিজের নিজের গা বাঁচাতে পুলিশ ও আমলারা শাসক দলের সঙ্গে একটু দূরত্ব বাড়াতে চেষ্টা করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। প্রশাসন যদি সাবধানে পা ফেলতে শুরু করে তা হলে সরকারি প্রকল্প রূপায়ণে পদে পদে বাধা সৃষ্টি হবে। তার চাইতেও বড় কথা, এতদিন পুলিশ ও প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়েই শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এ রাজ্যে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে চুপ করিয়ে রেখেছিল। একের পর এক নির্বাচনে একতরফা গাজোয়ারি দেখিয়ে ভোট করে আসছিল, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যেটা খুবই দৃষ্টিকটু লাগত। এবার পুলিশ প্রশাসন কিছুটা নিরপেক্ষ থাকলে নির্বাচনে তৃণমূলের আর আগের মতো বিপুল জয় আসবে না। তার সঙ্গে নেতাদের এই সব চুরি ও গ্রেফতারির পরে দলের ভাবমূর্তি যে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে, তার জেরও পড়বে। মনে রাখতে হবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে দলের মুখপাত্ররা সবাই এখন আর আগের মতো আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখছেন না, বরং তাঁরা অনেকটাই রক্ষণাত্মক সুরে কথা বলছেন। দলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় তো প্রকাশ্যেই স্বীকার করছেন যে যা সব ঘটছে তাতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। সামনের বছর, অর্থাৎ 2023 রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের নির্বাচন হবে। রাজ্যের প্রশাসন ও পুলিশের প্রত্যক্ষ মদত ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে সেই নির্বাচনে কতটা নিজের জনসমর্থন ধরে রাখতে পারে, সবাই আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে।
#MamataBanerjee #CMWestBengal #Corruption_in_TMC