মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ মানবমূর্তিটাকে দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন যে, স্বাধীনতার শিখা সে দেশে কখনওই নিষ্কম্প ছিল না। আমেরিকার প্রায় 250 বছরের ইতিহাসে বহুবার সেটাকে নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বারবার কিছু মানুষের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, রক্ত, ঘাম আর কান্না মিলেমিশে গিয়ে বারুদ জুগিয়েছে এই মশালে। রয়ে গেছে কিছু ছাইভস্ম। সেগুলো সরালে উঠে আসবে কিছু দ্রোহ, প্রতিহিংসা, বিভেদ আর বিদ্বেষের কথা।
আমেরিকার নাগরিক অধিকার রক্ষার আন্দোলন বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী। প্রথমে চার বছর ব্যাপী গৃহযুদ্ধ (1861-1864), তারপর আস্ত দেশটারই আড়াআড়ি ভাবে দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়া। দ্বিখন্ডিত হতে চলা যুক্তরাষ্ট্রকে সেবার জুড়ে দিয়েছিল আব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্ব আর বিচক্ষণতা। আমেরিকার নাগরিক অধিকার অর্জনের যে লড়াই, লিঙ্কনকে তার ‘ভগীরথ’ বলা যেতে পারে। আমেরিকার দক্ষিণ অংশের প্রবল বিক্ষোভ, আপত্তিকে অগ্রাহ্য করেই তিনি দাসপ্রথা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন দেশকে।
শুরু হল এক নতুন আমেরিকা গঠনের প্রক্রিয়া, ইতিহাসে যা 'Reconstruction' নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। কিন্তু লিঙ্কনের হত্যা আমেরিকা ও আফ্রো আমেরিকান দাসদের ভাগ্যাকাশে নয়া বিপর্যয় ডেকে আনল। সেই সময়কার ভাইস প্রেসিডেন্ট, ডেমোক্রেট নেতা অ্যান্ড্রু জনসন লিঙ্কনের পদে স্থলাভিষিক্ত হলেন। কিন্তু টেক্সাস, জর্জিয়া, ভার্জিনিয়া, মিসিসিপির মতো দক্ষিণের প্রদেশগুলির হাতে এই আফ্রো আমেরিকানদের ভবিষ্যতকে সঁপে দিলেন। আপন ভাগ্য জয় করবার জন্য সেই আফ্রো আমেরিকানদের শুরু হল এক নয়া লড়াই। সেই লড়াইয়ে উত্তর আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের একটা বড় অংশ পাশে দাঁড়াল বটে, তবে সমানাধিকারের সঙ্গে সাদা কালোর বিভাজনরেখাটাও যে থাকা জরুরি, তারা সেটা বুঝিয়ে দিলেন।
কাকের মতোই কুচকুচে কালো
আমেরিকার Reconstruction পর্বে ‘কালো’ আফ্রো আমেরিকানদের জন্য কিছু দান দয়া করা হয়েছিল। 1868 সালে সে দেশের সংবিধানের 14 নং সংশোধনীতে এই আফ্রো আমেরিকানদের আইন ব্যবস্থার সবকিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। 1870 সালে 15 নং সংশোধনীতে তাদের ভোটাধিকারও দেওয়া হয়। কিন্তু যে শ্বেতাঙ্গদের বাগানবাড়িতে এই কালো মানুষগুলো কাজ করত, তাদের সঙ্গে একই ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে হবে? তারা তেমনটা মানবেন কেন? তা ছাড়া রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর সেই ‘Whitemen Burden’ বা সাদা চামড়ার দায়িত্বের কথা ভুলে গেলেও তো চলে না। তাই, সাদা কালোয় ফারাক করতে হবে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে, মূলত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের প্রদেশগুলোয় এল, কালা ‘Jim Crow’ আইন।
সেই আইনে স্পষ্ট করে দেওয়া হল, সাদা চামড়ার মানুষ যে নাগরিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পায়, তা থেকে কালো চামড়ার মানুষদের বঞ্চিতই থাকতে হবে। অসবর্ণ বিবাহ নিষিদ্ধ করা হল, এবং বলা হল অধিকাংশ কালো মানুষদেরই ভোটাধিকার থাকবে না, কেননা তারা নাকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাতেও শিক্ষিত নন। 1949-এ দর্শকভর্তি প্রেক্ষাগৃহে পল রোবসন গান গাইছেন। আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত দর্শকাসন। একদিকে সাদা চামড়ার মানুষ, অন্যদিকে কালো চামড়ার। সদ্য স্বাধীনতা পেয়ে যে সময় বিভিন্ন ছোট-মেজো দেশ নতুন স্বপ্ন আর উদ্দীপনায় রঙিন হয়ে উঠছে, সেই সময়েও স্বাধীনতাপ্রিয় আমেরিকা 'ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট'।
যেখানে Bus করাই সংগ্রাম
1955 সালের 1লা ডিসেম্বর। 42 বছরের রোজা পার্কস অন্যান্য দিনের মতোই আলাবামার মন্টেগোমেরি থেকে বাসে উঠলেন। পরের স্টপেজ থেকে সেই বাসে উঠলেন, তিনজন শ্বেতাঙ্গ যাত্রী। কন্ডাক্টর এগিয়ে এসে পার্কসকে জায়গা ছেড়ে দিতে বললেন।
পার্কস তাতে অস্বীকৃত হলেন এবং গ্রেপ্তার হলেন। সেই সময় আমেরিকায় যে পৃথকীকরণ নীতি অনুসৃত হত, তাতে কালো চামড়ার মানুষদের বাসের পিছন দিকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া কয়েকটি আসনেই বসতে হত। অন্য কোনও আসনে বসার অধিকার তাদের ছিল না। পার্কস সেই নিয়ম ভঙ্গ করে 'অপরাধী' হয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে টানা 381 দিন ধরে চলেছিল মন্টেগোমেরি বাস বয়কট আন্দোলন।
"আমার একটা স্বপ্ন আছে...'
1954-তে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট এতকাল ধরে চলে আসা পৃথকীকরণ নীতিকে 'বেআইনি' বলে ঘোষণা করেছিল। 1957-তে প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার - 'সিভিল রাইটস অ্যাক্ট' (1957)- এই আইনবলে ঘোষণা করেন, কোনও কালো চামড়ার মানুষকে ভোটদানে বাধা দিলে, আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
তবু কখনও ক্যান্টিনের টেবিলে, কখনও বাসের আসনে, বারবার বঞ্চিত হয়েছেন আমেরিকার এই কালো মানুষগুলো। 1963 সালে এই মানুষগুলো মার্টিন লুথার কিং-এর সঙ্গে পা মিলিয়ে সাদা বাড়ির সর্বশক্তিমান পদাধিকারীর কাছে এর বিচার চাইতে গিয়েছিলেন। নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণভাবে। এরপর দলিল দস্তাবেজ লেখা হয়েছে প্রচুর। মিসিসিপি দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। আমেরিকা 'স্বাধীনতা' ও 'গণতন্ত্র' রক্ষায় উপসাগরের তীরে কয়েক দফা যুদ্ধ লড়ে ফেলেছে। কিন্তু এই কালো মানুষগুলোর 'স্বাধীন নাগরিক' হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। 'I have a dream' কখন যেন 'I had a dream' হয়ে গেছে। রণদামামার শব্দে, বিশ্ব পুঁজির চাকচিক্যে দেশটা বধির হয়েছে, অন্ধ হয়েছে। এবার দেখা যাচ্ছে, সে ঠিকমতো শ্বাস নিতেও পারছে না।
জর্জ: ওয়াশিংটন থেকে ফ্লয়েড
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে জয় ছিনিয়ে এনে এক স্বাধীন মুক্ত আমেরিকার ভিত স্থাপন করেছিলেন। আর এক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট 160 বছর আগে বিভাজিত দেশের পুনর্গঠন করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্টও অবশ্য বলছেন, 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন।' একসময় এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থী বা যুদ্ধবন্দিরা আজ এই কালো চামড়ার মানুষদের পূর্বপুরুষ। আর এই শরণার্থী এবং এদের উত্তরাধিকারীদের প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প কী মনোভাব পোষণ করেন, সেটা নিশ্চয়ই নতুন করে বলে দিতে হবে না। ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথ হেঁটেও সে দেশের কালো মানুষরা তাদের জন্য 'নবযুগ' আনতে পারেননি। এখনও তারা লড়ছেন, মরছেন, আবার বিদ্রোহ আর শ্লোগানে বাঁচছেনও। তাদের বাঁচতে শেখাচ্ছে বাকি আমেরিকাও। যে আমেরিকায় সাদা কালো দুটি মানুষ হাত ধরাধরি করে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। মার্কিন পুলিশের দমনপীড়নকে সমর্থন জানিয়ে, এই সাদা চামড়ার মানুষদের চাপেই সরে যেতে হয়েছে সে দেশের এক প্রখ্যাত দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগের সম্পাদককে। ঘটনাচক্র তিনিও সাদা চামড়ারই মানুষ। ট্রাম্পের কল্পিত 'গ্রেট আমেরিকা' কেমন হবে জানা নেই, সেই 'গ্রেট আমেরিকা' বানানোর সুযোগ ট্রাম্পকে আমেরিকাবাসী আরও একবার দেবেন কি না, জানা নেই তাও। তবে, এই আমেরিকা ভরসা জোগাচ্ছে।
মেলানিন (গায়ের চামড়ার রঙ নির্ধারিত হয় যার দ্বারা)-এর মতো একটা সামান্য দেহ রঞ্জক কি এই একবিংশ শতাব্দীতেও রাজার প্রজানুরঞ্জক হওয়া বা না হওয়া কে নির্ধারিত করবে? আর পাঁচ মাস পরেই উত্তর মিলবে যে ট্রাম্পের হাতে আমেরিকাবাসী আরও চার বছরের জন্য নিজেদের সমর্পণ করব কিনা। তবে গত কয়েকদিনের আমেরিকা আবারও দেখিয়ে দিল এই দেশটা যেমন জর্জ ওয়াশিংটনের, তেমনই জর্জ ফ্লয়েডেরও। আজকের আমেরিকা কিন্তু সেই প্রত্যয়টা জাগাচ্ছে। সাদা মানুষরা আজ নতজানু হয়ে বলছেন, ওরা কালো হোক, তবু ওদের ভাল হোক। এই মুহূর্তগুলোই স্বপ্ন দেখায়। আর সেই স্বপ্নগুলো এই অস্থির সময়েও বাঁচতে শেখায়।