4thPillar


ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?

রজত রায় | 10-02-2021June 6, 2023
ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?

আদিভূতা সনাতনী, শূন্যরূপা শশীভালি

ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি? (কমলাকান্ত)

 

অতিপরিচিত শ্যামাসঙ্গীতের এই পংক্তিগুলি মনের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। সত্যিই তো, ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পরে কোনও এক সময়ে মানুষের জন্ম, তার পরে নরদেহের বিনাশ থেকে নরমুণ্ড তন্ত্রসাধনায় যুক্ত হল। দেবীর ভূষণ হয়ে গলায় নরমুণ্ড ঝুলল। যদি আবির্ভাবের সময়েই তিনি কপালকুণ্ডলা হয়ে থাকেন, তা হলে তো তাঁর আবির্ভাব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পরের ঘটনা। এমনকী মানুষের জন্মেরও পরের কথা হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই সংশয়টা যে ভক্তিগীতি রচয়িতা ভক্তের মনেও উদিত হয়েছিল, তা গানের ওই পংক্তিগুলি মনে করিয়ে দিচ্ছে। এবং প্রশ্নটা তদাবধি অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছে। মনে সংশয়ও রয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে এই প্রশ্নটি শুধু ভারতীয় দর্শনের একটি পরিক্রমা। কিন্তু অন্য বিচারে এটি আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটা বিষয়ের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। সেটি হল, প্রশ্ন করতে শেখা, শিক্ষিত সংশয়কে প্রশ্রয় দেওয়া।

 

ছাত্রাবস্থায় আমার মাস্টারমশাই দর্শনের অধ্যাপক প্রয়াত পবিত্র কুমার রায়ের সঙ্গে বহু সময় আড্ডায় নানা প্রশ্ন করতাম, তিনিও ধৈর্য সহকারে ব্যাখ্যা করতেন। একবার জানতে চেয়েছিলাম তাঁর নিজের দার্শনিক চিন্তা কোন খাতে বইছে। ডেভিড হিউমের উপর গবেষণা করা পবিত্রদার উত্তর ছিল, Scepticism. এই Scepticism বা সংশয়বাদী চিন্তা কিন্তু দুহাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে দর্শনের জগতে বিরাজমান। তা ভারতীয় দর্শনেই হোক, পশ্চিমী দুনিয়ার গ্রিক দর্শনের জগতেই হোক। অন্য দিক থেকে দেখলে কোনও বিষয়কে প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেওয়ার বদলে নানা প্রশ্ন করে যাচাই করে নেওয়ার এই রীতি না থাকলে বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা আদৌ সম্ভব হত কিনা, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। বিজ্ঞানচর্চাই হোক, বা সমাজবিজ্ঞান চর্চাই হোক, অধীত বিদ্যাকে সংশয়ের দৃষ্টিতে জরিপ করে নেওয়ার রীতি শুধু জ্ঞানচর্চাকেই এগিয়ে যেতে সাহায্য করেনি, সেই সুবাদে মানুষকেও প্রাগৈতিহাসিক গুহামানব থেকে আধুনিক মানুষে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। এই সংশয়বাদী চিন্তা কখন কেথায় কী ভাবে এসে মনকে দুলিয়ে দেবে, তা জানা নেই। তবে অন্ধবিশ্বাসের বিপরীতে প্রশ্ন করে করে, পরীক্ষা করে করে যাচাই না করা পর্যন্ত কোনও আপ্তবাক্যকেই সত্য বলে গ্রহণ না করার এই মানসিকতা আখেরে আমাদের জ্ঞানচর্চাকেই যে এগিয়ে দিয়ে চলেছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তাই যখন ভক্ত সঙ্গীতসাধক প্রশ্ন করে বসেন ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?’ তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই ভক্তও অন্ধবিশ্বাসকে আঁকড়ে না ধরে তাঁর নিজের বিশ্বাসকে যাচাই করতে আগ্রহী।

 

সংশয়বাদের কথা বলতে হলে বিজ্ঞান ও দর্শনচর্চাকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কারণ, এই দুটি ক্ষেত্রেরই প্রাথমিক শর্ত হল, প্রশ্ন করা। ভারতীয় সভ্যতার উষাকালে ঋগ্বেদের সময় থেকেই মনন ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় বিশ্বাসের সঙ্গে সংশয়ের দোলা চলে এসেছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১২৯ সম্বর সূক্তটি (যা নাসদীয় সূক্ত নামে খ্যাত) বলছে:

ন অসদ্ আসীন নো   সদ আসীৎতদানীম

নাসীদ রজো নো ব্যোমাপরো যৎ।

কিম আবরিবঃ কুহ? কস্য শর্মন্নস্তঃ ?

কিম আসীৎ গহনমগম্ভীরম ?

(ঋগ্বেদ: দশম মণ্ডল)

বাংলায় যার অর্থ:                           

তখন অস্তিত্ব বলে কিছু ছিল না। অনস্তিত্ব বলেও কিছু ছিল না। বাতাসও ছিল না, আকাশও না।

তা হলে এ কিসে আবৃত ছিল? কোথায় ছিল? কার রক্ষণাবেক্ষণে?

(ঋগ্বেদ, 10*129*6, এ এল ব্যাশামের ইংরেজি অনুবাদ থেকে)

 

ষড়দর্শন: আস্তিক চিন্তা

সাধারণভাবে আস্তিকের অর্থ ঈশ্বর বিশ্বাসী, নাস্তিক ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু ভারতীয় দর্শনের প্রেক্ষিতে আস্তিক ও নাস্তিক কথা দু’টির নির্দিষ্ট অর্থ আছে।  এখানে আস্তিক অর্থ বেদে বিশ্বাসী (ঈশ্বরে বিশ্বাসী হতেও পারে, না-ও পারে)। আর নাস্তিকের অর্থ, যে বেদকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে না।

 

লক্ষণীয়, ভারতের ষড়দর্শন, যার মধ্যে সাংখ্য, যোগ, ন্যায় বৈশেষিক, পূর্ব মীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা এবং বেদান্ত রয়েছে, সবাই বেদকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে, বা তাতে আস্থা রাখে। তাই এরা আস্তিক। কিন্তু এদের মধ্যে সাংখ্যদর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ন্যায় বৈশেষিকে ঈশ্বরের ভূমিকা গৌণ, নিমিত্ত কারণ মাত্র। কারণ, ঈশ্বর আকাশ ও ধরার অণু সৃষ্টি করেনি, ওগুলো আগে থেকেই আছে বা ছিল। ঈশ্বর শুধু ওগুলো জুড়ে দিয়ে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এ ব্যাপারে বহুপ্রচলিত উদাহরণটি কুমোর ও তার চাক নিয়ে। কুমোর মাটির তাল দিয়ে কাঠের চাকের উপর ঘুরিয়ে বাসনকোসন তৈরি করে, কিন্তু মাটি ও চাক বানায় না। আবার পূর্ব মীমাংসার দার্শনিকরা, যেমন জৈমিনি, শবরস্বামী, কুমারিল ভট্টরা মনে করেন, কোনও ঈশ্বর বা ভগবান ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি বা ধ্বংস করেন না। কারণ, গোটা ব্রহ্মাণ্ড কখনও একসাথে ধ্বংস বা সৃষ্টি হয় না। সবসময় এর কোনও একটা ক্ষুদ্র অংশ জন্মাচ্ছে, এবং ধ্বংস হচ্ছে। অনেক পরে বিজ্ঞান বলবে matter ও energyর লয় নেই। তাঁদের আরও বক্তব্য, দেবতা বলে কিছু নেই। তাই মন্ত্র পড়ে নিবেদন করলেও দেবতা এসে প্রসাদ খেয়ে যায় না। তবে বেদ অভ্রান্ত। কারণ, বেদে যে সব যজ্ঞ বা অনুষ্ঠানের কথা হয়েছে, তা সত্যি। যেমন, পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করলে পুত্রলাভ হয়। মারণ উচাটন করলে শত্রু নিপাত হয়। কুমারিল ভট্ট পরিহাস করে বিশ্বাসীদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, এমন অসাম্য ও শয়তানিতে ভরা দুনিয়া কোনও সর্বশক্তিমান পরমকারুণিক ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে কে বিশ্বাস করতে পারে?

 

এ দিকে উত্তর মীমাংসা বা বেদান্তের ঋষি বাদরায়ণ বলেন, পরমব্রহ্ম কল্পকালে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন। কেন করেন? আমরা বুঝব না। এ সব হল বিধাতার লীলা। ঈশ্বর ভাবলেন-- অনেকদিন একা আছি। এবার বহু হব। এক থেকে অনেক হব। একোহং বহুস্যাম।

 

অদ্বৈত বেদান্তের প্রবক্তা শঙ্করাচার্য বলেন, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। আসলে জগৎ বলে কিছু নেই। যেন পি সি সরকারের ম্যাজিক। রজ্জুতে সর্পভ্রম।  দেখাচ্ছে দড়ি, কিন্তু দেখছি সাপ। কেন? কারণ, আমাদের চোখে অবিদ্যাজনিত মায়াকাজল পরানো। তাই মরুভূমিতে ধূ ধূ বালিয়াড়িতে মিষ্টি জলের পুকুর দেখি। ভালো করে কাজল মুছে ড্যাব ড্যাব করে তাকালেই দেখব এ সংসার ধোঁকার টাটি।

 

তবে খোদ শঙ্করাচার্যও সংশয়মুক্ত নন। তাঁর সন্দেহ, সবাই নিজের নিজের ধান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছেলেরা খেলে বেড়ায়, তরুণের দল তরুণীতে অনুরক্ত, বুড়োর দল গালে হাত দিয়ে চিন্তায় ডুবে থাকে, পরমব্রহ্ম নিয়ে কে আর মাথা ঘামায়?

‘বালকাঃ সর্বে ক্রীড়াসক্তা, তরুণাঃ সর্বে তরুণীরক্তা,

বৃদ্ধাসর্বে চিন্তাবিলগ্নঃ, পরমব্রহ্মপরকোঅপিমগ্নঃ?’

রামকৃষ্ণদেব বলেন, এ হল মজার কুঠি, আমি খাই দাই আর মজা লুটি। রামকৃষ্ণ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী। মনে করেন, ঈশ্বর সত্য, এবং তাঁর প্রতিচ্ছায়া হিসাবে জগৎও সত্য। অর্থাৎ, এক দিক থেকে শঙ্করাচার্যের মতো মায়ার আলোকে জগৎকে তিনি মিথ্যা বলে নস্যাৎ করে দেন না। (কথামৃত)

 

মজার ব্যাপার হল, এত ভিন্ন ভিন্ন মত, অথচ সবারই দাবি যে ওঁদের ব্যাখ্যা অভ্রান্ত। যেন সিপিআই, সিপিএম এবং দশ রকমের এমএল, সবাই দাবি করছে যে তারাই আগমার্কা সাচ্চা কমিউনিস্ট।

ফলে, বেদকে অভ্রান্ত মেনে নিয়েও এঁদের মধ্যে বিতর্ক বাধে যে সব বিষয়ে, সেগুলি:

1) বেদ অভ্রান্ত হলেও তা থেকে এটা প্রমাণ হয় না যে কোনও সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর আছে (সাংখ্য ও যোগ)

2) মেনে নেওয়া যায় যে ঈশ্বর আছেন, কিন্তু তিনি আকাশ, পরমাণু ইত্যাদি সৃষ্টি করেননি। (ন্যায় বৈশেষিক)

3) ঈশ্বর ব্যাপারটাই অপ্রামাণ্য, তবে বৈদিক মন্ত্রের ম্যাজিক শক্তি আছে (পূর্বমীমাংসা),

4) ঈশ্বর আছেন, আমরা যা কিছু দেখছি, সবই তাঁর সৃষ্টি, তাঁর লীলা। তিনি না চাইলে গাছের পাতাও নড়ে না। (উত্তরমীমাংসা বা বেদান্ত)

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ঈশ্বরবাদী বটে, কিন্তু শুরু হচ্ছে এই মৌলিক প্রশ্নটি দিয়ে— আদি কারণ কী? ব্রহ্ম? আমরা কখন এসেছি? কীসে বাঁচি? আমরা কিসে প্রতিষ্ঠিত? অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তা হিসাবে ঈশ্বরের ভূমিকা ও অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করলেও এই প্রশ্নগুলির মতো বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়েই আস্তিক্যবাদীদের মনেও সংশয় উঁকি মারে।

 

অবশ্যই আস্তিক দর্শনের বিরুদ্ধ মতও আছে। ভারতীয় দর্শনের জগতে তর্কবিতর্কের যে ধারা বহমান ছিল সেখানে বিতর্কে নেমে প্রথমেই বিরুদ্ধমতটি ঠিকমতো পেশ করাটাই রীতি, যাতে বোঝা যায় যে এঁরা বিপক্ষের বক্তব্য ও যুক্তিকে ঠিকমতো বুঝতে পারছেন এবং নিজেদের বক্তব্য পেশ করে বিপক্ষের মতকে খণ্ডন করার সময় বিরুদ্ধমতের যুক্তি ও বক্তব্যকে ঠিকমতো উপস্থাপন করছেন। এই যে বিরুদ্ধমতকে প্রথমে পেশ করা, একে বলে পূর্বপক্ষ, তার পরে তাকে খণ্ডনের প্রয়াসকে বলে উত্তরপক্ষ। প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চায় এই রীতি মেনে চলা হত। মত বিনিময়ের, তর্কবিতর্কের এই ধারাকেই অমর্ত্য সেন তাঁর আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান বইয়ে ভারতের ইন্টেলেকচুয়াল ট্র্যাডিশন হিসাবে তুলে ধরেছিলেন।

তবে ব্যতিক্রম কি ছিল না? ছিল। জনক রাজার সভায় বিতর্কসভায় যাজ্ঞবল্ক্য ও গার্গীর সেই বিখ্যাত বিতর্ক মাঝপথে থামিয়ে শেষ হয়েছিল যাজ্ঞবল্ক্যের সতর্কবাণী দিয়ে— আর প্রশ্ন করো না গার্গী, তা হলে তোমর মস্তক খসে পড়বে (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)।

 

নাস্তিক দর্শন: চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন

চার্বাক

আস্তিক্যবাদী ষড়দর্শনের বাইরে থাকা নাস্তিক দর্শনের কথায় প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে চার্বাকদের প্রসঙ্গ। চার্বাকদের দার্শনিক চিন্তার কোনও প্রামাণ্য গ্রন্থ পাওয়া যায় না। তবে চার্বাকদের বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমালোচনা থেকে তাদের চিন্তাধারার একটা আভাস পাওয়া যায়। চার্বাক কথাটির উৎপত্তি সম্ভবত ‘চারু-বাক’ বাক্যবন্ধ থেকে। অর্থাৎ, চার্বাকপন্থীরা যুক্তিশৈলীতে মানুষের মন জয় করতে পটু ছিলেন। মনে রাখা যেতে পারে মোটামুটি একই সময়ে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব 500 বছর নাগাদ গ্রিসে সোফিস্ট (Sophist) নামে একটি চিন্তাধারার জন্ম হয়েছিল। এরাও যুক্তিশৈলী বিস্তারে ও বাকপটুতার জন্য খ্যাত। sophist কথাটি এসেছে sophia থেকে, গ্রিক ভাষায় sophia কথাটা জ্ঞানীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত। (ইংরেজি sophistication কথাটির উৎসও এই sophists এবং  sophistry থেকে।)

যাই হোক, বিরুদ্ধ মতানুলম্বীরা চার্বাকদের পরিচয় দিতে গিয়ে যে “ঋণং কৃত্যা, ঘৃতং পিবেৎ, যাবজ্জীবৎ সুখং জীবেৎ” অভিধা দেন, তা আদতে ব্যঙ্গ ও শ্লেষের প্রকাশ। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লোকায়ত দর্শন নিয়ে দীর্ঘ গবেষণায় দেখিয়েছেন, চার্বাকরা আসলে ষড়দর্শনের ঈশ্বরসম্পর্কীয় মৌলিক প্রতিপাদ্যগুলিকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। তাঁদের বক্তব্য ছিল,

1. স্বর্গ ও  মোক্ষ ফাঁকা কথা। কোনও আত্মা দেহ ছেড়ে অন্য দুনিয়ায় যায় না। যাগযজ্ঞ, আচার অনুষ্ঠান আদতে কিছু মানুষের পেট চালানোর কায়দা।

2. যদি যজ্ঞে পশু বলি দিলে সেই পশুটি স্বর্গে যায়, তা হলে পুরোহিত নিজের বাবাকে বলি দিয়ে স্বর্গে তাঁর জায়গা পাকা করলেই পারেন।

3. যদি শ্রাদ্ধ করলে মৃত ব্যক্তির আত্মা খেয়ে তৃপ্ত হয়, তা হলে তো নিভে যাওয়া প্রদীপে শুধু তেল ঢাললেই জ্বলে ওঠার কথা। বাড়ি ছেড়ে দূরে বেড়াতে গেলে সঙ্গে খাবার নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। বাড়ির লোকজন শ্রাদ্ধ করলেই ব্যক্তির পেট ভরে যাওয়া উচিত।

4. বেড়াতে যাওয়া ব্যক্তি যেমন নিজের পরিবারের কাছে ফিরে আসে, তেমনই দেহ ছেড়ে যাওয়া আত্মা কেন ফিরে আসে না? আজ অবধি তো স্বর্গ থেকে কাউকে ফিরতে দেখা যায়নি।

5. সম্ভবত,এ সব পূজাপাঠ, যজ্ঞ ইত্যাদি ব্রাহ্মণদের নিজেদের স্বার্থে তৈরি। বৈদিক অনুষ্ঠানে মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য পূজাপাঠ, অশ্বমেধ যজ্ঞের যজমানের স্ত্রীর নিহত অশ্বের লিঙ্গ গ্রহণ এবং তিন বেদের মধ্যে জর্ভরি তুর্ফারি গোছের অর্থহীন শব্দ, এ সব শঠ পুরোহিতদের অর্থ আদায়ের জন্যে কারসাজি ছাড়া কিছু নয়।

মৃতব্যক্তির আত্মা সংক্রান্ত প্রশ্নটি নিয়ে আমার মনেও ধন্দ রয়েছে। আত্মা তো নিত্যশুদ্ধ, বাক্য ও মনের অতীত, কখনই অশান্ত, অতৃপ্ত, ক্ষুধার্ত, পাপে লিপ্ত হয় না। তা হলে সেই আত্মার শান্তির জন্য শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, সংবাদপত্রে “তুমি যেখানেই থাকো, শান্তিতে থেকো, ভালো থেকো” বলে বিজ্ঞাপন দেওয়ার অর্থ কী?

 

বৌদ্ধমত কী বলছে ?

বৌদ্ধমত হল ক্ষণিকত্ববাদী। তা থেকেই স্পষ্ট, বৌদ্ধরা কোনও শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় সত্যে বিশ্বাসী নন। সে হিসাবে এঁরা বেদান্তের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। বেদান্তের মতে, যা কিছু ক্ষণিক, যা পরিবর্তনশীল, তা অসত্য বা মিথ্যা। ব্রহ্মই একমাত্র শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় স্থায়ী বস্তু, তাই সত্য। তবে অষ্টম শতাব্দীতে বেদান্তের উদ্গাতা শঙ্করাচার্যও পরমব্রহ্মকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আগে জগৎকে মায়াময় বলে অস্বীকার করেন। সে জন্যই শঙ্করাচার্যকে ‘প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ’ বলা হয়।

বৌদ্ধমতে কোনও কিছু যে স্থায়ী হয় না, সবই ক্ষণিক, এটাই অন্তিম সত্য। বৌদ্ধদের এই যুক্তি বোঝাতে তাঁরা উদাহরণ দেন, বহমান নদীতে একই জলে যেমন দু’বার অবগাহন করা সম্ভব নয়, তেমনই কোনও কিছু স্থায়ী হতে পারে না। সব জিনিসই কার্যকারণের চক্রে জন্মাবে, বর্ধিত হবে এবং বিনাশপ্রাপ্ত হবে। মনে রাখতে হবে,গৌতম বুদ্ধ নিজে আত্মা, ঈশ্বর ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করতে আগ্রহী ছিলেন না। অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিতে বুদ্ধদেবের ঈশ্বর সম্বন্ধীয় বক্তব্য দেখা যেতে পারে-

1. এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হত, তা হলে এখানে কোনও পরিবর্তন, ধ্বংস, সুখ, দুঃখ, বিপর্যয়, ঠিক বা ভুল কিছুই হত না। কারণ সবকিছুই, পবিত্র হোক বা অপবিত্র, সবই ঈশ্বরের থেকে হত।

2. তা হলে ঈশ্বরও সুখ, দুঃখ, ঘৃণা, ভালবাসা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতেন। সে ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে এবং নির্গুণ গুণময় বলি কী করে?

3. যদি ঈশ্বর সৃষ্টিকর্তা হন এবং সব কিছু তাঁর ইচ্ছেতেই হয়, তা হলে আলাদা করে আমাদের “ভাল হয়ে চলি” আচরণ অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ, উনিই তো ভালমন্দ নির্ধারণ করছেন। যদি এমন ভাবা হয় যে সব ভাল’র কারণ উনি, আর সব মন্দ’র বা দুঃখকষ্টের কারণ অন্য কেউ, তাহলে তো এমনও ভাবা যায় যে সেই অন্য কেউই আসল সৃষ্টিকর্তা, ঈশ্বর নন।

4. যদি ঈশ্বর সত্যিই সৃষ্টিকর্তা হন, তাহলে তাঁর উদ্দেশ্য কী? যদি তিনি কোনও উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে তিনি সর্বগুণসম্পন্ন, সর্বশক্তিমান নন। (কারণ, কেউ কোনও উদ্দেশ্যে কিছু করছে মানেই তার কোনও কিছু একটার অভাব রয়েছে। আর যার অভাব রয়েছে, সে আর যাই হোক, সর্বগুণসম্পন্ন, সর্বশক্তিমান হতে পারে না।) নইলে, এমন অসম্পূর্ণ বিশ্ব সৃষ্টি হত না। যদি বিনা উদ্দেশ্যে খামখেয়ালে বিশাল ব্রহ্মাণ্ড নির্মাণ করে থাকেন, তাহলে উনি হয় পাগল বা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো আচরণ করছেন।

বলা ভাল, বুদ্ধের হাজার বছর পরে বৌদ্ধদর্শনের মহাযানী মতবাদে আবার একটু একটু করে জাঁকিয়ে বসে আত্মা, জন্মান্তরবাদ ইত্যাদি। যার ফলে আমরা পেলাম জাতক কথা। কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেন গ্রিক রাজা মিনান্দারকে বোঝান যে বৌদ্ধদর্শনের আত্মার ধারণা মোটেই ব্যক্তি আত্মার নতুন জন্মে বিশ্বাস করে না। এক দেহ পরিত্যাগ করে অন্য দেহে অধিষ্ঠান করায় (পুরনো জামা ছেড়ে নতুন জামা পরার মতো) বিশ্বাস করে না। Transmigration of Souls নয়, বরং বুদ্ধদেবের কথাই ছিল--আত্মদীপো ভবঃ। নিজেকে প্রদীপ করে তোলো। জ্ঞানপ্রদীপ। তার আলোয় পথ চলো।

প্রমাণবার্তিক রচয়িতা বৌদ্ধ দার্শনিক আচার্য ধর্মকীর্তি ঘোষণা করেন যে বর্ণাশ্রমে আস্থা, বিশেষ নদীতে স্নান করলে এবং দান করলে পুণ্যার্জন হয় বলে বিশ্বাস, কোনও পুস্তককে অভ্রান্ত মানা এবং দেহহীন আত্মায় বিশ্বাস- এ সবই মূর্খতার পঞ্চ লক্ষণ

 

জৈনধর্ম

জৈনধর্ম আদ্যন্ত নিরীশ্বরবাদী। ওরা কোনটা ‘আত্মা’ আর কোনটা ‘অনাত্মা’ এই বিতর্কে অনেক কালক্ষেপ করে। ওদের ‘স্যাদবাদ’য়ে (Relativity of knowledge) সংশয়বাদী চিন্তার চরম প্রতিফলন দেখা যায়। স্যাদবাদের মূল কথা, যে কোনও বস্তু বা তত্ত্বকে (স্যাৎ এর অর্থ-- হয়তো) হয়তো আছে বা হয়তো নেই (স্যাৎ নাস্তি) বলে বর্ণনা করা যায়। জৈনদের মতে, যে কোনও বস্তুর অসংখ্য গুণ থাকে। অপূর্ণ বা সসীম মানুষের পক্ষে বস্তুর সব গুণ অনুধাপন করা কঠিন। একমাত্র সর্বজ্ঞ ব্যক্তি তাঁর বিশেষ জ্ঞানের (absolute knowledge) সাহায্যে সম্যক অনুধাবন করতে পারেন। উদাহরণ হিসাবে একাধিক অন্ধ ব্যক্তির হস্তী দর্শনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে সবাই আপেক্ষিক সত্য বলছে। এ ভাবে দেখলে মনে হয়, জৈনদর্শনের মূলেই রয়েছে সংশয়ের দোলা।

বিশিষ্ট জৈন দার্শনিক গুণরত্ন ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে অনেক যুক্তি দিয়েছেন। তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। বিনা উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ কোনও কাজ করে না। তা হলে ঈশ্বরের ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? গুণরত্নের মতে মাত্র ছয় রকম উদ্দেশ্য সম্ভব।

1. খেয়াল, 2. জীবাত্মার নিয়তির ফল, 3. করুণা, 4. লীলা, 5. জীবকে শান্তি বা পুরস্কার দেওয়া এবং 6. প্রকৃতি বা স্বভাব। গুণরত্ন মনে করেন, এর কোনওটিই ধোপে টেকে না।

 

তিনি বলেন, খেয়ালি হলে বাচ্চাদের মতো হবেন, কখনও দর্শন দেবেন, কখনও  দেখা দিয়েই লুকিয়ে পড়বেন। এটা কি ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে মেলে? দ্বিতীয়টি (জীবাত্মার নিয়তির ফল) মেনে নিলে বুঝতে হবে ঈশ্বর স্বাধীন নন। উনি অন্যের নিয়তি দ্বারা চালিত। আবার ঈশ্বর যদি সত্যিই করুণাময় হন, তা হলে জগতে এত দুঃখ, এত অন্যায় দেখা যেত না। গুণরত্নের প্রশ্ন, লোকে যদি তাদের পূর্বজন্মের কাজের ফলে এই জন্মে কষ্ট পায়, তা হলে ঈশ্বরের ভূমিকাটি কী? ওঁর কি স্বাধীন ইচ্ছা বা ক্ষমতা নেই? যদি ওঁর সৃষ্টিকার্য অন্যদের ভাগ্য বা নিয়তির পরিণাম হয়, তা হলে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা তো অন্যের নিয়তি! ঈশ্বরের দরকার কোথায়? যদি সৃষ্টির উদ্দেশ্য লীলা হয়, তা হলে বুঝতে হবে ওঁর শিশুসুলভ আসক্তি আছে। উনি নির্গুণ নন। আর যদি ঈশ্বর পুরস্কার বা শাস্তি দেওায়র জন্য কিছু সৃষ্টি করে থাকেন, তা হলে বুঝতে হবে যে তিনি আসক্তি, ক্রোধ ও ঘৃণার বশ। তা হলে তিনি কী রকম ঈশ্বর ?

সংশয়বাদী চিন্তার বিস্তারকে বুঝতে ভারতীয় দর্শনের অঙ্গনে এই যে সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা করা হল, তার সঙ্গে ইউরোপীয় দর্শনের জগৎ, বিশেষ করে গ্রিক দর্শনের দিকেও একটু তাকানো যেতে পারে।

 

গ্রিক দর্শনে সংশয়বাদী চিন্তা

বৌদ্ধদের অন্তত একশো বছর আগে গ্রিসে এপিকিউরাসের হাত ধরে সংশয়বাদী (scepticism) চিন্তার উদ্ভব। প্লেটোর পরে জগতে এসে তাঁর দর্শনচিন্তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এপিকিউরাস কিন্তু জগৎ সম্পর্কে তাঁর চিন্তায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্যের উপরেই জোর দেন, অতীন্দ্রিয় বোধে আস্থা রাখেন না। তাঁর কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন সব তথ্যকেই তিনি সত্য বলে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তাঁর নীতিবাক্যগুলি এই রকম:

ঈশ্বরকে ভয় পেয়ো না।

মৃত্যু নিয়েও অযথা চিন্তা কোরো না।

বৌদ্ধদের মতোই এপিকিউরাসও ঈশ্বরের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দিহান। তাঁর বিখ্যাত ধাঁধা (Epicurean Puzzle) দেখলেই তা বোঝা যায়।

 

Epicurean Paradox

God, he says, either wishes to take away evils, and He is unable, or He is able and is unwilling; or He is neither willing, nor able; or He is both willing and able. If He is willing and is unable, then He is feeble, which is not in accordance with the character of God; if He is able and unwilling, then He is envious, which is equally at variance with (the character of) God if He is neither willing nor able, then He is both envious and feeble; and therefore, not God. If He is both willing and able, which alone is suitabe to God, from what source then are evils? Or, why does He not remove them? 

বাংলায় তা অনেকটা এইরকম:

ঈশ্বর হয় শয়তানকে সরিয়ে দিতে আগ্রহী, কিন্তু তা করতে অক্ষম, বা  তিনি তা করতে সক্ষম, কিন্তু অনাগ্রহী। অথবা, তিনি ইচ্ছুকও নন, সক্ষমও নন। বা, তিনি ইচ্ছুকও বটে, সক্ষমও বটে। এখন যদি তিনি আগ্রহী হয়েও শয়তানকে সরিয়ে দিতে অক্ষম হন, তা হলে তিনি অবশ্যই দুর্বল, যা কিনা ঈশ্বরের গুণাবলীর সঙ্গে খাপ খায় না। যদি তিনি ক্ষমতাধর হয়েও শয়তানকে সরাতে অনিচ্ছুক হন, তা হলে তিনি ঈর্ষাপরায়ণ, সেটাও ঈশ্বরের চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। আবার যদি ঈশ্বর ইচ্ছুকও না হন, সক্ষমও না হন, তা হলে একইসঙ্গে ঈর্ষাপরায়ণ এবং দুর্বল বলে প্রতিপন্ন হন, সে ক্ষেত্রে তিনি আর ঈশ্বর নন। অন্যদিকে, যদি তিনি একইসঙ্গে শয়তানকে সরিয়ে দিতে ইচ্ছুক এবং সক্ষম হয়ে থাকেন, একমাত্র তা হলেই তাঁর গুণাবলী ঈশ্বরের উপযুক্ত হয়, তা হলে শয়তান কোথা থেকে জন্ম নিল? আর ঈশ্বর কেন শয়তানকে সরিয়ে দিচ্ছেন না? 

কার্ল মার্কসের ছাত্রাবস্থায় পিএইচডি গবেষণার বিষয়বস্তুও ছিল দুই গ্রিক দার্শনিক ডিমোক্রিটাস ও এপিকিউরাসের মধ্যে তুলনা বিচার করে দেখা।

অনেক পরে আর এক সংশয়বাদী দার্শনিক স্কটল্যান্ডের ডেভিড হিউম (1711- 1776) এপিকিউরাসের কথারই প্রতিধ্বনি করে বলেন:

Epicurus’ arguments are yet unaswered. Is He willing to prevent evil, but not able? Then, He is impotent. Is He able but not willing? Then is He malevolent? Is He both able and willing? Whence then is the evil? (Dialogues concerning Natural Religion, 1779)

বঙ্গানুবাদ- এপিকিউরাসের যুক্তিগুলির বিরুদ্ধে এখনও কোনও উত্তর মেলেনি। ঈশ্বর কী শয়তানকে ঠেকাতে আগ্রহী, কিন্তু অক্ষম? তা হলে তো তিনি অক্ষম, নপুসংক। তিনি কি সক্ষম, কিন্তু অনিচ্ছুক? তা হলে তিনি দুষ্টপ্রকৃতির। তিনি যদি সত্যিই সক্ষম ও আগ্রহী হয়ে থাকেন, তা হলে শয়তান কোথা থেকে এল? 

 

এপিকিউরাসের অনেক পরে যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও তিনশ বছর পরে সেক্সটাস এমপিরিকাস (Sextus Empiricus)  নামে আর এক গ্রিক দার্শনিক এই সংশয়বাদী চিন্তার সপক্ষে জোরালো যুক্তিবিস্তার করেন। তাঁর কিছু বই সংরক্ষিত হওয়ার কারণে পরবর্তী কালের দার্শনিকরা কেউ কেউ তাঁর চিন্তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। যেমন রেনে দেকার্ত, ডেভিড হিউম ও নিৎশে প্রমুখ।

অর্থাৎ, ভারতীয় দর্শনের মতোই ইউরোপীয় দর্শনেও সংশয়বাদী চিন্তা বহু আগে থেকেই শিকড় গাড়তে শুরু করেছিল। গোড়াতেই বলেছি, দর্শনশাস্ত্র ও বিজ্ঞানের চর্চায় সংশয়বাদকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কারণ, দুটি ক্ষেত্রেই জ্ঞান চর্চার প্রাথমিক শর্ত প্রশ্ন করা। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও এবং ডারউইনের মতো বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন করা থেকে পিছিয়ে আসেননি বলেই জগৎ সম্পর্কে মান্ধাতার আমলের দৃষ্টিভঙ্গি খারিজ হয়ে যায়। ফলে,সৃর্য্য আর পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় নয়, বরং পৃথিবী ও সৌরমণ্ডলের অন্যান্য গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। বাইবেল বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বকে বাতিল করে জীবজগতের বিবর্তনের তত্ত্ব স্বীকৃতি পায়। কোপার্নিকাস (1473-1543) ও গ্যালিলিও (1564- 1642)-র কিছু পরে ফ্রান্সে রেনে দেকার্ত (1596-1650) নামে এক গণিতবিজ্ঞানী তথা দার্শনিক এসে প্রশ্ন করার বিষয়টিকে আর এক ধরনের মান্যতা দিলেন। দেকার্তের বিখ্যাত যুক্তি cogito ergo sum (I think, therefore, I exist) এক ধাক্কায় জ্ঞানচর্চাকে আধুনিক করে তুলল। কী ভাবে এই যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটল?

 

দেকার্ত তাঁর জ্ঞানচর্চায় বিশুদ্ধ জ্ঞান (Perfect Knowledge) উপলব্ধ করার পদ্ধতি হিসাবে সন্দেহ (doubt)কে হাতিয়ার করেন। তাঁর কাছে, সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তের (certainty) বিপ্রতীপ অবস্থানে রয়েছে সন্দেহ(doubt)এ প্রসঙ্গে দেকার্তের ব্যাখ্যা একজন স্থপতির উদাহরণ দিয়ে তৈরি। স্থপতিকে অট্টালিকা নির্মাণের আগে ভিত তৈরি করতে হয়। সে জন্য জমির উপরিভাগের নরম মাটি, বালি ইত্যাদি সরিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে জমির গভীরে পাথরের স্তরে পৌঁছতে হয়, তেমনই দেকার্তও যা কিছু সন্দেহজনক তা একে একে বর্জন করে তারপরে বিশুদ্ধ জ্ঞানে পৌঁছতে চেষ্টা করেন। এটাই দেকার্তের মেথড অব ডাউট নামে বিখ্যাত। অর্থাৎ, বিশুদ্ধ জ্ঞান নির্মাণের জন্য তিনি সেই সংশয়বাদী চিন্তাকেই হাতিয়ার করতে চেয়েছেন।

 

এই সংশয়বাদী চিন্তা পদ্ধতি অবলম্বন করে দেকার্তের জ্ঞান নির্মাণের প্রথম ধাপ cogito ergo sum (I think, therefore, I exist)দেকার্তের মতে, এই যে মেথড অব ডাউট প্রয়োগে নিজের অস্তিত্বকে প্রামাণ্য হিসাবে দেখার প্রক্রিয়ায় এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে কূটচিন্তায় আমার শরীরের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হলেও আমার চিন্তা করার ক্ষমতাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। এই ভাবে দেকার্ত দর্শনের চিন্তায় শরীর ও মনের দ্বৈত সত্তার ধারণার অবতারণা করেন। রোমান ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম হওয়া দেকার্ত তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়ই ফ্রান্সের বাইরে হল্যান্ডে কাটান, এবং তাঁর মৃত্যুও হয় সুইডেনে। ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশে তখনও রোমান ক্যাথলিকরা তাঁদের ধর্মবিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গীকে কেউ প্রশ্ন করছে বা আঘাত করছে দেখলেই ধর্মদ্রোহী বলে চিহ্নিত করে শাস্তি দিত। অনেক সময়ই পুড়িয়ে মারা হত। কোপার্নিকাসের মতবাদ অনুযায়ী পৃথিবী সূর্যের চারদিক প্রদক্ষিণ করে বলে  যে চিন্তা (heliocentricism), তারই ভিত্তিতে গ্যালিলিওর গবেষণাগ্রন্থ বেরোলে তা ক্যাথলিক চার্চ খারিজ করে। 1615 সালে রোমান ইনকুজিশন গ্যালিলিওকে আজীবনের জন্য গৃহে অন্তরীণ করে। গ্যালিলিওর এই পরিণতি দেখে সতর্ক দেকার্ত বহির্জগৎ সম্পর্কে তাঁর গবেষণার বই দেশের বাইরে অনেক সাবধানে প্রকাশ করেন। আর বার বার ভ্যাটিক্যানকে লেখেন একটু সদয় হতে। বলেছিলেন, উনি আসলে যা করছেন, তা হল যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা। যাতে যারা বাইবেলকে মানে না ও যুক্তির কথা বলে, তারাও ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। তবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে দেকার্তের যুক্তিবিন্যাস চক্রজালে জড়িয়ে পড়ে। তাঁর মতে, এক নিখুঁত, সর্বাঙ্গসুন্দর ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিদ্যমান, কারণ তাঁর অস্তিত্ব অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে জানা যায়। আবার এই যে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞান (যেমন ঈশ্বরের অস্তিত্ব) জ্ঞাত হওয়া সম্ভব, তার কারণ এক সর্বাঙ্গসুন্দর নিখুঁত ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিদ্যমান।

 

ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে দেকার্তের যুক্তিবিন্যাস চক্রজালে জড়িয়ে পড়লেও তাঁর প্রিন্সিপলস অব ফিলজফি বইটির ফরাসি অনুবাদের গোড়াতেই রয়েছে ভূমিকার বদলে অনুবাদকের উদ্দেশে লেখা এক দীর্ঘ চিঠি। ওই চিঠিতেই তিনি বললেন যে একমাত্র ঈশ্বরই পরমজ্ঞানী। সমস্ত বিষয়ের সঠিক জ্ঞাতা। কিন্তু মানুষও কমবেশি সমস্ত মহত্ত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ধর্মের শৃঙ্খলে তখনও ইউরোপের চিন্তার জগৎ শৃঙ্খলিত। তা সত্ত্বেও দেকার্ত ঈশ্বরের পাশাপাশি মানুষকেও সমমর্যাদার আসনে বসাতে আগ্রহী। সেদিক থেকে দেকার্ত রেনেসাঁর সার্থক উত্তরসূরি।

 

আবার এই যে সন্দেহকে হাতিয়ার করে প্রতিটি বিষয়কে প্রশ্ন করে করে প্রমাণাভাবে খারিজ করে করে সত্যের সন্ধানে এগনোর প্রস্তাব, তা দর্শনের জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। দেকার্ত বললেন, প্রশ্ন করো সব কিছুকে, সন্দেহ করো সমস্ত আপ্তবাক্য ও গুরুবাক্যকে। কাউকে রেহাই দিও না, এমনকি স্বয়ং ঈশ্বরকেও না। অর্থাৎ, যুগ যুগ ধরে মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে বলেই সে সব বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া যায় না। এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্বও শুধু বাইবেলে আছে বলেই মেনে নেওয়া যায় না। দেকার্তের উদাহরণ, একটা ঝুড়ি ভর্তি আপেল থেকে পচা আপেলগুলো বাদ দিতে হলে প্রথমেই ঝুড়িটা উপুড় করে সব আপেলকে মাটিতে ফেলতে হবে। তারপর একটা একটা করে আপেলগুলোকে পরীক্ষা করে ভালোগুলোকে ঝুড়িতে রাখা যাবে। এটাই দেকার্তের মেথড অব ডাউট। দেকার্তের এই বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ সম্পর্কে যুক্তিনির্ভর অনুসন্ধিৎসার কারণেই তাঁকে আধুনিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ বলা হয়।

 

অনেক পরে সাইবেরিয়ার জেলে সদ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে বন্দি হয়ে আসা আলেকজান্দার সলঝেনেৎসিন যখন দিশাহারা হয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কোন দোষে তাঁকে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত লাল ফৌজের গোলন্দাজবাহিনী থেকে সরিয়ে বন্দিশালায় আনা হল, তখন একই সেলে দীর্ঘদিনের বন্দি বৃদ্ধ প্রাক্তন সোশ্যাল ডেমোক্রাট ফাসতেঙ্কো তাঁকে প্রশ্ন করে করে অন্ধকার থেকে আলোতে আসতে সাহায্য করেন। আশৈশব সোভিয়েত ব্যবস্থায় বিশ্বাসী সলঝেনেৎসিন যখন এতদিনের লালিত বিশ্বাস ভেঙে যেতে দেখে বিপর্যস্ত, খালি ভাবছেন কেন তাঁর এই হাল হল, তখন ফাসতেঙ্কো তাঁকে ভর্ৎসনা করে বলেন, কী করে ভুলে যাও দেকার্তের সেই কথা-- সব কিছুকেই আগে প্রশ্ন করে দেখতে হবে। (গুলাগ আর্কিপেলাগো, প্রথম খণ্ড)

 

ইউরোপ ও ভারতের দর্শনের জগতে এই সংক্ষিপ্ত পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে এটাই বলার চেষ্টা হয়েছে যে বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে (দর্শন, বিজ্ঞান এমনকি সমাজবিজ্ঞানেও) সংশয়বাদী চিন্তার ধারা সতত বহমান। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’, ‘আম খেতে এসেছ, আম খেয়ে যাও। কটা গাছ, কটা পাতা, কার গাছ, এসব জেনে কী হবে?’ ‘আমার আচারবিচার ঘুচিয়ে দে মা।ইত্যাদি প্রচুর প্রবচন ও আপ্তবাক্য রয়েছে যা আদতে এই প্রশ্ন করার পদ্ধতিকে এড়িয়ে (যুক্তিকে এড়িয়ে) অন্ধভক্তিকে আঁকড়ে ধরতে উৎসাহ দেয়। পূথিবী স্থির, সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে, গ্রহণের সময় রাহু সূর্যকে গ্রাস করে ফেলে এবং ওই সময় গঙ্গাস্নানে পাপমুক্তির নিদান থেকে শুরু করে এইভাবেই অন্ধবিশ্বাস আমাদের মনে সমাজের কোনও বিশেষ অংশের মানুষদের বাকিদের জন্য ক্ষতিকারক বলে মনে করতে শেখায়, এবং তাদের ঘৃণা করতে বিনাশের উপায় বার করতে প্ররোচিত করে। তারা ইহুদি হতে পারে, মুসলমান হতে পারে, আফ্রিকার মানুষ হতে পারে। আরও নানা ধরণের মানুষকেই বিভিন্ন সময়ে এ ভাবে ঘৃণার ও অবিশ্বাসের শিকার হতে হয়। সংশয়বাদীরা প্রশ্ন করে সবকিছু খতিয়ে দেখে যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইলে তখন এই অন্ধবিশ্বাসে লালিত সমাজ ও রাষ্ট্রও তাদের দেশদ্রোহী ও সমাজের পক্ষে হানিকর বলে দাবি করে কারাগারে পুরতে উদ্যত হয়। দেশে মহামারী দেখা দিলে কি গোমূত্র পানে রোগ নিরাময় হবে? নাকি, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে হবে? 

 

রাষ্ট্র যখন এই মানুষের অন্ধবিশ্বাস ও তার প্রতি অবিমিশ্র ভক্তিকে হাতিয়ার করে ক্ষমতাসীনদের ক্ষুদ্রস্বার্থে ব্যবহার করে, তার বহিঃপ্রকাশও নির্লজ্জ, মিথ্যা আস্ফালনের মধ্য দিয়ে ঘটে। যেমন, 2016 সালের 8 নভেম্বর রাত 8টায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নোটবন্দি বা demonitisation গোষণা করে দেশবাসীর কাছে 56 দিন সময় চান। তাতে কালো টাকা নাশ হয়ে যাবে। নইলে তিনি মাথা পেতে শাস্তি গ্রহণ করবেন। ফল কী হয়েছিল, সবার জানা। 2020 সালে কোভিড-19 মহামারী আকার ধারণ করলে 24 মার্চ রাত 8টায় প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে জানান, 25 তারিখ থেকে দেশজুড়ে 21 দিনের লকডাউন চলবে। তিনি বলেন, মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের নাশ করতে পাণ্ডবদের 18 দিন লেগেছিল। তিনি করোনা নাশ করতে আরও তিন দিন বেশি চাইছেন। মহামারী মোকাবিলার সামগ্রিক প্রস্তুতি গ্রহণের আগেই এই যে 21 দিনের মধ্যে তা বিনাশের দাবি, এর পিছনে চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে গবেষণালব্ধ জ্ঞান ছিল না। ছিল ঝাড়ফুঁক, জড়িবুটি, তুকতাক ইত্যাদির মতোই কিছু অন্ধবিশ্বাসকে সুড়সুড়ি দেওয়ার প্রয়াস।

 

কিন্তু অন্ধবিশ্বাস এসে যতই বার বার সংশয়ী মনকে প্রশ্ন করতে বারণ করুক না কেন, তাকে চাপা দেওয়া কি এতই সহজ?

আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে।

বলে শুধু বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে, ..”

রবীন্দ্রনাথ। সত্য ও সুন্দরের উপাসক। উপনিষদের অস্তিবচনে স্থিত রবীন্দ্রনাথও কিন্তু মাঝেমধ্যেই সংশয়ের দোলায় দুলেছেন। এপিকউিরাস থেকে দেকার্ত হিউম সবাই সংশয়ে ছিলেন ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান ও শুভচিন্তক অস্তিত্ব নিয়ে। এদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, তা হলে ঈশ্বর শয়তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না কেন? রবীন্দ্রনাথের মনেও এই প্রশ্ন জেগেছিল

কিন্তু তার আগে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথের মনে ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কস্থাপনের বিষয়টি ভাবিয়েছিল।

যে দিন তুমি আপনি ছিলে একা

আপনাকে তো হয়নি তোমার দেখা।

সেদিন কোথাও কারো লাগি ছিল না পথ-চাওয়া

এপার হতে ওপার বেয়ে

বয়নি ধেয়ে

কাঁদন-ভরা বাঁধন- ছেঁড়া হাওয়া। .....

......  ...... .....

আমি এলেম, কাঁপল তোমার বুক,

আমি এলেম, এল তোমার দুখ,

আমি এলেম, এল তোমার আগুনভরা আনন্দ,

জীবন মরণ তুফান তোলা ব্যাকুল বসন্ত।

আমি এলেম, তাই তো তুমি এলে,

............

ওগো আমার প্রভু,

জানি আমি তবু

আমায় দেখবে বলে তোমার অসীম কৌতূহল,

নইলে তো এই সূর্যতারা সকলই নিষ্ফল। (বলাকা কাব্যগ্রন্থের ২৯ নং কবিতা)

বলা বাহুল্য, ঈশ্বরের উপযোগিতার উৎস এখানে তাঁর কাছে মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের তাগিদ।

কিন্তু জীবনের প্রান্তে এসে দেশের ও আন্তর্জাতিক দুনিয়ার ঘটনাবলির গতিপ্রবাহ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন আসন্ন) দেখে পরম মঙ্গলময় ঈশ্বরের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় ক্রমশই হতাশ রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে ছেড়ে মানুষের উপরেই আস্থা আরোপ করেন।

দুঃসহ দুঃখের বেড়াজালে

মানবেরে দেখি যবে নিরুপায়,

ভাবিয়া পাই না মনে,

সান্ত্বনা কোথায় আছে তার।

আপনারি মূঢ়তায়, আপনারি রিপুর প্রশ্রয়ে

এ দুঃখের মূল জানি;

সে জানায় আশ্বাস না পাই।

এ কথা যখন জানি,

মানবচিত্তের সাধনায়

গূঢ় আছে যে সত্যের রূপ

সেই সত্য সুখ দুঃখ সবের অতীত,

তখন বুঝিতে পারি

আপন আত্মায় যারা

ফলবান করে তারে

তারাই চরম লক্ষ্য মানবসৃষ্টির ;

একমাত্র তারা আছে, আর কেহ নাই;

আর যারা সবে

মায়ার প্রবাহে তারা ছায়ার মতন--

দুঃখ তাহাদের সত্য নহে,

সুখ তাহাদের বিড়ম্বনা,

তাহাদের ক্ষতব্যথা দারুণ আকুতি ধরে

প্রতি ক্ষণে লুপ্ত হয়ে যায়,

ইতিহাসে চিহ্ন নাহি রাখে। (রোগশয্যায় কাব্যগ্রন্থের 29 সংখ্যক কবিতা)

 

দেখাই যাচ্ছে, মঙ্গলময় ঈশ্বরের অস্তিত্বে আস্থা স্থাপনকারী রবীন্দ্রনাথও শেষদিকে ঈশ্বরের কল্যাণকামী রূপের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধের মতোই রবীন্দ্রনাথও বলছেন, মানবচিত্তের সাধনায় সত্যকে উপলব্ধ করতে যারা নিজের মধ্যেই (চেতনার মধ্যে) জ্ঞানের আলো জ্বালে, ‘একমাত্র তারা আছে, আর কেহ নাই।

ঈশ্বরের সঙ্গেই প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে বার বার এসেছে এই অসম্পূর্ণ পার্থিব জগতের পরিবর্তে এক নিখুঁত পূর্ণ জগতের (স্বর্গ ও নরক) কল্পনা, এবং সেই সঙ্গে নাস্তিকদের তরফ থেকে এসেছে নানা প্রশ্নবাণ। রবীন্দ্রনাথও কি দ্বিধাগ্রস্ত হননি? তাই কি নিজেকে প্রবোধ দিতে বলেন -- কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়, জয় অজানার জয়।

আবার অন্তিম দিনগুলিতে রোগশয্যায় লেখা এই কবিতাটি দেখা যাক

প্রথম দিনের সূর্য

সত্তার প্রথম আবিভার্বে প্রশ্ন করেছিল

কে তুমি?

পায়নি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল।

দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল সাগরতীরে

কে তুমি?

মেলে না উত্তর।

কোথায় উপনিষদের শান্তম, শিবম অদ্বৈতম? এ তো সংশয়বাদের নান্দীপাঠ। রবীন্দ্রনাথ নাকি মৃত্যুর কিছু আগে উচ্চারণ করেছিলেন --কী জানি, কী হবে! (শহরইয়ার, সৈয়দ মুজতবা আলি)

 

লেখাটা যে শ্যামাসঙ্গীতের উল্লেখ করে শুরু করেছিলাম, এবার সে প্রসঙ্গে আসি। দেখাই যাচ্ছে যে কালীভক্ত হয়েও কালীর জন্ম বা সৃষ্টিবৃত্তান্ত নিয়ে তাঁর মনে সংশয় জেগেছে। এই সংশয় নিরসনের পথ কী হতে পারে? হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ শ্রীচণ্ডীতে দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী কালীর জন্ম ক্রোধান্বিত দুর্গার ভ্রুযুগল থেকে। আর দুর্গার জন্ম ব্রহ্মার হাতে দেবতাদের সামগ্রিক তেজ থেকে। দেখাই যাচ্ছে, ব্রহ্মা ও অন্য দেবতাদের তুলনায়, এমনকি শুম্ভ, নিশুম্ভ, রক্তবীজ এবং মহিষাসুরের মতো অসুরদের তুলনায় দুর্গা অর্বাচীন (কারণ, ওই অসুরদের বধ করতেই তাঁর জন্ম)। কালী তাঁর থেকেও অর্বাচীন (কারণ, কালীর জন্ম দুর্গা থেকে)। শুধুই কি তাই? দেবতাদের মধ্যেও মনে হয় উচ্চনীচ, ছোটবড় আছে। গ্রিকদের দেবতা জিউস অন্য দেবদেবীর চাইতে বড়, অনেকটা দেবরাজ ইন্দ্রের মতো। আমাদের অবশ্য তার উপরেও ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর রয়েছে। গণিতের ছাত্র মাত্রই জানেন যে ইনফিনিটির মধ্যেও ছোট বড় আছে। যেমন, A set of all real numbers has a higher order than the set of all integers, though both are of infinite orders. আমাদের দেবদেবীরাও সবাই অনন্ত শক্তির অধিকারী। শুধু তারই মধ্যে কেউ বড় অনন্ত শক্তি ও কেউ ছোট অনন্ত শক্তির অধিকারী। কপালকুণ্ডলাও তাই। অর্থাৎ, সর্বশক্তিমান দেবদেবীর মধ্যে অনেকেই কম সর্বশক্তিমান। তাই পার্থিব জগতের নানা বৈষম্য, অকল্যাণকর কাজকর্ম, অভাব ইত্যাদি দূর করে দিতে ব্যর্থতার জন্য এই দেবদেবীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এঁরা ক্ষমতাহীন, দুর্বল, তাই অপারগ। তাঁদের সদিচ্ছার অভাব আছে কিনা জানতে তাঁদের মনের গহনে উঁকি মারা অসম্ভব। ধরে নেওয়া যায়, সাধ থাকলেও তাঁদের সাধ্যে কুলোচ্ছে না। অগত্যা এই দেবদেবীদের নিয়ে কতটা মাথা ঘামানো যায়, তা একান্তই ব্যক্তিরুচি নির্ভর। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, কোথাও কোনও কল্যাণকর ঈশ্বর অবস্থান করলেও তাঁর ক্ষমতা সীমিত। তিনি নিষ্ক্রিয়ই থাকছেন। তাই এটা বোঝা যাচ্ছে যে মানুষকে নিজেদের সমস্যা দূর করতে নিজেদের উপরেই নির্ভর করতে হবে। গৌতম বুদ্ধ তো সেটাই বলেছিলেন, আত্মদীপো ভবঃ। 

(এই নিবন্ধটি  আরেক রকম পত্রিকার 16-31 জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।)


 

N

 
 
 

রজত রায় - এর অন্যান্য লেখা


New
নায়কের খোঁজে বাঙালি
নির্বাচনী বন্ড: সরকারকে সব জানালেও সুপ্রিম কোর্টকে বলতে কেন বিলম্ব স্টেট ব্যাঙ্কের
মুক্তমনের অম্লান ভাষ্যকার


Other Writings by -রজত রায় | 10-02-2021

// Event for pushed the video