আমরা ইসলামিক স্থাপত্য শব্দটির ব্যবহার দেখেছি, হিন্দু স্থাপত্য শব্দটিও অপরিচিত নয় আমাদের। কিন্তু খ্রিস্টান স্থাপত্য শব্দটি কখনও কি শুনেছেন? আসলে খ্রিস্টান স্থাপত্য বলে কোনও শব্দই নেই। এর পরিবর্তে যেটা আছে তা হল,বিভিন্ন অঞ্চল বা নির্দিষ্ট সময়ের নির্দিষ্ট নাম যা ইউরোপে বিকশিত হয়েছে যেমন ইংরেজি, আইরিশ, স্কটিশ, ওয়েলশ, ফ্রেঞ্চ, হিস্পানিক, স্লাভিক, প্রুশিয়ান বা পর্তুগিজ, বা গথিক, রোমানেস্ক, ক্লাসিক্যাল, নিও ক্লাসিক্যাল, বারোক, রেনেসাঁ, আর্ট-ডেকো মডার্নিস্ট ইত্যাদি।
অন্যদিকে, আরব, তুর্কি, মরক্কো, ইরাকি, ইরানী বা আফগান স্থাপত্যের কথা কেউ শুনতে পায় না। এগুলোকেএকত্রে ইসলামিক স্থাপত্য বলাহয়। একইভাবেসমস্ত দক্ষিণ এশীয় স্থাপত্যকে হিন্দু স্থাপত্য বলেই বর্ণনা করা হয়েছে, ইউরোপের মতো অঞ্চল বা নির্দিষ্ট সময়ের স্থাপত্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়নি।এই ধরনের স্থাপত্যতে চেরা, চোলা, চান্দেলা, পারিহার, বঙ্গ, গুজরাট, কাথিয়াওয়াড়, আহোম, জয়সলমের, ডোগরা, বুন্দি, যোধপুর, জয়পুর বা পাহাড়ি স্থাপত্য বলে উল্লেখ করার ঘটনা অতি বিরল। উপনিবেশবাদীরা আমাদের ইতিহাসকে যেমন হিন্দু, ইসলামিক এবং ব্রিটিশ যুগ হিসাবে ভাগ করেছে (খ্রিস্টান যুগ হিসাবে নয়), স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
এর পিছনে মূল ভাবনাটি ছিল ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, ফরাসি, ডাচ এবং অন্য উপনিবেশবাদীদেরভিন্ন ও বৈচিত্র্যময় হিসেবে উপস্থাপন করা, একত্রে তাদের খ্রিস্টান হিসেবে নয়। অন্যদিকে আরব, তুর্কি, আফগান, ইরানিদেরকে একসঙ্গেকরে একমাত্রিকভাবে মুসলমান হিসেবে দেখা এবং তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালিয়ালি, মারাঠি, গুজরাটি, বাঙালি, আহোম, ওড়িয়া ইত্যাদি সমস্ত দক্ষিণ এশিয়দের একইভাবে শুধু হিন্দু হিসেবে দেখা।
ইসলামিক স্থাপত্যগুলো গম্বুজ, খিলান এবং মিনার দিয়ে গঠিত বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু আদতে পৃথিবীর প্রথম খিলানটি প্রাচীন সুমেরিয়রা তাদের ভূ-গর্ভস্থ চ্যানেলগুলির সিলিং বানানোর জন্য ব্যবহার করেছিল। রোমানরাই প্রথম খিলানটিকে মাটির উপরে নিয়ে আসে এবং জলপ্রণালী বা aqueduct-এর জন্য এর ব্যবহার শুরু করেছিল। এরই বিবর্তন হতে হতে খিলানযুক্ত ছাদ এবং গম্বুজের উদ্ভব। প্যানথিয়ন ছিল প্রথম বৃহৎ গম্বুজ এবং এটি নির্মাণ করেছিলেন প্রাক-খ্রিস্টান রোমানরা। এর উদ্দেশ্যটা ছিল একটা বিশাল ছাদে ঢাকা এমন খোলা জায়গা তৈরি করা যেটার মাঝে অজস্র পিলার থাকবে না। গম্বুজের প্রথম ব্যবহার সম্ভবত রোমান সিনেটের জন্য করা হয়েছিল।
ইহুদি এবং খ্রিস্টান উভয় ধর্মই ইসলামের পূর্ববর্তী, এইতিনটি ধর্মই তাদের উপাসনালয় এবং গির্জাগুলিতে গম্বুজের ব্যবহার করে।মুসলমানরা পরবর্তীকালে এটাকে স্রেফ অনুসরণ করেছিল কারণ গম্বুজের ভাবনাটি রোমানদের সঙ্গে তুরস্ক অবধি পৌঁছেছিল এবং তারপর সেখান থেকে এটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল – পূর্বে ইরান ও আফগানিস্তান হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায়, দক্ষিণে সিরিয়া ও ইরাক হয়ে আরব এবং উত্তরে ইউরোপে। আরবের প্রথম দিকের মসজিদগুলোতে কিন্তু কোনও গম্বুজ, মিনার এবং খিলান ছিল না। গম্বুজ, মিনার ইত্যাদি জাতীয় স্থাপত্যের ভাবনা সেখানে পৌঁছতে সময় লেগেছিল।
মনে রাখা দরকার তুরস্কের হাজিয়া সোফিয়া একটি গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ হিসাবে শুরু হয়েছিল এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চে রূপান্তরিত হয়েছিল যখন ক্যাথলিকরা গ্রীক অর্থোডক্সদের পরাজিত করেছিল। পরবর্তীকালে যখন মুসলমানরা ক্যাথলিকদের পরাজিত করেছিল তখন চার্চটি একটি মসজিদে পরিণত হয়। গম্বুজটি যা ছিল তাই রয়ে গেছে, কেবল দখলকারী পরিবর্তিত হয়েছে সময়ের সঙ্গে।
সমগ্র ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে হাজার হাজার গম্বুজ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটারের ব্যাসিলিকা (বিশ্বের বৃহত্তম গম্বুজ) এবং ওয়াশিংটন ডিসি-র ক্যাপিটল হিল। এগুলোকে কেউ ইসলামি বলে না৷ পশ্চিমে এইগুলো সহ আরও হাজার হাজার স্থাপত্য খিলান এবং গম্বুজ ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছে অথচ কেউ তাদের ইসলামিক স্থাপত্য বলে না। তাহলে কী ভাবে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায় গম্বুজ ও খিলান ইসলামিক হয়ে গেল? মিনার যদি ইসলামি হয় তাহলে পিসার টাওয়ার কী?
ধর্ম-কেন্দ্রিক স্থাপত্য শৈলীর বিভাজনের চর্চাটি গত তিন শতাব্দী বা তারও বেশি সময় ধরে বিকশিত হয়েছে। ‘ইসলামিক স্থাপত্য শৈলী’-এর ধারণাটি সম্ভবত এর যুগল ‘হিন্দু স্থাপত্য শৈলী’ ধারণার আগে থেকেই ছিল। প্রথমটি সম্ভবত সেই সময়কার যখন ইউরোপীয়রা প্রথম মধ্যপ্রাচ্যের সাক্ষাৎ পায় এবং ইসলামি সভ্যতা বলে যে কিছু আছে সেটা জানতে পারে। যখন তারা আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হয় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় পৌঁছায় তখন তারা ওই ইসলামি সভ্যতার একটি সমান্তরাল বস্তু তৈরি করেছিল- হিন্দু সভ্যতা।
তত্ত্বগতভাবে এটা বেশ খাপে খাপ মিলে যায় - ইসলামি স্থাপত্য, ইসলামি সভ্যতা, ইসলামি সংস্কৃতি, ইসলামি মানসিকতা। আবার হিন্দু স্থাপত্য, হিন্দু সভ্যতা, হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু মানসিকতা। কই কখনও তো শোনা যায় না খ্রিস্টান স্থাপত্য, খ্রিস্টান সভ্যতা, খ্রিস্টান সংস্কৃতি, খ্রিস্টান মানসিকতা!
এভাবেই ঔপনিবেশিক শক্তিরা আমাদের একেবারে একমাত্রিক খাঁচার মধ্যে বন্দি করে পেলেছিল, আর মরা সেটা মেনে নিয়েছিলাম কারণ তারা আমাদের স্বাধীন ভাবনাটাকেই অধিকার করে ফেলেছিল। বিভাজন করে শাসনের কাজটা তাদের পক্ষে খুবই সহজ হয়ে গিয়েছিল, কারণ বিশ্ব সংসার সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমরা বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছিলাম। আসলে আমাদের শেখানোই হয়েছিল যে প্রশ্ন করা যাবে না। কিন্তু আজও যে আমাদের যে প্রশ্নগুলো করা উচিত সেগুলে করছি না, সেটাই সবচেয়ে বিস্ময়কর!
ইসলামি স্থাপত্যের প্রশ্নটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাক যে এই শ্রেণী বিভাজনটি কতটা ভুল। আমাদের কাছে 5টি ছবি রয়েছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য। প্রথমটি ভারতে নির্মিত প্রাচীনতম মসজিদের একটি চিত্র, এটি 629 খ্রিস্টাব্দে কেরালার কোডুঙ্গাল্লুরে নবী মোহাম্মদের জীবদ্দশায় নির্মিত হয়েছিল। আমাদের ছবিটি 1958 সালে মসজিদটি দেখতে কেমন ছিল তা দেখায়। পরের দু'টো ছবি যথাক্রমে কাশ্মীরের প্রাচীনতম মসজিদ এবং শ্রীনগরের জামা মসজিদের। চতুর্থ ছবিটি জাভার এবং পঞ্চমটি চিনের প্রাচীনতম মসজিদের।এই সমস্ত মসজিদের ঢালু ছাদ রয়েছে এবং এর কারণ হল কেরালা এবং জাভাতে বেশি বৃষ্টিপাত হয়, এবং কাশ্মীর এবং চিনে প্রবল তুষারপাত হয়। বেশি বৃষ্টিপাতের এলাকায় সমস্ত বাড়ি বা স্থাপত্যের ঢালু ছাদ রয়েছে।
যদি ইসলামিক স্থাপত্য বলে কিছু থাকত, তাহলে সেটি মসজিদগুলোতে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যেত। লক্ষ করুন এই পাঁচটি মসজিদ একটি মসজিদের ছবি এবং আমাদের মাথার মধ্যে মসজিদ ও ইসলামি স্থাপত্যের য ছবি গেঁথে দেওয়া আছে সে দুটোর মধ্যে কত তফাৎ! গম্বুজ গোড়ার থেকেই কম বৃষ্টিপাতের অঞ্চলে তৈরি হয়েছিল।
এই উদাহরণটি থেকেই পরিষ্কার যে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে স্থাপত্যের বিকাশ এলাকার জলবায়ু দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। কাঠের কাঠামো বনাঞ্চলে বিকশিত হয়েছে। নদীর তীরবর্তী জমিতে রোদে শুকানো এবং পরে আগুনে পোড়ানো ইট ব্যবহার করা হয়েছে। শুষ্ক ও পাথুরে ভূখণ্ডে পাথর ও ইট বেশি ব্যবহৃত হত। বেশি বৃষ্টিপাতের এলাকায় ঢালু ছাদএবং কম বা অল্প বৃষ্টিপাতের এলাকায় সমতল ছাদ ছিল। এই সমতল ছাদগুলি তার উপর গম্বুজযুক্ত কাঠামোনির্মাণের সহায়ক ছিল।
স্থাপত্যের শিকড় প্রোথিত থাকে তার স্থানীয় পরিবেশের ভিতর। যেখানে এটি তৈরি হয়, যারা এটাকে ব্যবহার করে তাদের চাহিদা অনুযায়ী এটা বিবর্তিত হতে থাকে। সমকালীন নির্মাণের মালমশলা আর জানা টেকনিকের উপরই নির্ভর করে স্থাপত্যের উপাদান আর চেহারা। তার বিবর্তন অন্য সমস্ত মানবিক প্রয়াসের মতোই মানুষের সর্বজনীন চাহিদার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে, যার সঙ্গে মানুষকে কোনও না কোনওভাবে শ্রেণিভুক্ত করা পরিচয়ের সম্পর্ক নেই।