4thPillar


শাসক থেকে বিরোধী, ‘দেশপ্রেমী' হওয়ার লড়াইতে সবাই

বিতান ঘোষ | 29-06-2020June 7, 2023
শাসক থেকে বিরোধী, ‘দেশপ্রেমী' হওয়ার লড়াইতে সবাই

দৃশ্যপট 1:- হাতে পতাকা, মুখে ভার‍ত মাতা কি জয়'। চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে জনা কুড়ি লোক চিনা পণ্য বয়কটের দাবিতে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

দৃশ্যপট 2:- পাড়ায় মোমবাতি জ্বালিয়ে নাগরিক মিছিল। শহীদ' সেনাদের রক্তের বদলা নেওয়ার সোচ্চার দাবি উঠছে মিছিল থেকে।

 

স্বল্প পরিসরে চলতি দেশপ্রেম'-এর ঝাঁকিদর্শনে এরকম কিছু ঘটনারই সাক্ষী আমরা। কোথাও সশব্দে চাইনিজ কোম্পানির টিভি সেট ভাঙা হচ্ছে, কোথাও উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের মুখচ্ছবিকেই চিনা প্রেসিডেন্টের মুখচ্ছবি ভেবে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গণ-হিস্টিরিয়ার মতোই এই যে গণ-দেশপ্রেমের জোয়ার, তাতে সামিল হচ্ছে আট থেকে আশি। ডান-বাম-মধ্য; রাজনৈতিক মতাদর্শের যে যেখানেই থাকুন না কেন, অবিমিশ্র দেশপ্রেমের জোয়ারে কমবেশি ভাসছেন সবাই।

 

ফেডেরারকে তাঁর প্রিয় ঘাসের কোর্টে আর নাদালকে তাঁর প্রিয় ক্লে-কোর্টে টেনিস খেলার সুযোগ করে দিলে তার সম্ভাব্য ফল কী হতে পারে? না হেঁয়ালি নয়, এই দেশে বর্তমানে যারা বিরোধী রাজনীতি করছেন, তাদের প্রায় সবাই মোদী এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে তাদের প্রিয় রাজনৈতিক কোর্টে খেলার সুযোগ করে দিচ্ছেন বলা চলে। গত লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ যেভাবে নিজেদের হিন্দু পরিচয়কে বড় করে দেখাচ্ছিলেন (এমনকি নিজেদের পৈতে দেখিয়ে নিজেকে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বলেও দাবি করেছিলেন), তাতে আখেরে রাজনৈতিক সুবিধা হয়েছিল বিজেপিরই। বিরোধীরা বোঝেননি, ভোটাররা হিন্দুত্ববাদের পাচন যখন গিলবেনই, তখন কড়া ডোজটা নিতেই পছন্দ করবেনভোটারদের বিশ্বাস অনুযায়ী যেটা একমাত্র বিজেপিই দিতে সক্ষম। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু' হওয়ার এই অসম প্রতিযোগিতায় বিজেপির কাছে হার মানতে হয়েছিল তাদের। তবে, এবার আর হিন্দু নয়, চলতি যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহে আপাতত দেশপ্রেমী' সাজতে চাইছেন সবাই।

 

বালাকোটের এয়ারস্ট্রাইকের পর বিরোধীদের একাংশ এই প্রত্যাঘাতের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাদের সবাইকেই সুকৌশলে দেশদ্রোহী' তকমা দিয়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও বিজেপি। এদিকে পুলওয়ামা কাণ্ডের তদন্তের এখনও সর্বশেষ পরিণতির খবর নেই। তার উপর গত জানুয়ারি মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের ডিএসপি পদমর্যাদার পুলিশ অফিসার দাভিন্দর সিং-এর বিরুদ্ধে জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার যে অভিযোগ সামনে এসেছে, তাতে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাতেই বড়সড় ফাঁকফোকর থাকার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু, সাম্প্রতিক অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বিরোধীরা সরকারের সামনে এই অপ্রিয় প্রশ্নগুলো তুলতে চাইছেন না। পাছে ভোটারের কাছে তারা আবার দেশদ্রোহী হয়ে যান, তাই সবাই সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়েই বলছেন, ‘চিনকে দেখে নেওয়া হবে।' চিন দেশের ভূ-খণ্ডে প্রবেশ করেনি বলে প্রধানমন্ত্রী যে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য রেখেছিলেন, তার বিরুদ্ধেও বিরোধীদের খুব বেশি সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। প্রত্যেক বিরোধী দলকেই এখন বিধিবিদ্ধ বক্তব্যের মতো বলতে হচ্ছে, তারা দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে এবং দেশের সরকারের সঙ্গে রয়েছেন। ভারতের সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেসব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে, যেসব দলের জনপ্রতিনিধিরা দেশের সংবিধানের নামে শপথ গ্রহণ করেন, সেই সব দলগুলিকে কি নতুন করে প্রমাণ দিতে হবে যে, তারা দেশের অখণ্ডতা ও সংহতির পক্ষে? তার মানে সংবিধান মেনে চলার প্রতিজ্ঞা করা কিংবা দেশের আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করাই এখন আর দেশের পক্ষে' থাকার যথেষ্ট প্রমাণ নয়?

 

লাদাখে দেশের সীমান্ত প্রহরায় থাকা 20 জন সৈন্য শহীদ' হয়েছেন। কারণ তারা রাষ্ট্রের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। যে পরিযায়ী শ্রমিকরা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে পথে নেমে প্রাণ হারালেন, তারা কি তবে শহীদ নন? তারাও তো রাষ্ট্রের জন্যই প্রাণ দিয়েছেন। সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভটাকে মজবুত করতে চেয়েছিলেন। তাকেও প্রাণ দিতে হয়েছিল। তিনি কি রাষ্ট্রের জন্য প্রাণ দেননি? অথচ তাদের জন্য আমরা শোকসভা করিনি। মোমবাতি মিছিলও না। কেননা রাষ্ট্র তাদের জীবনের মূল্যকে অকিঞ্চিৎকর করে রেখেছে, যেহেতু তাদের মৃত্যু রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক লাভ এনে দেবে না অথচ বিড়ম্বনা বাড়ালেও বাড়াতে পারে। সৈন্যবাহিনীর যোদ্ধাদের প্রতি কুর্নিশ জানিয়েও বড় ভয় হয়, যেভাবে দেশের সৈন্যবাহিনী কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধির মাধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যেভাবে তাঁদের দেখিয়ে দেশপ্রেমের বাতাবরণ তৈরি করা হচ্ছে, তা আগামীদিনের জন্য ভয়ঙ্কর হতে পারে।

 

অতীতেও আমরা দেখেছি জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনে এবং দলীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা ইন্দিরা গান্ধী 1974 সালে দেশের প্রথম পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা ঘটিয়ে বিরোধীদের যাবতীয় প্রচারকে প্রায় ভোঁতা করে দিয়েছিলেন। তবে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশের সরকারের সূক্ষ বিভাজন রেখাটা তখনও অবধি বজায় ছিল। সেনার বীরত্ব, প্রধানমন্ত্রীর সাহস, শাসক দলের দেশপ্রেমসব মিলিয়ে মিশিয়ে এমন বিকৃত দেশপ্রেমের প্রচার তখন ছিল না। ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালে সেনাপ্রধান মানেকশ-এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক অত্যন্ত প্রগাঢ় হলেও, মানেকশ কখনও ইন্দিরার সমর্থনে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেননি। অথচ, সম্প্রতি আমরা দেখলাম পূর্বতন সেনাপ্রধান, অধুনা চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত মন্তব্য করলেন, বিরোধীরা নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির পড়ুয়াদের উস্কানি দিচ্ছেন। যেহেতু তিনি সেনার শীর্ষ পদাধিকারী, তাই তাঁর বক্তব্য জনমানসে প্রায় প্রতিক্রিয়াহীন ভাবেই গ্রাহ্য হল। এখন আবার দাবি উঠছে জাতীয় স্বার্থে' সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে, দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না! 1962-এর চিন যুদ্ধে দেশের শোচনীয় ব্যর্থতার পরও তো দেশের সংসদে জেবি কৃপালিনীর মতো সাংসদরা নেহরুকে কড়া বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছিলেন। তাঁরা কি তবে এই হীন' কাজ করে, জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে আপস করেছিলেন? রাজনৈতিকভাবে যে বিজেপি জরুরি অবস্থার কঠোর সমালোচক, সেই বিজেপির নেতারা কি তবে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলাকেও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার বিরুদ্ধে কথা বলা হিসাবে দেখবেন? জরুরি অবস্থা জারি করার পিছনে ইন্দিরাও অবশ্য জাতীয় নিরাপত্তা ও সংহতির অজুহাত' খাড়া করেছিলেন! বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে মে মাসেই নিয়ন্ত্রণরেখার এপারে চিনা অনুপ্রবেশের খবর মিলেছিল। করোনা সংক্রমণের মতোই জুন মাসের গোড়া অবধি প্রধানমন্ত্রী বা বিদেশ দপ্তর কেউই বিষয়টাকে তেমন আমল দেননি, অন্তত প্রকাশ্যে। এখন বিরোধীরা যদি প্রশ্ন তোলেন দেশের সরকারের (ভুলের) জন্য আমাদের 20টা প্রাণকে হারাতে হল, খুব ভুল বলা হবে কি? এই সংখ্যাটা যাতে পরবর্তী সময়ে আর না বাড়ে, তাই নিয়ে উচ্চপর্যায়ে চর্চা হওয়া প্রয়োজন। সরকারি গাফিলতিতে 20 জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে জ্বালানো মোমবাতি নেভানোর আগেই যেন নতুন করে মোমবাতি জ্বালাতে না হয়।

 

দেশের যে কোনও বিষয়ে এখন জাতীয় পতাকার ব্যবহারও হামেশাই দেখা যাচ্ছে। মুখে ভারতমাতার জয় কামনার সঙ্গে হাতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা ছাড়া যেন দেশপ্রেমিক হিসাবে কল্কে পাওয়া যাচ্ছে না। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, এখন যাঁরা কেন্দ্রের সরকারে রয়েছেন, তাঁদের রাজনৈতিক পূর্বসুরীরা প্রায় 52 বছর তাদের সদর দপ্তরে জাতীয় পতাকা তোলেননি। দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক এম এস. গোলওয়ারকর তাঁর বাঞ্চ অফ থটস' বইয়ে দেশের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকাকে বিজাতীয়' হিন্দু স্বার্থ-বিরোধী' বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর মতে তিন সংখ্যাটা হিন্দুদের দুর্ভাগ্যের কারণ', তাই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তাদের ভাগওয়া ধ্বজ'-কেই জাতীয় পতাকার স্বীকৃতি দিয়েছিল। এখন বিজেপি আর তাদের থিঙ্কট্যাঙ্ক আরএসএস যদি এই জাতীয় পতাকা নিয়ে দেশহিতৈষী' আন্দোলনে নামে, এর থেকে বড় ঐতিহাসিক প্রবঞ্চনা আর কিছু হতে পারে না। তা ছাড়া জাতীয় পতাকারও একটা গরিমা আছে। নিয়মবিধি না মেনে তার যথেচ্ছ ব্যবহার আসলে সাংবিধানিক অবমাননার নামান্তর।

 

চিন্তার বিষয়, দেশপ্রেম নামক এমন একটা বাঘের উপরে এই সরকার চেপে বসেছে, যাকে সহজে থামানো মুশকিল। এতদিন করোনা এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটে এই দেশপ্রেমটাই কেমন মিইয়ে যাচ্ছিল। লাদাখে চিনা আগ্রাসন দেশপ্রেমের সেই মরা গাঙে বান আনল বলা চলে। এই আগ্রাসী ও বিকৃত দেশপ্রেম থেকে যারা শাসককে আটকাতে পারতেন, সেই বিরোধীরাও ওই জিনিসটাকেই পুঁজি করে এগোতে চাইছেন। যৌক্তিক সমালোচনা, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করার জন্য সরকারকে গঠনমূলক পরামর্শদান কিংবা জনমানসে এই যুদ্ধজিগিরের বিরুদ্ধে মতামত গড়ে তোলাএই একটি কাজেও বিরোধীদের ধারাবাহিক প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বিরোধীরা হয়তো শাসকের অস্ত্রেই শাসককে ঘায়েল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু এর শেষ কোথায়? দেশের আর্থ-সামাজিক সমস্যাকে দূরে সরিয়ে রেখে বারবার শাসক এই ফর্মুলায় সফল হবে? আমরা কি দেশপ্রেমের সংজ্ঞা বলতে এই মিথ্যা আস্ফালন, আর শাসকের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নহীন ভাবে মেনে চলাকেই বুঝব?



New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -বিতান ঘোষ | 29-06-2020

// Event for pushed the video