ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের পর দেশের নেতারা ঐক্য এবং সংহতি বিধানে মনোযোগী হলেন। তাই রাষ্ট্রনেতারা এমন একটা ভাষা বাছাই করার কথা ভাবলেন, যা গোটা দেশকে একসূত্রে বাঁধতে পারে। বলা হল, সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হতে হবে, সরকারি কর্মীরা সহজে ব্যবহার করতে পারবেন, ওই ভাষা ব্যবহার করে গোটা দেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করা যাবে। অন্য ভাষাভাষী মানুষও এই ভাষা সহজেই শিখতে পারবে। এই সূত্র মেনে হিন্দিকে বাছা হয়। 2011 সালের আদমসুমারি অনুযায়ী দেশের প্রায় 44 শতাংশ মানুষ হিন্দিভাষী। তারপরে দ্বিতীয় স্থানে বাংলা (8 শতাংশ)। তাই 130 কোটিরও বেশি মানুষের দেশে অর্ধেকের কম মানুষের ভাষা হয়েও হিন্দি হয়ে গেল গোটা দেশের জাতীয় ও সরকারি ভাষা।
এই মর্মে সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকর করা শুরু হয় 1965 সালে, আর সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন মাদ্রাজে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয় এর বিরুদ্ধে। ছাত্ররা স্লোগান দেয়, Oppose Hindi imperialism, Hindi never, English ever.
মনে রাখতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকারের এই ভাষানীতির বিরুদ্ধে তামিল ছাত্রদের প্রতিবাদের কারণ সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তারা হিন্দিভাষীদের থেকে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হবে।
আরও মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পর দেশের নেতারা ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠনে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু 1953 সালে প্রথম ভাষাভিত্তিক রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ গঠিত হয় প্রবল গণআন্দোলন ও পট্টি শ্রীরামালুর 56 দিন অনশনে প্রাণত্যাগের পরে। তারপর ধাপে ধাপে ভাষার ভিত্তিতে অন্যান্য রাজ্যের পুনর্গঠন হয়। গোড়ায় 14টা রাজ্য ও সাতটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি হলেও পরে বহু রাজ্য ভেঙে ছোট ছোট রাজ্য গড়ার প্রক্রিয়া চলেছে। এই প্রসঙ্গে আঞ্চলিকতাবাদী রাজনীতির উত্থানের কথা ও ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়, উত্তরাখণ্ডের কথা মনে পড়ে। আবার অনেক ছোট ছোট ভাষা এখনও হিন্দি ভাষার ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছে, যাদের আলাদা করে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। যেমন, মৈথিলি, ভোজপুরি, বুন্দেলি, রাজস্থানী, ছত্তীসগঢ়ী ইত্যাদি। এরা সবাই মাঝে মাঝেই নিজেদের ভাষার স্বতন্ত্র পরিচয়ের স্বীকৃতি দাবি করে আওয়াজ তোলে। যদি এই সব ভাষাকে হিন্দির আওতা থেকে বার করে আনা হয়, তা হলে এক ধাক্কায় হিন্দিভাষীর সংখ্যা অন্তত 20 শতাংশ কমে যাবে।
হিন্দি বিরোধীদের দাবি, সব রাজ্যে (হিন্দিবলয় সহ) ত্রি-ভাষা সূত্র চালু হোক। অর্থাৎ, মাতৃভাষা, ইংরেজি ও তৃতীয় একটি ভাষা। এই নিয়ে সরকারি স্তরে কিছু কথা হলেও হিন্দিভাষী এলাকায় তা প্রয়োগে প্রচণ্ড বাধা আসায় বন্ধ হয়ে যায়।
তার বদলে সরকারি স্তরে হিন্দি ভাষাকে গোটা দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। সত্তরের দশকেই পশ্চিমবঙ্গে কর্মরত কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মীদের হিন্দি শেখার জন্য আর্থিক উৎসাহ দেওয়া শুরু হয়।
রাষ্ট্রনেতাদের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে গণআন্দোলনের চাপে ভাষাভিত্তিক রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের ইতিহাস বুঝিয়ে দেয়, মাতৃভাষা নিছক আত্মপরিচয় নয়, ভাষার সঙ্গে যুক্ত আবেগ জনমানসের আরও গভীরে থাকে। 1971 সালে ভাষা পরিচয়কে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম সেই সাক্ষ্য দেয়। আবার উল্টোদিকে, হিন্দিকে সরকারি ও জাতীয় ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে যদি গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়, তা হলে তা শাসকবর্গের (উত্তর ভারতের গোবলয়ের) হাতই শক্ত করবে। তার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে বহু আঞ্চলিক ভাষা। কারণ, সরকারি ভাষা হিসাবে একবার অ-হিন্দি রাজ্যে সব কাজ হিন্দিতে করা বাধ্যতামূলক হলে, ক্রমে তা আইন আদালতের কাজে, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষা পাঠক্রমে চালু হতে বাধ্য। কিন্তু তা বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি ভাষাকে সরিয়ে হবে না, হবে মাতৃভাষাকে সরিয়ে।
একটা ভাষা সজীব থাকে তার দৈনন্দিন ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। সাধারণ মানুষের আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজ, সেই সঙ্গে সরকারের কাজে ও আদালতের কাজে যদি মাতৃভাষা ব্যবহৃত হয়, সঙ্গে দ্বিভাষী সূত্রে ইংরেজি থাকে, তাহলে এই ভাষাকেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে বেরোনো সম্ভব বলে মনে হয়। তা না হলে, অব্যবহারে জীর্ণ হতে হতে বাংলার মতো উন্নত ভাষাও একসময় মৃত ভাষার তালিকায় নাম লেখাবে, যেমনটি কয়েকশো বছর আগে হয়েছে সংস্কৃতের ক্ষেত্রে।