4thPillar


চন্দ্রমুখীর সন্ধানে হিমালয়ের কোলে

শ্রবসী বসু | 04-02-2022June 6, 2023
চন্দ্রমুখীর সন্ধানে হিমালয়ের কোলে

1877 সালের 27 জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের মিটিং-এর রিপোর্টে বলা হয়েছিল, “... for the first time in the history of the University, a female candidate has been declared to have attained the required standard for the Entrance Examination ....” যে মেয়েটি সম্বন্ধে এ কথা বলা হয়েছিল, তিনি হলেন চন্দ্রমুখী বসু (Chandramukhi Basu), রেভারেন্ড ভুবনমোহন বসুর জ্যেষ্ঠা কন্যা, যিনি 1876 সালে দেরাদুন থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসেছিলেন, পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (University Of Calcutta) তাঁকে প্রথম মহিলা হিসেবে এই কৃতিত্ব দিয়েছিল 2013 সালে। 29 নভেম্বর 2013 সালের সমাবর্তনে তৎকালীন উপাচার্য ঘোষণা করেছিলেন, “Although Chandramukhi Basu had cleared her Entrance Examination in 1876, the University had refused to register her as a successful candidate because of gender discrimination ... we now intend to posthumously confer on her the pass certificate of the said Entrance Examination.”

 চন্দ্রমুখী বসু তাঁর জীবদ্দশায় প্রথম মহিলা প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণার সম্মান না পেলেও, অন্যান্য অনেক সম্মানই তিনি অর্জন করেছিলেন। কাদম্বিনী বসুর সঙ্গে তিনি যুগ্মভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতক (1883); পরের বছর তিনি ইংরেজি সাম্মানিক নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতকোত্তর (1884)। বেথুন স্কুল যখন বেথুন কলেজের রূপ নিল, চন্দ্রমুখী বসু হলেন তার প্রথম অধ্যক্ষ (1890)। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে সম্ভবত তার আগে কোনও মহিলা কোনও কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন হননি।

 বাংলাদেশে মেয়েদের লেখাপড়া এগিয়েছিল বিচিত্র ভুজঙ্গপ্রয়াত গতিতে। ছোট ছোট মেয়েরা কী পড়বে, কতটা লেখাপড়া শিখবে, কেন শিখবে, কার কাছে শিখবে – বাড়িতে বৈষ্ণবীর কাছে, না কি খ্রিষ্টান মিশনারীদের কাছে, বেথুন সাহেবের স্কুলে না কি বীণাপানি পর্দা স্কুলে – এ সব নিয়ে ঊনবিংশ শতকের প্রথম থেকে Young Bengal গোষ্ঠী থেকে শুরু করে হিন্দু এবং ব্রাহ্মদের মধ্যে বাদানুবাদের অন্ত ছিল না। তৎকালীন খবরের কাগজ এবং পত্রপত্রিকাগুলিতে তার বহু সাক্ষ্য বর্তমান। কিন্তু কেউই মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো কিংবা তাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর উপায় বলে, তাদের স্বাধীনতার দিকে প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করাকে ঘুণাক্ষরেও মনে করতে পারেনি। আসলে আজকে আমরা ব্যক্তি-স্বাধীনতা বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে যা বুঝি, আজ থেকে দু’শো বছর আগে তো তা বোঝানো হত না। আজকের সংজ্ঞা অনুসরণ করলে সেই সময়ে অনেক পুরুষেরও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না। যা হোক, সে তো অন্য আলোচনা। যে কথা এখানে বলতে চাই তা হল, একবার মেয়েরা যখন গৃহবন্দিত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেল, তখন তাদের অভিভাবক-নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আটকে রাখা দুষ্কর হল। স্কুল পেরিয়ে কলেজ, কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, ডাক্তারি পড়তে বিদেশ পাড়ি বা কলেজের অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ – অল্প দিনের ব্যবধানে আপাত-অসম্ভব সবই একের পর এক সম্ভব হয়ে উঠল মেয়েদের জীবনে। 

 একটা কথা আমার খুবই মনে হয় চন্দ্রমুখী আর কাদম্বিনী সম্বন্ধে। এই দুই অতি মেধাবী অতি কর্মকুশল মহিলা ঊনবিংশ শতকের শেষে বাংলাদেশের মেয়েদের সামনে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ব্যক্তিমানুষ কাদম্বিনী সম্বন্ধে তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে আমরা যতটা জানতে পারি, চন্দ্রমুখী যে মানুষ কেমন ছিলেন, অবসর সময়ে কী করতেন, তার কিছুই আমরা জানতে পারি না। হয়তো দেরাদুনে ছোটবেলা কাটানোর ফলে এখানে তাঁর কারও সঙ্গে তেমন অন্তরঙ্গতা হয়নি। হয়তো খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বলে কলকাতার বিদ্বজ্জনসমাজ তাঁকে কাছে টেনে নেয়নি। অথবা হয়তো তাঁর বাহ্যিক গাম্ভীর্য তাঁকে কিছুটা দূরত্বের পরিমন্ডলে থাকতে বাধ্য করেছিল। চন্দ্রমুখীর যেটুকু পরিচয় আমরা পাই, তার সবটাই বিধৃত রয়েছে তাঁর কাজকর্মের মধ্যে।

 বেথুন কলেজের অধ্যক্ষ হবার আগে চন্দ্রমুখী বেথুন স্কুল হস্টেলের সহকারী সুপারিন্টেন্ডেন্ট এবং কিছুদিন পরে, Miss Lipscombe অবসর নেওয়ার পর, সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়েছিলেন। সেখানেও তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা। নিঃসন্দেহে এই দায়িত্ব নেওয়ার পক্ষে যথাযোগ্য ব্যক্তি। তিনি তখন স্কুল আর কলেজেও পড়াচ্ছেন। অথচ তাঁর মাস মাইনে ঠিক হল 75 টাকা, যেখানে Miss Lipscombe পাচ্ছিলেন মাসে 300 টাকা! 1884 সালের 31 অগাস্ট Indian Mirror লিখল, “We welcome Chandramukhi Bose M.A. to her new post... where she will have a career of honest usefulness ... and ample opportunities of inspiring the rising generation of her country women... But her pay (is) ... a poor encouragement for one who has won such distinguished honour in the University. The present lady superintendent who cannot teach the college classes, and, to speak plainly, is of little practical use to the institution gets, Rs. 300.... Is it at all fair, to pay ... a distinguished lady graduate, and one who would be assuredly of far more use to the institution ... only 75 rupees? But we live in strange times.” এই বৈষম্যের ব্যাপারে চন্দ্রমুখী কী ভেবেছিলেন, জানতে ইচ্ছে করে। তাঁর ছোট দুই বোন বিধুমুখী আর বিন্দুবাসিনী, দু’জনেই খ্যাতনামা চিকিৎসক, তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু কোথাও কোনও চিঠি বা ব্যক্তিগত আলোচনার উল্লেখ পাই না।

 চন্দ্রমুখীর চরিত্রের যা পরিচয় পাওয়া যায় সবই তাঁর বেথুন কলেজ সংক্রান্ত কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে। ভদ্র হিন্দু পরিবারের মেয়েদের স্কুলে আনার ব্যবস্থা করতে গিয়ে স্বয়ং বেথুন সাহেবকে সন্তর্পণে পা ফেলতে হয়েছিল। তার তিন দশকের মধ্যেই দেখি স্কুল এবং কলেজের হস্টেলে আসাম, ঢাকা এমনকি সুদূর লাহোর থেকে মেয়েরা আসছে, থাকতে আর পড়তে। হস্টেলের নিয়ম ছিল মেয়েদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, জুতো আর ভদ্র পোশাক পরে থাকতে হবে। কিন্তু এ তো হিন্দু বাড়ির নিয়মের পরিপন্থী! পরিবারের বর্ষীয়ান সদস্যরা মনে করতেন যে মেয়েরা ‘পটের বিবি’ সেজে থাকলে ঘরকন্নার কাজে, শ্বশুর-শাশুড়ির আদেশ পালনের কাজে যথেষ্ট মনোযোগী হবে না। যতই হোক, মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো তো বিয়ের বাজারে তাদের দাম বাড়ানোর উপায় ছাড়া আর কিছু নয়! তাদের পিছনে এত খরচ করার প্রয়োজন কী? হস্টেলে অন্তত এক জোড়া জুতো-মোজা, তোয়ালে বা বিছানার চাদরের কী দরকার? 1890 সালের 17 মে তারিখের Indian Mirror কাগজে জনৈক শশীভূষণ দাসগুপ্তর একটি চিঠি প্রকাশিত হল, যেখানে তিনি লিখছেন, “... today parents are forced to make girls ‘bibis’. Education, after all, is meant to prepare girls for better marriage and nothing else. These luxury goods would make girls fairly addicted to expensive life style. After all, girls had to prepare themselves for domestic life.”

 আজকের পরিভাষায় বলতে হয় চন্দ্রমুখী কর্মজীবনে যথেষ্টই trolled হয়েছিলেন। বেথুন কলেজের হাজারো ছোট ছোট সমালোচনা, তাঁর নিজস্ব ধর্মের প্রতি লক্ষ্য ইত্যাদি হয়ত তাঁর গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। জগদ্ধাত্রী পুজোয় কেন স্কুল খোলা থাকবে? রবিবার কেন স্কুল বন্ধ থাকবে, কেন দ্বিতীয় শনিবার ছুটি হবে – সে কি খ্রিস্টান শিক্ষক আর ছাত্রীদের জামাকাপড় ধোপাবাড়ি দেওয়ার জন্য? বাংলা এবং ইংরেজি পত্রপত্রিকায় এ ধরনের নিম্নরুচির আলোচনা প্রকাশিত হতেই থাকত। সব তুচ্ছ সমালোচনার জবাব দেওয়ার মতো সময় বা মানসিকতা তাঁর ছিল না, কারণ বেথুন কলেজকে আরও বড় করে তোলার জন্য, ক্লাসের স্থান সংকুলান করার জন্য, ভাল শিক্ষক আনার ব্যবস্থা করা, কলেজের আর্থিক সংগতির জন্য সরকারের সঙ্গে পত্রবিনিময় ইত্যাদিকে আরও অনেক গুরুত্ব দিতে হত। কিন্তু শশীভূষণের চিঠির উত্তর তিনি দিয়েছিলেন স্পষ্ট ভাষায়। পরিস্কার বলেছিলেন,

 “Education is not necessarily enhancement of marriageable quality of a girl but it is a device to prepare herself to face the world with full confidence.” তিনি আরও লিখেছিলেন,

“... I am entirely responsible for the list of clothes which your correspondent ... considers to be needlessly costly and extravagant. ... because the girls do not require so many things at home, and that there are few Hindu houses in the country where girls possess such a costly wardrobe. ... A boarding institution like Bethune College, cannot possibly be managed in the same style as that a Hindu zenana is managed. ... I venture to think that no ... rule enforcing cleanliness and tidiness prevails ordinarily in Hindu zenana, nor is its importance felt, when women are not called upon to appear before strangers. But it is manifest that such a rule is absolutely necessary ... where ... considerations require that the boarders should dress ... in a decent, respectable and lady-like manner,... they have daily to appear before male professors... Similarly in a boarding school, soap and towels for each girl are indispensable, though I am aware, they are looked upon more as luxuries than as necessaries in Hindu houses. ... when they (the girls) have to walk about during the rains in the garden, to play tennis, and to take outdoor exercise for the sake of their health, I would naturally hesitate to take upon myself the responsibility of allowing them to expose their feet, at the risk of their getting cold or fever.”

 কিন্তু চন্দ্রমুখী বনাম রক্ষণশীল সমাজ, বা এমনকি চন্দ্রমুখী বনাম ব্রিটিশ সরকারের চিঠিপত্র আলোচনা আজ আমার উদ্দেশ্য নয়। যেটা বলতে চাইছি তা হল, প্রয়োজনে চন্দ্রমুখী শক্ত হাতে কলম ধরলেও, অপ্রয়োজনে, ব্যক্তিগত সংবাদ দেওযার জন্য তিনি কিছু লিখেছিলেন, এমন কোনও প্রমাণ আমরা পাই না। তাই 1901 সালে অসুস্থতার জন্য অবসর নিয়ে যখন তিনি দেরাদুন চলে গেলেন, কলকাতার সঙ্গে যেন তাঁর সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ হয়ে গেল। 1903 সালে তিনি বিয়ে করেছিলেন কেশবানন্দ মমগায়েনকে। চন্দ্রমুখী ছিলেন নিঃসন্তান। কেশবানন্দের প্রথম পক্ষের সন্তানদের সাফল্যের পিছনে, তাঁর নিজের এবং সৎ বোনেদের সাফল্যের পিছনে ছিলেন চন্দ্রমুখী। তাঁদের কেউ কেউ কলকাতাতেও পড়তে এসেছেন, এক বোন রাজকুমারী বসু (পরে দাস) বেথুন কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তবু দেরাদুনবাসী চন্দ্রমুখী সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান নিতান্তই সীমিত।

 এ কথা আমার মা সুনন্দা ঘোষের মনে হয়েছিল বেথুন কলেজের শতবর্ষ পূর্তির সময়ে। চন্দ্রমুখীর মতো একজন অসামান্যা মহিলা দেরাদুনে কেমন ভাবে থাকছেন, তিনি কী কী কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কেমন করে সময় কাটাতেন?  2010 সালের মার্চ মাসে মা, আমি আর আমার ন-বছরের মেয়ে, আমরা চললাম দেরাদুনে চন্দ্রমুখীর সন্ধানে। সূত্র বলতে একটুই– চন্দ্রমুখীর বাবা ভুবনমোহন বসু ছিলেন দেরাদুনের Reformed Presbyterian Church-এর সঙ্গে যুক্ত। আমাদের ধারণা হয়েছিল চার্চের রেকর্ড থেকে হয়তো চন্দ্রমুখীর বাড়ি বা আত্মীয়-স্বজনের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। আমরা সেই চার্চ খুঁজে বার করলাম, সেখানে ভুবনমোহন বসুর নামে একটি প্ল্যাক দেখা ছাড়া আর বিশেষ কিছু জানা গেল না। এখন চার্চ যাঁরা দেখাশোনা করেন, তাঁরা এই পরিবার সম্বন্ধে কিছু বলতে পারলেন না।

 দেরাদুনে প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা কম নয়। বহু বহু বছর ধরে, বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে বাঙালিরা এখানে রয়েছেন। বাঙালি থাকলে একটা বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন আর একটা বাংলা লাইব্রেরি থাকতে বাধ্য। অতএব, আমরা সেগুলি খুঁজে বার করলাম। বাংলা লাইব্রেরিতে তখন কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে একজন বললেন, “ও হ্যাঁ, চন্দ্রমুখী বসুর নাম তো আমরা জানি। কিন্তু তাঁর বাড়ি কোথায় ছিল, বা তাঁর পরিবারের কেউ এখনও বেঁচে আছেন কি না, তা তো বলতে পারি না।” তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “চন্দ্রমুখী তো খ্রিস্টান ছিলেন, তাঁর সমাধি কোথায় আছে বলতে পারেন?”

 তিনি বললেন, “সমাধি তো নেই। সমাধির যে জায়গাটা ছিল, সেখানে এখন একটা বহুতল বাড়ি উঠে গেছে।”

 শুনে আমাদের মাথায় হাত। সেই সন্ধেবেলা হোটেলের লবি থেকে ফোনে কথা বলছি, “কেউ মমগায়েন পরিবারের কারওরই কোনও হদিশ দিতে পারছেন না”– হোটেলের ডেস্কে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন হঠাৎ বললেন, “আমি একটি মমগায়েন পরিবারের কথা জানি, যাদের বাড়ি দেরাদুন থেকে 50 কিলোমিটার মতো,  জিৎগাঁও বলে একটা জায়গায়। আপনারা যদি যেতে চান, কালকেই আমি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তবে এঁদেরই কি আপনারা খুঁজছেন?”

 শুনে আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজি। মমগায়েন পরিবার যখন, চন্দ্রমুখীর নিজের পরিবার না হলেও, কোনও না কোনও ভাবে যোগাযোগ থাকা অসম্ভব মোটেই নয়। পরদিনই আমরা চললাম সেই অচেনা জিৎগাঁও-র উদ্দেশ্যে, অজানা মমগায়েন পরিবারের সঙ্গে আলাপ জমাতে। দু-একবার পথ হারিয়ে, আমার পুরো অশুদ্ধ হিন্দিতে একে ওকে তাকে শুধিয়ে ঠিকঠাক বাড়িতে পৌঁছনো ছিল আর একটা অ্যাডভেঞ্চার। তবে বুঝেছিলাম যে ওই অঞ্চলে খ্রিস্টান পরিবার বেশি নেই। আমরা শুধু পদবিটাই জানি, পরিবারের কোনও পুরুষ বা মহিলার নাম তো জানি না। তবুও ‘ঈশাই’ বলতে এক মহিলা বাড়ি দেখিয়ে দিলেন।

 খোলা উঠোনের পরে হলুদ রঙের খামার-বাড়ি, সামনে ঢাকা বারন্দা। আমাদের বলা হল বারান্দা পেরিয়ে সামনের ঘরে বসতে। ঘরে ঢুকতেই দেখি চন্দ্রমুখীর সেই অত্যন্ত-পরিচিত ছবি, আর কোনও সন্দেহ নেই, আমরা ঠিক জায়গাতেই এসে পৌঁছেছি! আরও একটা ছবি দেখতে পেলাম, অনেক গয়না পরা, হয়তো বিয়ের পরে তোলা।

 গৃহস্বামী হলেন চন্দ্রমুখীর প্রপৌত্র-পুত্র, বিজয়ানন্দ। আমাদের আসার উদ্দেশ্য শুনে অবাক। বললেন তাঁর মা চন্দ্রমুখীকে দেখেছিলেন, তাঁর বিয়ের সময়ে চন্দ্রমুখী জীবিত ছিলেন। কিছু পারিবারিক ছবি দেখালেন। বললেন একটা ট্রাঙ্কে কিছু বই রয়েছে, যা উনি পরে দেখাতে পারবেন। কিন্তু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র বা অন্যান্য কাগজপত্র আর কিছু তাঁদের কাছে ছিল না।

 চন্দ্রমুখীর স্বেচ্ছাবসরের পরে এই প্রথম বেথুন কলেজের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও পক্ষ থেকে তাঁর সন্ধানে দেরাদুন পাড়ি দেওয়া হল। হয়তো আরও আগেই যাওয়া উচিত ছিল, তাহলে পরিবারের কারও সঙ্গে হয়তো কথা হতে পারত, যিনি চন্দ্রমুখীকে দেখেছেন। এই প্রাথমিক যোগাযোগ যা আমরা করে আসতে পেরেছিলাম, তার রাস্তা ধরে আরও দু'বার আমার মা এবং বেথুন কলেজের আরও দু’জন প্রাক্তন অধ্যাপক বিজয়ানন্দের সঙ্গে দেখা করেন, চন্দ্রমুখীর স্বাক্ষরিত বই দেখতে পান, চন্দ্রমুখীর পরিচিত জনের সঙ্গেও কথাবার্তা বলা সম্ভব হয়। চন্দ্রমুখীর সমাধিস্থল আছে, সেখানে বহুতল বাড়ি ওঠেনি। স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হওয়ার পরে চন্দ্রমুখীকে বিদ্যাসাগর শেক্সপিয়ার রচনাবলী উপহার দেন নিজের হাতে স্বাক্ষর করে। বিজয়ানন্দের বদান্যতায় সেই বই এত বছর পরে বেথুন কলেজে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।

 আমার সব সময়েই মনে হয়, মেয়েদের স্কুল পেরিয়ে কলেজে যাওয়ার মধ্যে একটা বহুদূরব্যাপী সামাজিক বিপ্লব নিহিত ছিল। এক দিক দিয়ে ছেলেদের জন্য প্রসিডেন্সি কলেজ স্থাপনার চেয়েও হয়তো এর দাম বেশি। ইংরেজ আর দেশীয় মানুষজন ছেলেদের কলেজ-শিক্ষা চেয়েছিলেন প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে। মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পুরোই উল্টো– কেউই চায়নি মেয়েরা কলেজে পড়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক। অথবা নিজের মতো করে ভাবতে শিখুক। চন্দ্রমুখী যে বলেছিলেন, বেথুন কলেজের ছাত্রীরা পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পৃথিবীর সম্মুখীন হবে, উচ্চশিক্ষার মূল কথাই কি সেটা নয়?


New
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?
অল ইজ নট ওয়েল ইন লাদাখ


Other Writings by -শ্রবসী বসু | 04-02-2022

// Event for pushed the video