4thPillar


ম্যানগ্রোভই বাঁচাতে পারে দক্ষিণবঙ্গকে

সৌরদীপ চক্রবর্তী | 19-07-2021June 5, 2023
ম্যানগ্রোভই বাঁচাতে পারে দক্ষিণবঙ্গকে

বঙ্গোপসাগরের রুদ্র রোষ থেকে বঙ্গভূমিকে রক্ষা করে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। উত্তর 24 পরগণার 6টি এবং দক্ষিণ 24 পরগণার 13টি ব্লক জুড়ে রয়েছে এপার বাংলার সুন্দরবন আর বাকি অংশ ওপারে, অর্থাৎ বাংলাদেশে। মোহনার ধারে এই অঞ্চল ঝড় ঝাপটার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গের সৈনিক। কখনও আয়লা, কখনও আমফান তারপর এই হালের ইয়াসে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সবকিছু। আমফানের সময় ঝড় এবং বাঁধ ভেঙে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হলেও এবার ইয়াসের অভিমুখ বামপন্থী হওয়ায় ঝড় অতটা না হলেও নদী বাঁধ ভেঙে মানুষের সংসার যাপন বিধ্বস্ত হয়। 

 
তাও সরকার এবং কিছু মেরুদণ্ডহীন মানুষের হেলদোল নেই। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য আস্তে আস্তে ধ্বংসের পথে। প্রকৃতির প্রতি নির্মম হলে, প্রকৃতিও যে তার অছিলায় প্রতিশোধ নেবে, আয়লা, আমফান, ইয়াস ইত্যাদির দাপট তার প্রমাণ। সুন্দরবনের ‘ফুসফুস’ ম্যানগ্রোভ অরণ্য, এই ম্যানগ্রোভ যুগ যুগ ধরে মাটি আঁকড়ে ভূমিক্ষয় রোধ করে। আমফান, ইয়াসের জন্য প্রবল ক্ষতি হয় ম্যানগ্রোভের। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জিওলজিস্ট সুগত হাজরা বলেন, ‘গত কুড়ি বছর ধরেই সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভের স্বাস্থ্যের অনেক অবনতি ঘটেছে, গাছগুলো তত উঁচু হচ্ছে না, রোগা রোগা, পাতায় সবুজের পরিমাণ কম। তারপর গত তিন বছরে পর পর সাইক্লোনের ধাক্কা। ইছামতীর ধারের অনেক ম্যানগ্রোভ মরেছে আমফানে। তারা নিজেদের সারিয়ে তলার সময় পাচ্ছে না।‘

 
ন্যাচারাল ম্যানগ্রোভ নদীর ধারে নিজে থেকেই পলি মাটিতে জন্মায়। ম্যানগ্রোভ হতে বেশ কিছু দিন সময় লাগে। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের কারণে নদীর ধারে থাকা ম্যানগ্রোভ নদী ভাঙনে তলিয়ে যায়, তাই ম্যানগ্রোভের বীজ এখন আর জলে পড়বে না। আর তার মধ্যে ম্যানগ্রোভ কেটে ফেলা ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সুগত বাবুর কথায়, ‘শুধু ম্যানগ্রোভ লাগালেই হবে না, তার পলি সঞ্চয়ের পলিও তো চাই নদীতে। তবে না সে জমি গড়বে। Silt Trapping -এর কিছু বিশেষ ব্যবস্থা করা যেতে পারে।'

 মাফিয়া রাজ চলে সর্বত্র। এই ম্যানগ্রোভকে ঘিরেও মাফিয়া রাজ ভালই চলছে। ম্যানগ্রোভ কেটে সেই জায়গায় নোনাজল ঢুকিয়ে চলছে চিংড়ির চাষ। বাসন্তী ব্লকের বিভিন্ন গ্রাম, রায়দীঘি অঞ্চলে এই কাজ আরও বেশি হচ্ছে। চোরাকারবারি এবং ভেড়ি সিন্ডিকেটের কার্যক্রমে চোখের সামনে হারিয়ে গেছে ম্যানগ্রোভের 1400 বিঘার জমি। আর এই সব জমির বেশিরভাগই সেচ দপ্তরের এবং জেলা প্রশাসনের। এবার এই সব দপ্তর এবং প্রশাসন তো চুপচাপ দর্শক হয়ে বসে আছে। বাম আমলে ম্যানগ্রোভ নিধন শুরু হলেও হালের সরকারের আমলে তা অনেক গুণ বেড়ে যায়। গত আট বছরে প্রায় 50 থেকে 60 শতাংশ ম্যানগ্রোভ কাটা হয়। হাইকোর্টে এই ম্যানগ্রোভ নিধন নিয়ে মামলা হয়। এর ফলে পুলিশ কিছু দিন কড়াকড়ি করে এবং কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে। কিন্তু তারপর আবার একইরকম। সুগত হাজরা জানান, ‘সুন্দরবনের মানুষের বাসযোগ্য জমি তৈরি হয়েছে জঙ্গল ধ্বংস করে। এখন চেষ্টা যা আছে সেটাকে বাঁচাতে হবে। আইন হয়েছে, কেউ তা জানেও না, মানেও না। ঝড়খালি, বাসন্তী, সাগর, গোসাবাতে ম্যানগ্রোভ কাটা ভেড়িতে সরকারি সাহায্যও মেলে। বিষয়টা সরকার না মানুষের মানসিকতারও।'

 বনমন্ত্রীর কাছে বহু অভিযোগ গেলেও, লাভের লাভ কিছুই হয়নি। বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রী ইয়াসের কারণে ক্ষয়ক্ষতির জন্য এ বিষয়ে নিজে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তার দলের নীচুতলার লোকজনই এই সব কারবারিতে যুক্ত বলে অভিযোগ। শুধু মাছের ভেড়ি তৈরি নয়, কোথাও কোথাও ম্যানগ্রোভ কেটে জমি দখল করে বেআইনি নির্মাণ কাজ চলছে। আর এর সঙ্গে আছে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ জমি মাফিয়ারা। যারা গাছ কাটছে, তারা যে একপ্রকার নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারছে, সেই বোধ তাদের নেই। বনদপ্তর মাঝে মাঝে কড়াভাবে নজরদারি করলেও তা দীর্ঘায়িত হয় না, বেশিরভাগ সময়ই তারা এসব বিষয়ে নিরুত্তাপ থাকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক পার্থিব বসু বলেন, ‘মাছের ভেড়ি তৈরির ক্ষেত্রে খুব শীঘ্রই কড়া পদক্ষেপের প্রয়োজন আছে। বাঁধ কেটে জল ঢোকানো সুন্দরবনে বিপুল পরিমাণে হচ্ছে, এটা আরও বেড়ে চলেছে। সেক্ষেত্রে বাঁধ দুর্বল হবে না কেন! আমরাই তার ব্যবস্থা করছি। এসবে রাজনৈতিক শক্তির ভালরকম মদত আছে।'

 সরকার প্রত্যেক বছর কয়েক কোটি টাকার ম্যানগ্রোভ প্রকল্প করে, তাতে প্রচুর ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়, কিন্তু সেই ম্যানগ্রোভের পরিচর্যা করাই হয় না বলা যায়। অঞ্চলের মানুষজনের এই নিয়ে তীব্র ক্ষোভ থাকে। সুন্দরবনের মানুষরা জানেন ম্যানগ্রোভের প্রয়োজনীয়তা কী, তাই তাঁরা ম্যানগ্রোভ রোপন করেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, যে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে এই গাছ লাগানোর কাজ হচ্ছে তা শুধু অফিসিয়ালি, আসলে তা বাস্তবিক রূপ পাচ্ছে না। অধ্যাপক সুগতবাবু বলেন, ‘গত কুড়ি বছরে 7,500 হেক্টর মতো ম্যানগ্রোভ বন তৈরি হয়েছে সুন্দরবনে সরকারি বে-সরকারি উদ্যোগে। আর 23,000 হেক্টর মতো জায়গা আছে। কিন্তু মূল সমস্যা তাদের বাঁচানো এবং বড় করা। মহিলা স্ব-নির্ভর গোষ্ঠীগুলির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। মানুষকেই বন বাঁচাতে হবে। সরকার কি সবসময় ‘দুয়ারে’ দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?'

শুধু নতুন নতুন ম্যানগ্রোভ লাগিয়ে এর সুরাহা করা সম্ভব নয়। যা ম্যানগ্রোভ বেঁচে আছে, তার খুব শীঘ্রই পরিচর্যা প্রয়োজন। আর নতুন ম্যানগ্রোভ লাগানো হলেও মাসে এক দু’বার সরকার পক্ষের লোক সেটার খেয়াল নিলেই কাজ হয়ে যায়। কোথায় কোন ধরনের ম্যানগ্রোভ লাগানো হবে, কতগুলি রো বানিয়ে গাছ লাগানো হবে, এই সব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরিকল্পনা করা দরকার। পার্থিববাবু মনে করেন ‘কতটা জায়গায় কতটা গাছ লাগানো হবে, এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করে করতে হবে। বিশেষজ্ঞ টিম নিয়োগ করে যে জায়গাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত বা ক্ষতি হওয়ার প্রবণতা আছে, সেই জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করে ম্যানগ্রোভ প্ল্যানটেশনের পরিষ্কার রূপরেখা তৈরি করার প্রয়োজন আছে।' সত্যিই তো তাই, যে পরিকল্পনা না করে গাছ লাগিয়ে লাভের লাভ কিছু হবে না, সেগুলো বৃদ্ধি পাবে, তাদেরকেও তো বাঁচাতে হবে।  


ম্যানগ্রোভই বাঁচাতে পারে দক্ষিণবঙ্গকে


অনেকাংশে ম্যানগ্রোভ হল কৃত্রিম বা ম্যানমেড গাছ। পরিবেশে উষ্ণতা এবং নদীর জলে লবণাক্তভাব এতই বাড়ছে যে, স্বাভাবিক ভাবে ম্যানগ্রোভ জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। এর কারণ আমরাই। তাই আমাদের নিজেদেরকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। নয়তো নদী ভাঙন বাড়তেই থাকবে। পার্থিববাবুর মতে, ‘ছোট নদীগুলোতে নোনাভাব এতই বাড়ছে যে ভবিষ্যতে ম্যানগ্রোভ গাছগুলোর আরও অনেক ক্ষতি হবে এবং এটা সাময়িকভাবে সুরাহা করা সম্ভব নয়, এটা দীর্ঘমেয়াদি কার্যপ্রণালী আছে। গ্লোবালাইজেশনের জন্য এটা আরও হবে, তার জন্য আমরাই দায়ী।' এইসব কারণে নদীর বাঁধ ধীরে ধীরে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে চলে আসছে। দুর্বল হচ্ছে বাঁধগুলো। 

 এত আঘাত পেতে পেতে সুন্দরবন আজ ক্লান্ত। সুন্দরবনের গরান, গেঁওয়া, সুন্দরী, গর্জন, হেঁতাল ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ গাছগুলিতে আগে অনেক পাখি এসে বসত। এখন তারা আসে না। আগে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, কুমিরের জন্য সুন্দরবনকে পৃথিবী একনামে চিনত, কিন্তু এখন তারাই অস্তিত্ব সংকটে নিজেদের দিন গুনছে। একদিকে জলস্তর বাড়ছে, তাই দ্বীপগুলোর আয়তনও কমছে। 

 
আস্তে আস্তে জীবকুল ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে, তার দায় আমাদেরকেই নিতে হবে। একটা সরকার যায়, আর একটা সরকার আসে অথবা কোনও সরকার গদি আঁকড়ে পড়ে থাকে, তাও পরিবেশ নিয়ে সেই ভাবে ভাবনাচিন্তা কোনও সরকারেরই সেই ভাবে ছিল না। সরকারগুলো অনেক প্রকল্প শিলান্যাস করলেও, সেগুলো ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন করতে অনেকাংশেই অক্ষম বলা যেতে পারে।

 
সুন্দরবন শুধু বাংলা তো নয়, গোটা পৃথিবীর এক ঐতিহ্যবাহী এবং পরিবেশের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ভবিষ্যতে এই অঞ্চল মানচিত্র থেকে মুছে গেলে অবাক হওয়ার থাকবে না।


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -সৌরদীপ চক্রবর্তী | 19-07-2021

// Event for pushed the video