4thPillar


সব পাখি আর ঘরে আসে না

রিম্পা বিশ্বাস | 14-11-2021June 5, 2023
সব পাখি আর ঘরে আসে না

‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল’, ছোটবেলায় পড়া। ছোটবেলায় পাখি হওয়ার ইচ্ছা, সীমাহীন বাধাহীনভাবে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছা যখন তাড়া করে তখন এদিকে হয়তো ততটা নজর পড়েনি যে রাতে পাখি ওড়ে না! রাত পোহালে দিনের আলো ফুটলে তবেই পাখির কলরব শুরু হয়। দিন আর রাত, আলো আর অন্ধকার এই ঘুরন্ত কালের চাকার ছন্দে (Circadian rhythm) বাঁধা পাখির জীবন। বস্তুত, সব প্রাণীরই জীবন। কম খরচের এলইডি আলোর দাপটে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে আজকাল রাতকে দিন করে দেওয়া হচ্ছে। আর তাতেই বিপন্ন পক্ষীকুল।

 ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের গবেষণা অনুযায়ী প্রতি 35 বছর অন্তর সারা বিশ্বের কৃত্রিম আলো ব্যবহারের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই অ্যাসোসিয়েশন-এর দেওয়া সংজ্ঞানুযায়ী “অতিরিক্ত অথবা অপ্রয়োজনীয় কৃত্রিম আলোর ব্যবহারই হল আলোর দূষণ” (the inappropriate or excessive use of artificial light defines as light pollution)। অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের ভারতীয় ভূখণ্ডের চিত্রটি আলোর দিক থেকে কেমন হয় তা আমাদের সকলেরই জানা। শুধুমাত্র শহর নয় এই আলোর প্রতিফলন ছড়িয়ে পড়ে সুদূর গ্রামাঞ্চলে।

 
এবার কৃত্রিম আলোর সঙ্গে পাখিদের বিশেষত পরিযায়ী পাখিদের দুর্বিষহ জীবনের সম্পর্ক বুঝতে গেলে মহাকাশচারী বা ক্রমাগত পশ্চিম থেকে পূর্বে চলেছে এই রকম অন্তর্মহাদেশীয় যাত্রায় এরোপ্লেনের সওয়ারির অভিজ্ঞতার তুলনা করা যেতে পারে। 24 ঘন্টায় পৃথিবীকে একবার ঘুরে আসছে এই রকম বিমানের সওয়ারি কখনও আকাশে আলোর পরিবর্তন দেখবে না। সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়, দিন থেকে রাত, রাত থেকে দিন কিছুই সে দেখবে না। 24 ঘন্টা ধরে সে আকাশের একই জায়গায় সূর্যকে দেখবে। এতে মানুষের Circadian rhythm-এ যে ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়তে পারে, সেটা এড়ানোর জন্য চেষ্টা করা হয় এই ধরনের ক্ষেত্রে কৃত্রিম দিন ও রাত সৃষ্টি করার। অভাগা পাখিদের জন্য সে কথা ভাবারও কেউ নেই। বরং বিরাট উঁচু উঁচু উজ্জ্বল আলো লাগানোর যেন উৎসব চলছে সর্বত্র। পূর্ব কলকাতায় বিধাননগরে বাগজোলা খাল সংলগ্ন এলাকায় যেখানে দশ বছর আগেও সন্ধ্যায় টিয়াপাখির কলতানে কান পাতা যেত না, এখন সেখানে উজ্জ্বল আলোকময় নৈঃশব্দ্য।

পরিবেশে কৃত্রিম আলোর উপস্থিতি পাখিদের দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, এর ফলে পাখিরা নিজস্ব বাসস্থান খুঁজে বের করতে পারে না এবং পথেই ক্লান্ত হয়ে মরে যায়। পরিযায়ী পাখিরা তাদের যাত্রা রাতেই শুরু করে। অক্টোবর থেকে নভেম্বর বাংলার মানুষের কাছে উৎসবের মরসুম। আর পাখিদের কাছে ঠিকানা বদলের মরসুম। প্রতি বছর এই সময় 29টি দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের পাখি আমাদের দেশে আসতে শুরু করে, খাবারের সন্ধানে। এই সন্ধান নতুন নয়, প্রাকৃতিক নিয়মে শুরু থেকেই এই সন্ধান পক্রিয়া চলে আসছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাখিরা তাদের বাসস্থানও পরিবর্তন করে। দীর্ঘদিন ধরে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত হীরক নন্দীর বক্তব্য, শহরাঞ্চলে আলোর অতিরিক্ত ব্যবহার পাখিদের জৈবঘড়িতে (biological clock) কিছু পরিবর্তন এনেছে, শহরের পাখিরা তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে কৃত্রিম আলোর ব্যবহারে সম্ভবত কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তবে পরিযায়ী পাখিদের ক্ষেত্রে আলোর দূষণ ভারতীয় পেক্ষাপটে কতটা প্রভাব ফেলছে, তা গবেষণার বিষয় এবং এ নিয়ে সঠিক কোনও তথ্য বা পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। কলকাতায় এ বিষয়ে কোনও পরিচিত গবেষণা না থাকলেও, দক্ষিণ ভারতে এই বিষয়ে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য এবং সারা পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পরিবেশ বিশেষজ্ঞ পার্থিব বসু। তিনি জানাচ্ছেন, অস্বাভাবিক দীর্ঘস্থায়ী উজ্জ্বল আলো পাখিদের দৈনন্দিন জীবনচক্রের উপর প্রভাব ফেলতে বাধ্য। এতে তাদের প্রজনন, স্বাভাবিক জীবনচক্র, বাসা বাঁধার প্রবণতা সব কিছুই ব্যাহত হবে।

 প্রতি বছর টরন্টো শহরের Royal Ontario Museum কৃত্রিম আলোর প্রভাবে মরে যাওয়া পরিযায়ী পাখিদের মৃত দেহের প্রর্দশন করা হয়, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। পরিবেশ সচেতন যে কোনও মানুষের মনে ওই দৃশ্য দাগ কাটবেই। Royal Ontario Museum-এর গবেষণা অনুযায়ী সারা বিশ্বে কৃত্রিম আলোর প্রভাবে পরিযায়ী পাখিদের মৃত্যুর সংখ্যা কম করে দশ লক্ষ। এই সংখ্যার কতটা অংশ ভারতের মধ্যে পড়ে, আমরা জানি না। যদি জানতাম এবং Ontario Museum -এর মতো ভারতের একটি মিউজিয়ামও যদি মৃত পাখিদের দেহের দৃশ্য আমাদের সামনে তুলে ধরতে পারত, তাহলে হয়তো আমাদের সেই শিশুকালের পাখিদের প্রতি ভালবাসার টানে দু’টো কৃত্রিম আলো কম ব্যবহার করতাম। যতদিন না জানছি ততদিন কি চলতেই থাকবে আমাদের এই আলোর উৎসব?


New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -রিম্পা বিশ্বাস | 14-11-2021

// Event for pushed the video