ব্দ, জলের মতোই। কোথাকার শব্দ কোথায় গড়াবে, আগে থেকে বলা যায় না। সেই চলন নিয়েই স্বপ্নময় চক্রবর্তী'র মৌতাত।
গুল
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
নজরুলের গানে কত ‘গুল’ আছে। বারবার গুল। ফার্সিতে গুল মানে গোলাপ। গুল বাগিচার বুলবুলি আমি রঙিন প্রেমের গাই গজল।
বাংলায় "গুল' মানে মিছে কথা; বা বাড়িয়ে বলা কথা। আজগুবি কথাও গুল। গুল মারিস না, পরে "গ্যাস দিস না'-এ রূপান্তরিত হয়েছে। বাজে কথা অর্থে কেন "গুল মারা' শব্দটা এলো সেটা বুঝতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আদি কলকাতায়।
ছোটবেলায় মা-ঠাকুমাদের "গুল' দিতে দেখেছি। সে গুল হ’ল জ্বালানি গুল। কয়লা ভাঙতে গেলে কিছু কয়লা গুঁড়ো হয়ে যেতো। সেই গুঁড়ো কয়লা মাটি, গোবর ইত্যাদির সঙ্গে জল দিয়ে মেখে হাতে পাকিয়ে গোল গোল বল বানাতেন, তারপর রোদ্দুরে শুকিয়ে নিতেন। কয়লা বাঁচানোর জন্য ‘গুল’ ব্যবহার করা হত। মানে ওটা কয়লার ভেজাল। ভাবতাম কথার ভেজাল কে ও তাই গুল বলা হচ্ছে। আবার গুলটা তো হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গড়ে নিতে হয়। এই যে পাকানো, সেটা যেন কোনও ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করার মতোই। গুল পাকানো থেকেই গুল মারা শব্দটা এসেছে ভাবতাম। আরও পরে দেখলাম গুলের উৎস খুঁজতে আমাদের আরও পুরনো দিনের কলকাতায় ফিরে যেতে হবে।
চীন কলকাতায় যে সমস্ত নেশা প্রচলিত ছিল তার অন্যতম হল গুলি। যারা গুলির নেশা করত, তাদের বলা হত গুলিখোর। গুলি তৈরি হত আফিম দিয়ে। পেয়ারা পাতা কুচি কুচি করে শুকনো খোলায় কড়কড়ে করে নেওয়া হত। আফিম গলিয়ে পেয়ারা পাতার গুঁড়ো মিশিয়ে ছোট ছোট গুলি পাকিয়ে নেওয়া হত। গুলি খাওয়া হত বিশেষ এক ধরনের হুঁকো-কলকেয়। গুলি খাওয়ার হুঁকো নলচের নাম ছিল ‘তোড়জোড়’। এটা তৈরি করা বেশ ঝামেলার ব্যাপার ছিল। তোড়জোড় শব্দটা এখনও ব্যাবস্থা-ট্যাবস্থা করা অর্থে রয়ে গেছে। যেমন- বিয়েবাড়ির তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল, কিম্বা সামনে নির্বাচন, বোমা বানানোর তোড়জোড় চলছে।
লি সেবনের পর লোকজন আজগুবি কথাবার্তা বলতো। যেমন- আমার ভায়রার চন্নননগরের বাড়ির পুকুরে নাইতে গিয়ে ডুব মারুলুম, ওমনি শুনি জলের ভিতরে গীতা পাঠ হচ্ছে! যতবার ডুব মারি, ততবার গীতা শুনি। ও বাড়িতে গেলে খুব পুন্যি হয়। গুলির দোকান ও খাওয়ার জায়গাকে বলা হ’ত গুলির আড্ডা। পালা-পাটনে খুব ভালো করে সাজানো হ’ত।
গুলি খাবার পর মিষ্টি খেতে ইচ্ছে হ’ত গুলিখোরদের। তাই গুলির দোকানের পাশে কদমা, বাতাসা ইত্যাদির ছোট দেকান থাকত। ত্রৈলোক্য নাথের নয়নচাঁদের ব্যবসায় দেখি নয়নচাঁদ গুলি খেয়ে চিনির জলে ভেজানো শোলা চুষছে। অনেক গুলিখোর আবার হাঁটুতে চিটে গুড় লাগিয়ে রাখতো। গুলি খেতে উবু হয়ে বসতে হয়, এবং টান মারার পর হাঁটুটা চেটে নিলেই হ’ল। ওটাই চাট।
শ্রদ্ধেয় গবেষক অরুণ নাগ মশাই সাহিত্য ভবিষ্যৎ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গম্ভীরা গান উদ্ধার করেছেন। ওখানে গুলি সংক্রান্ত কথা আছে। মালদহের ওই অঞ্চলে গুলিকে বলা হয় মদত। গানটার কিছু অংশ-
"আমি প্রণাম করি মদৎ প্রভু বাঞ্ছা কল্পতরু
তোমাকে ভজে মুকটি বাঁদর পুঁকটি হল সরু।
প্রভুর সিংহাসনটি আনকা হাঁড়ির কানকা ভাঙ্গা গলা
তাতেই হরনা হুক্কা কেমন শোভা ব্রজের বালা'
…ইত্যাদি। বলা হচ্ছে গুলি খেয়ে কেমন বাঁদরের মতো গাল ভেঙ্গে গেছে, কোমর সরু হয়ে গেছে।
আরও বলা হচ্ছে-
"নল যখন চুষি কখন হাসি কখন কাশি
ভাবি কাজ কি গয়া কাশী দয়াময় গুলি ঠাকুর
সাত পুরুষের গুরু।'
গুলিখোরদের দেখলেই চেনা যেত। এদের গায়ের শিরা দেখা যেত, চামড়া শুকনো, প্রায়ই চক্ষু বুজিয়া থাকে, নেশা ছুটিবার ভয়ে আশঙ্কায় সহজে চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া দেখেনা। গোলমালে ভারি, বিরক্ত হয়, -কেহ কথা বলিলে ‘আস্তে আস্তে’ বলিয়া নিষেধ করে। যখন ইহারা চলিয়া যায়, পায়ের গোড়ালি উঁচু হইয়া থাকে।
গুলি খেলে যে নানারকম সমস্যা হয়, সেটা ওরা বুঝেও ছাড়তে পারতোনা। কবি গানে আছে-
"এ নেশা কোলের ছেলে আগলে রাখা এয়ো রমণী
বুকে চেপে ধরে আছি ছাড়তে পারব নি।
গুলি বল গয়া কাশী পুরী বেন্দাবন
গুলি খেয়েই নেশা তীর্থে হোক না রে মরণ'
আবার গুলিখোরদের গানে আছে(অরুণ নাগের সংগ্রহ করা)-
"গুলি ছাড়ি কেমনে বিনা মরনে
সেয়াকলের কাঁটা যেন ছড়িয়ে ধরেছে বসনে
একবার মনে করি তোড়জোড় ফেলে দিয়ে
বয়ে থাকি বোবা হয়ে (কিন্তু) হাসু ভাজি স্বপনে।'
"হাসু ভাজা' মানে হচ্ছে পেয়ারাপাতার চূর্ণ দিয়ে আফিম মিশিয়ে গুলি তৈরি করা।
যারা যে নেশা করে তারা সে নেশাকেই শ্রেষ্ঠ নেশা মনে করে থাকে। গুলিখোরেরা বলতো,
মদ খায় পাপী তাপী গ্যাজা খায় চোর/ গুলি যারা খায় তাদের বহু পুণ্যের জোর।
গুলির আর একটা রূপ ছিল, তাকে বলা হত "ফুট্টুস'। চিৎ হয়ে শুয়ে ফাঁপা বাঁশে সরু নল দিয়ে টেনে গুলিটা ফাটিয়ে দেওয়া হত। তখন প্রচুর ধোঁয়া বের হত। যারা একটানে গুলি ফাটাতে পারতো, গুলি খোর সমাজে তাদের খুব কদর ছিল।
ফুট্টুসের আখড়ায় হোগলার মাদুর বিছানো থাকতো এবং সেবা করার পর কিছুক্ষণ বসার ক্ষমতাও থাকতো না। ফুট্টুস আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, গুলি বা জাগুও লুপ্ত। গুলির পরিবর্তে আফিম সেবনটা বেঁচে ছিল আরও বহুদিন। বঙ্কিমচন্দ্রের অমর সৃষ্টি কমলাকান্ত ছিলেন আফিম সেবনকারী, কিন্তু কমলাকান্ত যে ধরনের কথা বলতেন সেটা বেশ উচ্চদরের। কিন্তু গুলিখোরদের গুলিবাজি ছিল আজগুবি ধরনের। গুলিখোরদের পারস্পরিক সংলাপই হল ‘গুলিবাজি’। যারা গুলিবাজি করতো ওরাই গুলবাজ।
গুলি না খেয়েই গুলিবাজি করে থাকেন ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদরা। গুলকে ওরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন।