ঊনবিংশ শতকের প্রথম থেকে বাংলাদেশে মেয়েদের লেখাপড়া এগিয়েছে বিচিত্র ভুজঙ্গগতিতে। কোন কোন মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে, কেন শিখবে, কী শিখবে, কত বয়স পর্যন্ত শিখবে, কার কাছে শিখবে– এই সব তর্ক সেই সময়ের সংবাদপত্র আর সাময়িক পত্রিকার অনেকটা স্থান অধিকার করে থাকত। মেয়েদের স্কুল তৈরি করতে অগ্রগণ্য ছিল Young Bengal গোষ্ঠী। তবে তারা কিন্তু খাস কলকাতা শহরে স্কুল তৈরি করেনি, তাদের স্কুল ছিল উত্তরপাড়া, বারাসত ইত্যাদি স্থানে, কলকাতা থেকে একটু দূরে। জন ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কলকাতায় তৈরি করলেন হিন্দু ফিমেল স্কুল। তাঁর মনে হয়েছিল কিছু লেখাপড়া না শিখলে কলকাতার উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক হিন্দু পরিবারের মেয়েরা কোনওদিনই অবর্ণনীয় দুর্দশা থেকে উদ্ধার পাবে না। 1849 সালের 7 মে কলকাতার সম্ভ্রান্ত পরিবারের 11টি মেয়েকে নিয়ে সুকিয়া স্ট্রিটে এক শুভানুধ্যায়ীর বাড়িতে সেই স্কুল চালু হল। বেথুন সাহেবের স্কুল কলকাতার প্রথম মেয়েদের স্কুল নয়। মিশনারিরা মেয়েদের পড়াবার কিছু কিছু চেষ্টা আগেই করেছিলেন, কিন্তু সে সব স্কুলে কেবল নিম্নবর্ণের দরিদ্র মেয়েরা পড়তে আসত; সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের সেখানে পাঠানো হত না ধর্মান্তরকরণের ভয়ে। যে মেয়েরা পর্দার আড়ালে থেকে যাচ্ছিল তাদের পুরুষ অভিভাবকদের সামাজিক মানমর্যাদা রক্ষা করতে, বেথুন তাঁর স্কুল তৈরি করলেন শুধুমাত্র তাদের কথা ভেবে। কিন্তু অভিভাবকরা কন্যাসন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন কেন? মনে রাখতে হবে রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে পর্দাপ্রথা সেই সময়ে ভয়ানক কড়া, মাত্র 20 বছর আগে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আইন পাশ হয়েছে, বিধবা-বিবাহ আইন তখনও অনেক দূরে। 1849 সালের 23 মে একসভায় অভিভাবকদের আশ্বস্ত করে বেথুন বলছেন, “...(I will be) content to know that they (the girl pupils) have been put in the way of becoming better daughters, better sisters, better wives and better mothers.’’ মেয়েদের যেটুকু শিক্ষা দেওয়া হবে, তা সমস্তই সংসারের উন্নতির জন্যে, মেয়েদের নিজস্ব উন্নতির চিন্তা ছিল স্বপ্নেরও অগোচর। আসলে হিন্দু উচ্চবিত্ত নাগরিক ভদ্রলোক সমাজে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকল, যখন থেকে বাড়ির ছেলেরা সরকারি চাকরি নিয়ে যৌথ পরিবার ছেড়ে বিদেশে যেতে শুরু করল। শ্বশুর-শাশুড়ি বাধ্য হলেন বধূমাতাকে সঙ্গে দিতে। একেবারে ঘোমটা জড়ানো পুঁটুলিকে তো বাড়ি থেকে বাইরে পাঠানো যায় না। অতএব শিশুকন্যার পিতা, শ্বশুর, স্বামী ইত্যাদি অভিভাবকরা তাদের কথঞ্চিৎ শিক্ষার কথা ভাবতে শুরু করলেন।
বয়সে নিতান্ত ছোটো হলে কী হবে, ছাত্রীদের পর্দার আড়ালে রাখা সম্বন্ধে বেথুনকে অনেক সতর্কতা নিতে হয়েছিল। ওই একই সভায় তিনি বলছেন, “In the school house I propose to build ...I shall take care that the arrangements are such that none but the female teachers and attendants can have free access to the school-rooms, so that the children will be taught there, as free from prying curiosity, as in the innermost recesses of their own mothers’ apartments.” অবাক লাগে কি ভাবতে যে, মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর উদ্দেশ্য কখনওই ছিল না তাদের পারিবারিক দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া? সেলাই, বড়ি দেওয়া, রান্না শেখানোর মতোই, খানিকটা বাংলা হরফ, খানিকটা কড়াকিয়া-গন্ডাকিয়ার হিসেব– এইটুকুই ছিল তাদের বরাদ্দ। গোঁড়া হিন্দু পরিবারের মেয়েদের পক্ষে প্রতিদিন, কয়েক ঘন্টা, বাড়ির বাইরে একটা অপরিচিত পরিমণ্ডলে কাটানো, যেখানে কোনও অভিভাবক থাকবে না দেখতে যে, তাদের পায়ের আওয়াজ বা গলার স্বর শোনা গেল কি না– এইটুকুর মধ্যেই নিহিত ছিল বিপ্লবের সূচনা।
প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই বেথুন স্কুল যে পরিমাণ প্রশংসা আর সমালোচনার কেন্দ্র হয়েছিল, তা আর কোনও মেয়েদের স্কুল বোধহয় হয়নি। কিন্তু সেই পরিমাণে ছাত্রীর দেখা মিলছিল না। এমনকি যাঁরা বেথুনকে মুখে সমর্থন করেছিলেন, তাঁরাও কন্যাসন্তানকে বাড়ির বাইরে পাঠাতে সাহস করেননি। বেথুন অসময়ে মারা গেলেন, স্কুলের আর্থিক সমস্যা মেটাতে যাঁরা এগিয়ে এলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন বড়লাট লর্ড ডালহৌসি, স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব প্রথম থেকেই যাঁরা নিয়েছিলেন, তার মধ্যে বিদ্যাসাগর ছিলেন অগ্রগণ্য। লর্ড ডালহৌসি যখন ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেন, তখন স্কুলের আর্থিক দায়িত্ব সরকার নিয়ে নিল। যদিও এদেশের মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইচ্ছে বা পরিকল্পনার মধ্যে কোনওদিনও ছিল না, পাকেচক্রে সেই ঘটনাতেও তারা জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল। কিন্তু স্কুলে ছাত্রী কোথায়?
অথচ অবস্থা এমন নয় যে কোথাও কোনও মেয়েদের স্কুলেই ছাত্রী হচ্ছে না। 1862 সালে সরকারি রিপোর্ট বলছে বেঙ্গল প্রভিন্সে 15টি মেয়েদের স্কুল, আর তাতে সর্বমোট 530 জন ছাত্রী। এক বছরের মধ্যে স্কুলের সংখ্যা বেড়ে হল 35, ছাত্রী সংখ্যা 1183। শেষ পর্যন্ত বেথুন স্কুল বন্ধ করে দেওযা হবে কিনা, সরকারি মহলে সে আলোচনা শুরু হল। বিদ্যাসাগর তাতে আপত্তি জানালেন খুব জোরের সঙ্গে। সেটা 1867 সাল।
1873 সালে অ্যানেট অ্যাক্রয়েড 12 জন মেয়ে নিয়ে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় নামে একটি বোর্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। বোর্ডিং স্কুল হওয়ার ফলে কলকাতার বাইরে থেকে কয়েকজন কিশোরী মেয়ে সেখানে পড়তে এল, কাদম্বিনী বসু যাদের অন্যতমা। এরা বেশিরভাগই ব্রাহ্ম পরিবারের, বেথুন স্কুল যে বনেদি রক্ষণশীল পরিবারের পর্দানসীন মেয়েদের জন্য তৈরি হয়েছিল, এরা তার চেয়ে খানিকটা মুক্তমনা পরিবেশে জন্মেছে। এই মেয়েদের মধ্যে দু’টি বিধবা মেয়েও ছিল। হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ের মেয়েরা ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় ভাল ফল করেছিল, যেখানে বেথুন স্কুলের এমন অবস্থা যে এক-চতুর্থাংশ মেয়েও একটা ছোট গল্প পড়ে তার মানে বুঝতে পারে না। কিন্তু অ্যানেট অ্যাক্রয়েড হঠাৎ বিয়ে করে কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ায় হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ের মেয়েদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
সৌভাগ্যক্রমে মনোমোহন ঘোষ প্রমুখ কয়েক জন বেথুন স্কুলের কমিটি আর হিন্দু (তখন নাম বদলে হয়ে গেছে বঙ্গ) মহিলা বিদ্যালয়ের কমিটি, দু’টিরই সদস্য ছিলেন। তাঁরা দেখলেন বেথুন স্কুলের নিজস্ব প্রকান্ড জায়গা পড়ে রয়েছে, অথচ ছাত্রী নেই বললেই চলে। আর বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের দু’টি ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে প্রায় তৈরি, কিন্তু তাদের স্কুল কীভাবে চলবে বোঝা যাচ্ছে না। সহজ সমাধান, দু’টি স্কুল একসঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যাক। বেথুন স্কুলের প্রায় মৃত শরীরে শুধু যে নতুন প্রাণ এল তাই না, এই এক সিদ্ধান্তের জোরে বেথুন স্কুল এক পদক্ষেপে পাঠশালা থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষার্থিনীদের ভবিষ্যতের পথ খুলে দিল।
কাদম্বিনী বেথুন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিলেন, এবং পাশ করলেন। অন্য মেয়েটি ছিলেন স্বনামধন্যা সরলা দাশ, ভবিষ্যতের সরলা রায়, গোখলে মেমোরিয়াল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। পরীক্ষার আগে আগেই মা মারা যাওয়ায় এবং হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তাঁর আর এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়া হয়ে ওঠেনি। চন্দ্রমুখী তার আগের বছরই দেরাদুন থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করে কলকাতায় এসে F.A. পরীক্ষার জন্য তৈরী হচ্ছেন। এঁদের দু’জনকে আরও উচ্চশিক্ষার পথ করে দিতে মনোমোহন ঘোষ বদ্ধপরিকর। বেথুন স্কুলেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনে কলেজের ক্লাস শুরু হল একজন ছাত্রী, কাদম্বিনীকে নিয়ে। মনোমোহন ঘোষ চেয়েছিলেন চন্দ্রমুখীও বেথুনে চলে আসুন, কিন্তু সেই সময়ে তা সম্ভব হয়নি।
যখন চন্দ্রমুখী এন্ট্রান্স পাশ করেছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর কৃতিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিল, কিন্তু খোলাখুলিভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। কাদম্বিনী স্বীকৃতি পেলেন, কিন্তু কলেজে ভর্তি হতে পারলেন না, কারণ মেয়েদের তো কোনও কলেজ নেই! চন্দ্রমুখী, কাদম্বিনী দু’জনেই উচ্চশিক্ষার পরবর্তী ধাপটি প্রাইভেটে উত্তীর্ণ হবেন, এরকমই অনুমতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে পাওয়া গেল। পাশাপাশি 14 ফেব্রুয়ারী 1879 সালে বেথুন স্কুলে কলেজের ক্লাস শুরু করার অনুমতি পাওয়া গেল সরকারের কাছ থেকে। 16 জুন শশীভূষণ দত্ত প্রথম শিক্ষক হিসেবে বেথুনে যোগ দিলেন।
1880 সালে চন্দ্রমুখী আর কাদম্বিনী দুজনেই F. A. পরীক্ষা পাশ করলেন। কাদম্বিনী পাশ করলেন বেথুন থেকে, চন্দ্রমুখী Free Church Institution থেকে। এবার চন্দ্রমুখী B. A. পড়তে এলেন বেথুনে। 1883 সালে তিনি B.A. আর 1884 সালে M.A. পাশ করে বেথুনে পড়াতে এলেন। তখনও কিন্তু সরকারি ভাবে বেথুন কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমাদন পায়নি। সে ব্যবস্থা হতে হতে 1888 সাল হয়ে যায়। তার আগেই চন্দ্রমুখী Lady Superintendent পোস্টে বহাল হয়েছেন, 1888 সালে তাঁর পদটি স্থায়ী হয়। 1893 সালে তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে বেথুন কলেজের প্রথম প্রিন্সিপ্যাল পদে নিযুক্ত হন। তারও অনেক বছর পরে, 1908 সালে সরকার বেথুন স্কুল আর কলেজের ম্যানেজিং কমিটিকে আইন করে আলাদা করে দেয়। এই সময় থেকে বলা যেতে পারে স্কুল আর কলেজ দু’টি সম্পূর্ণ পৃথক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে।
1849 সালে ছয়-সাত বছরের মেয়েদের আব্রু রক্ষার জন্য বেথুনকে আশ্বাস দিতে হয়েছিল যে, কোনও পুরুষ তাঁর স্কুলের বাচ্চাদের মুখ দেখতে পাবে না। তার মাত্র তিরিশ বছরের মধ্যে 1878 সালে সেই বেথুন স্কুলেই পুরুষ শিক্ষক আসছেন সতেরো-আঠারো বছরের মেয়েদের পড়াতে। শুধু তাই নয়, সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের ধর্ম রক্ষার্থে বেথুন স্কুলে হিন্দু ছাড়া আর কোনও পরিবারের মেয়ের প্রবেশাধিকার ছিল না। কলেজের ক্লাস শুরু হওয়ার সময় থেকেই যে কোনও ধর্মের মেয়েদেরই ভর্তি হওয়ায় আর কোনও নিষেধ রইল না।
শিক্ষা ব্যাপারটা নদীর মতো প্রবহমান, তাকে এক জায়গায় বন্দি করে রাখা অসম্ভব। যতই বিতর্কসভা চলুক যে, মেয়েদের এতটুকুই শেখাব, তার চেয়ে আর একটি বেশি শব্দও তারা শিখবে না, বিজ্ঞান তাদের জন্য নয়, চারুপাঠ আর বোধোদয় পড়ে ধোপার হিসেব লেখাই তাদের পক্ষে যথেষ্ট, তার বেশি শিখিয়ে আর কী লাভ- সে নদীর ভাঙনে বালির বাঁধ। তাই তো 2021 সালেও তালিবান ক্ষমতায় এসেই প্রথমে মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দেয়। নিজেদের জীবন নিজেদের হাতে গড়ে তোলার নিশানায় মেয়েদের প্রথম পদক্ষেপ স্কুল পেরিয়ে কলেজে পা দেওয়া।