4thPillar WeThePeople | 29-05-2021
বছর বছর ঘূর্ণিঝড় জলপ্লাবন ভাঙে সুন্দরবনের বাঁধ, জলে যায় শত শত কোটি টাকা। কংক্রিট দিয়ে নদী সমুদ্রকে বাঁধা কী সম্ভব? যদি না হয় তবে কেন এই বাঁধের কারবার? এই বিষয়ে গত 28 মে www.4thpillars.com একটি আলোচনার আয়োজন করেছিল। সুদীপ্ত সেনগুপ্তর সঙ্গে আলোচনায় রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র এবং সাংবাদিক জয়ন্ত বসু উপস্থিত ছিলেন।
*সুন্দরবনের এই বন্যার সমস্যা এখনের নয়। এর শুরুয়াৎ ইংরেজ আমলে, ওরা যখন সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করে এবং জোয়ারের জল চাষের জমিতে প্রবেশ করা থেকে আটকাতে নদী বাঁধ দিতে শুরু করে। নদী বাঁধ যখন দেওয়া হয়েছিল তখন ভাটার সংকুচিত নদীকে খেয়াল রেখে বাঁধ দেওয়া হয়, ফলে নদীর জায়গা কমতে থাকে। ফলে পরবর্তীকালে সামান্য জোয়ারেও নদী হাই টাইডের মতো আচরণ করতে শুরু করে। বর্তমানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে নদী উঁচুতে এবং আশপাশের জমি নিচে। এখন তাই বন্যা হলেই সহজেই সেই বাঁধ ভাঙে আর নদীর জল গ্রামগুলোতে প্রবেশ করে। যে লাইন বরাবর বাঁধগুলো আছে সেখানে কখনই সুস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব নয়।
*মূল সমস্যা বাঁধের অবস্থান যা এখন আর বদল করা সম্ভব নয় কারণ নদীর পাড় গুলোতেই সব থেকে বেশি সংখ্যক মানুষের বাস। তাই সেখানে যতবার বাঁধ দেওয়া হবে হয় নদী তাকে ভেঙে ফেলবে নতুবা তাকে টপকে জল গ্রামে ঢুকবে। এটা আটকানো মুশকিল।
*গোটা সুন্দরবনের পাড় কে কংক্রিট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। কোন জায়গাগুলো বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটা দেখে সেখানেই কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
*সুন্দরবনকে বাঁচাতে গেলে একটা দীর্ঘমেয়াদি এবং সুস্থায়ী পরিকল্পনা করা দরকার। এই পরিকল্পনার জন্য দরকার একটা তথ্যপঞ্জি বা ডেটাবেস। প্রকৃত তথ্য না থাকলে এই কাজে এগোনো মুশকিল।
*সুন্দরবনের খাঁড়িগুলো ভাটার সময় প্রচুর পলি নিয়ে যায় আবার জোয়ারে এই বিপুল পলি ঠেল দিয়ে ভিতরে ঢুকে আসে। এই পলি কিন্তু সুন্দরবনের জঙ্গলাবৃত অঞ্চলকে ক্রমশ উঁচু করেছে, তাই সেখানে বন্যার প্রকোপ কম। কিন্তু যে অংশে জনবসতি আছে সেখানে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের ফলে বন্যা হচ্ছে, নদী ক্রমশ জনবসতির তুলনায় উঁচু হচ্ছে।
*সুন্দরবনের কিছু অংশ থেকে জনবসতি সরিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু প্রায় 50 লক্ষ মানুষকে সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে নদীর প্রসারণের মুখে বাঁধ দিতে হবে। নদীর স্বাভাবিক পলি সঞ্চয়ের ওপর জোর দিতে হবে।
*সুন্দরবন কিন্তু ভৌগলিক কারণেই বিশ্বের অন্যান্য বাস্তুতন্ত্রের তুলনায় অনন্য। পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত এই দ্বীপে উত্তর-দক্ষিণে জোয়ার ভাটা খেলে।
*বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে বাঁধের পিছনে বাদাবন থাকে, সেই বাঁধের ক্ষতি কম হয়। ম্যানগ্রোভ হঠাৎ করে গজায় না। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই পলিসমৃদ্ধ সুন্দরবনে বাদাবন তৈরি হয়। অবৈধ নির্মাণ বন্ধ করে এই বাদাবন তৈরিতে উৎসাহ দিতে হবে।
*আপাতত ভেঙে যাওয়া নদীবাঁধগুলো মেরামত করে জল ঢোকা বন্ধ করতে হবে। তারপর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতেই হবে৷ ছোটদের পাঠ্যসূচিতে এই বিষয়গুলো ঢুকিয়ে তাদের সচেতন করা যেতে পারে। সুন্দরবনের সবকটা ব্লকের সচেতন মানুষ এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা কনভেনশন করা যেতে পারে। সচেতনতাই মূল অস্ত্র।
*শুধু বাঁধ নির্মাণেই মনোযোগ আবিষ্ট করলে চলবে না। সুন্দরবনের মানুষের বিকল্প অর্থনীতি, ইকো-ট্যুরিজম ইত্যাদির ওপরও জোর দিতে হবে। ঔপনিবেশিক আমলের ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে নতুন ভাবে সুন্দরবনকে বাঁচাতেই হবে।
*বঙ্গোপসাগরের জলের তাপমাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই, এখন ঘনঘন এখানে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ছে। এই নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করা না গেলে, শুধু সুন্দরবন নয়, খোদ কলকাতাও বাঁচবে না।