বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বুধবার যা ঘটে গেল, তা এককথায় ঐতিহাসিক, প্রায় হলিউডের অ্যাকশন ছবির চিত্রনাট্য।
রাজধানীর ক্যাপিটল হিলে মার্কিন কংগ্রেসের মনোরম প্রাসাদ। এই বিশাল ভবনেই মার্কিন কংগ্রেসের দুই কক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস এবং সেনেট। আর রয়েছে যৌথ অধিবেশনের জন্য আলাদা অধিবেশন কক্ষ। অনেকটা আমাদের সংসদ ভবনের লোকসভা, রাজ্যসভা ও সেন্ট্রাল হলের মতোই। সেই ক্যাপিটল হিলের মার্কিন কংগ্রেস ভবন বুধবার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক উত্তেজিত জনতা কিছুক্ষণের জন্য দখল করে নেয়। মারমুখী ওই জনতার একাংশ সশস্ত্র হয়েই এসেছিল। তখন সেখানে মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন বসেছিল নভেম্বরের নির্বাচনের ফলকে বৈধতার শংসাপত্র দিতে। ওই অধিবেশন থেকেই জো বাইডেনকে দেশের প্রেসিডেন্ট এবং কমলা হ্যারিসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের জন্য অনুমোদন দেওয়ার কথা। হিংস্র জনতা পুলিসের ব্যারিকেড ভেঙে, পাঁচিল টপকে জোর করে ভিতরে ঢুকে পড়লে তাড়াতাড়ি অধিবেশন স্থগিত করে ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স, স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি-সহ সেনেটর ও হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভদের পুলিশ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ তাণ্ডব চালানোর পরে জনতাকে নিরাপত্তা বাহিনী ক্যাপিটল হিল থেকে সরাতে পারে। তবে ততক্ষণে প্রাণ গিয়েছে চার জনের, গ্রেফতার হয়েছে 56 জন।
আমাদের দেশের সঙ্গে আমেরিকার নির্বাচন পদ্ধতির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ভারতে নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। ভোট গণনা করে চূড়াম্ত ফল কমিশনই ঘোষণা করে। কিন্তু আমেরিকায় প্রতিটি স্টেট নির্বাচনের ভোট গণনা শেষে ফল জানিয়ে রিপোর্ট পাঠালে ক্যাপিটল হিলের যৌথ অধিবেশনে সেই সব রিপোর্ট পেশ করা হয়। তারপর কংগ্রেসের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ তা গ্রহণ করলে নির্বাচনের ফল চূড়াম্ত বৈধতা পায়। বুধবার শুরু হয়েছিল নভেম্বরের ভোটের ফল নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের সেই যৌথ অধিবেশন। কিন্তু তার আগেই ক্যাপিটল হিলের চারপাশের রাস্তার দখল নিয়ে নেয় হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থক। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছিলেন যাতে ভাইস প্রেসিডেন্টের (নিয়মানুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের অধিবেশন পরিচালনা করেন) ওপর চাপ বাড়িয়ে নিজের অনুকূলে ফল ঘোষণা করাতে। হোয়াইট হাউস থেকে ট্রাম্প জনতাকে আগেই বলেছিলেন, এই নির্বাচনে ভোটের ফল নিয়ে কারচুপি করা হয়েছে, ‘ফেক নিউজ’ পরিবেশনকারী সংবাদমাধ্যম ও ডেমোক্র্যাটরা মিলে রিগিং করেছে। সমর্থকদের প্রচ্ছন্ন উস্কানি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা কিছুতেই হার মানব না। আমরা সবাই ক্যাপিটল হিলে যাব, আমাদের (রিপাবলিকান) সেনেটরদের উৎসাহ দেব, সমর্থন জানাব।’ ট্রাম্পের সেই বক্তৃতার পরেই জনতা ক্যাপিটল হিলে হামলা চালায়।
এমনিতে আমেরিকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট কড়া। 2001 সালের 9/11-এর জঙ্গি হামলার পর তা বজ্রআঁটুনিতে পরিণত হয়েছে। তা সত্ত্বেও যে ভাবে হাজার মানুষ বন্যার মতো এসে খাস মার্কিন কংগ্রেস ভবনে ঢুকে পড়ল, আসবাবপত্র ভাঙচুর করল, তা এককথায় নজিরবিহীন। তবে এমন জনরোষের কিছু ঐতিহাসিক নজির অবশ্যই আছে। প্রায় 100 বছর আগে (1917 সালে) রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে জারের শীতকালীন প্রাসাদে সশস্ত্র জনতা ঢুকে নতুন ইতিহাস রচনা করেছিল। আরও আগে (1789) প্যারিসের বাস্তিল দুর্গে এবং ভার্সাই প্রাসাদে হিংস্র জনতা ঢুকে সুদীর্ঘ রাজতন্ত্রের পতন ঘটায়। একবার যদি ট্রাম্পের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মরিয়া ও হাস্যকর চেষ্টার কথা ভুলে বুধবারের ঘটনাবলির দিকে তাকানো যায়, তা হলে একটা বিষয় স্পষ্ট, মার্কিন কংগ্রেসে হামলাকারী জনতার সঙ্গে বাস্তিল ও জারের শীতকালীন প্রাসাদে হানাদার জনতার একটা জায়গায় গভীর সাদৃশ্য আছে। এরা সবাই গরিব, নিরন্ন জনতার অংশ। বাস্তিলে হামলাকারীদের স্লোগান ছিল রুটির দাবি। শীতপ্রাসাদে হামলাকারীদের সামনেও হাতছানি ছিল রুটি, শান্তি (প্রথম মহাযুদ্ধের সময়) ও জমির। মার্কিন কংগ্রেসে হামলাকারীদের স্লোগান ছিল ট্রাম্পকেই ফের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করতে হবে।
কারা এই হামলাকারীরা? এরা তো সমাজের বিত্তশালী মানুষদের প্রতিনিধি নয়। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়েও এরা ভাবিত নয়। এরা আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ সমাজের নিচুতলার প্রতিনিধি। ট্রাম্প যে শ্রমিকদের কাজ হারানোর আশঙ্কা, বেআইনি ও আইনি অভিবাসনের সুযোগ নিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা দলে দলে আমেরিকায় এসে এই শ্রমিকদের চাকরি কেড়ে নিচ্ছে বলে জিগির তুলে 2016 সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জিতেছিলেন, এরা তাদেরই প্রতিনিধি। এদের মধ্যে আফ্রিকার বংশোদ্ভূত কালো মানুষরা নেই, স্পেনীয় বংশোদ্ভূত লাতিনো জনগোষ্ঠীর মানুষও বেশি নেই। কারণ, ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকদের সঙ্গেই অন্য শ্বেতাঙ্গদের আকর্ষণ করেছিলেন white supremacy র কথা বলে। কালকের ঘটনা টিভির পর্দায় দেখতে দেখতে অ্যারিজোনা থেকে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের মন্তব্য, ‘কালো মানুষরা এটা করলে রক্তগঙ্গা বয়ে যেত। সাদা বলেই এত কম প্রাণ গেছে।’
এই ঘটনা আরও একটি প্রশ্নকেও উস্কে দিচ্ছে। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লবের সময় যখন সশস্ত্র, হিংস্র জনতা রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রতীক প্রাসাদ বা দুর্গে হামলা করে, দখল করে লুঠপাট করে, ভাঙচুর চালায়, তখন তা বৈপ্লবিক মুহূর্তের জন্ম দেয়। অন্যদিকে, ট্রাম্প সমর্থক জনতা যখন মার্কিন কংগ্রেসের ভবন দখল করতে আসে, তখন সেটা হয় অগণতান্ত্রিক, নৈরাজ্যবাদী কাজ! কী ফরাসি বিপ্লব, কী রুশ বিপ্লব, প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাস্তায় নেমে যারা পুরাতন রাষ্ট্রশক্তিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায়, তারা তো সর্বহারা মানুষেরই দল। আবার হিটলারের ব্রাউন শার্ট নামে পরিচিত ঝটিকা বাহিনী, বা মুসোলিনির ব্ল্যাক শার্ট বাহিনী যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইহুদি ও বিরোধী মতাদর্শের মানুষদের নির্যাতন করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করেছিল, তারাও তো গরিব মেহনতি মানুষেরই অংশ ছিল। 1991 সাল থেকে রামমন্দিরকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় আবেগ খুঁচিয়ে তুলে ব্যাপক গণসমর্থন গড়ে বিজেপির যে উত্থান অব্যাহত, সেখানেও সমাজের সবচেয়ে উপেক্ষিত অংশের (নিম্নবর্ণ, আদিবাসী ও শহরের বস্তি বা ঝুগ্গিঝুপড়ির বাসিন্দা গরিব ও বেকার মানুষের) ভিড় চোখে পড়ার মতো।
এটা ঠিক, যে এই উন্মাদ জনতার মধ্যে আরও একদল মানুষ ভিড়ে যায়, যাদের মার্কসীয় পরিভাষায় লুম্পেন প্রলেতারিয়েত বলা হয়। কিন্তু এই যে ‘হ্যাভ নট’রা সবার আগে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়ায়, তাদেরই তো ক্যাপিটল হিলে গতকাল দেখা গেল। এদের কেউ কেউ আবার স্ট্যাচু অব লিবার্টির আদলে সেজে ঘুরছিল। কেউ কেউ আবার স্পিকারের চেয়ারে বসে সেলফি নিতে ভোলেনি। এরাই তো আরব বসন্তের এর সময়ে তিউনিশিয়া, মিশর, লিবিয়া, সুদান ও ইয়েমেনে রাস্তায় নেমে এসে সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের দাবি তুলেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন লালিত নয়া উদারবাদী অর্থনীতির আবহে যে ভাবে সাধারণ শ্রমজীবী পরিবার পিষ্ট হয়ে চলেছে, তার বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্রোধকে ট্রাম্প উস্কে দিয়েছিলেন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। ট্রাম্প চলে গেলে তারা বিপন্ন হবে, এই আশঙ্কাই তাদের নিয়ে এসেছিল ক্যাপিটল হিলে। তাদের কাজটা ন্যায়, না অন্যায়, নৈতিক, না অনৈতিক, তা নিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধযুক্ত মানুষ মাত্রই একটা অবস্থান নিতে পারেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ অনেক সময়ই বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
এর আগে ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে 10 বছর আগে নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের কাছে ধর্না আন্দোলন শুরু হয় এবং অচিরেই আমেরিকার অন্য শহর এবং ইউরোপে তা ছড়িয়ে পড়ে। শেয়ার বাজার-সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ওয়াল স্ট্রিটে অবস্থিত হওয়ায় ‘Occupy Wall Street’ আন্দোলন বেশ জনপ্রিয় হয়। কিন্তু সেটা ছিল রাস্তায় বসে শান্তিপূর্ণ ধর্না, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রীতিনীতি মেনে। ফলে, রাষ্ট্রও তাতে খুব একটা বিচলিত হয়নি।
ভারতে এখন রাজধানী দিল্লির উপান্তে দেশের কৃষক সমাজের প্রতিনিধি কয়েক লক্ষ মানুষ হাড়কাঁপানো শীত, বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় বসে এক মাসের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছেন সরকারের নীতি বদলের দাবিকে আঁকড়ে ধরে। ইতিমধ্যেই 54 জনের মূত্যু হলেও তাঁরা অনড়। এখনও তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবেই আন্দোলন চালাচ্ছেন। কিন্তু যদি একবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, তা হলে কী হবে কল্পনা করা কঠিন নয়।
ওয়াশিংটন ডিসিতে যে ভাবে জনতা খাস মার্কিন কংগ্রেসে ঢুকে সাময়িক ভাবে দখল নিয়েছিল, তা শুধু আমেরিকাতেই নয়, ইউরোপেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, স্কটল্যান্ডের মতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা যে ভাষায় ট্রাম্প ও তাঁর অনুগামীদের তীব্র সমালোচনা করতে শুরু করেছেন, তা দেখে মনে হয়, ইউরোপ ফের ভয় পাচ্ছে সাধারণ মানুষের (plebian) এই জঙ্গি সক্রিয়তা দেখে। রাষ্ট্রনেতাদের স্মৃতিতে ফরাসি বিপ্লব ও রুশ বিপ্লবের আতঙ্ক ফিরে আসছে। আমেরিকায় রাজনৈতিক মহলে এখন সে দেশের সংবিধানের 25 তম সংশোধনী (25th Amendment) প্রয়োগ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে 20 জানুয়ারির আগেই অবিলম্বে সরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে চর্চা চলছে। সেটা না হলেও 20 জানুয়ারি জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন। কিন্তু থেকে যাবে তার স্মৃতি। গণতন্ত্রের নামে শপথ নেওয়া রাষ্ট্রশক্তি দেশে দেশে বছরের পর বছর যে ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে আরও দারিদ্র, আরও বৈষম্যের শিকার করে তুলছে, তাতে ওই স্মৃতি দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ততদিন ডিকেন্সের সেই ঐতিহাসিক মন্তব্যকেই স্মরণ করা যেতে পারে—It was the best of times, it was the worst of times.