4thPillar


ক্ষত নিয়ে সাবধান হলে ক্ষতি করবে না স্ক্রাব টাইফাস

সুস্মিতা ঘোষ | 03-06-2022June 5, 2023
ক্ষত নিয়ে সাবধান হলে ক্ষতি করবে না স্ক্রাব টাইফাস

স্ক্রাব টাইফাস। গত এক সপ্তাহের প্রথম পাতার খবর। অবশ্যই কিছু ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি এবং আর একপ্রস্থ ‘আতঙ্কবাদ’। এই প্রতিবেদনে প্রচেষ্টা রইল সঠিক তথ্যের সঙ্গে সঠিক সাবধানতার প্রচার করার।

 

‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি’- আমাদের পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে যে মহামারীগুলিকে নাছোড়বান্দা ধরা যায়, স্ক্রাব টাইফাসকে তার দলে ফেললে খুব একটা ভুল হবে না।

 

স্ক্রাব টাইফাস নাম থেকেই বোঝা যায়, এই রোগটির উৎস স্ক্রাব অর্থাৎ ঝোপঝাড়, এবং লক্ষণ টাইফাস (গ্রিক টাইফুস, অর্থাৎ ধুম জ্বর)। আগে মূলত পাহাড়ি অঞ্চল, অর্থাৎ শিবালিক বা তরাই অঞ্চল, পশ্চিম ও পূর্বঘাট, বিন্ধ্য ও সাতপুরা, এই সব পাহাড়ের ঝোপঝাড়ে যেসব মাকড়সা, উকুন বা ছারপোকা জাতীয় ক্ষুদ্র সন্ধিপদ পোকা, যাদের ইংরেজিতে mite বলে, তাদের কামড় থেকেই এই রোগটি হত। ইদানিং মরু অঞ্চলের ঝোপঝাড় থেকেও এই রোগের প্রকোপ ছড়িয়েছে বলে জানা গেছে।

 

উপসর্গ

স্ক্রাব টাইফাসের জ্বরটা কীরকম? মুশকিল হল স্ক্রাব টাইফাসে যে সব উপসর্গ দেখা যায়, অর্থাৎ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর ইত্যাদি, তা সাধারণ ভাইরাস, ডেঙ্গি ভাইরাস, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, লেপ্টস্পাইরোসিস ইত্যাদি জ্বরের থেকে আলাদা করা সহজসাধ্য নয়। গত দু’বছরই কেবল জ্বর হলে লোকের কোভিডাতঙ্ক দেখা গেছে। না হলে সাধারণত জ্বর হলে প্রথমে সবাই ‘ভাইরাল’ মনে করে নিজে নিজে ঠিক হয়ে যাবে ভেবে অপেক্ষা করে। স্ক্রাব টাইফাসের জ্বর কিন্তু হঠাৎই লাগামছাড়া হয়ে ফুসফুস থেকে শুরু করে সমস্ত অঙ্গকে আক্রমণ করে মৃত্যু ঘটাতে পারে। অথচ শুরুতেই ধরা পড়লে সাধারণ কিছু অ্যান্টিবায়োটিকই রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করতে পারে।

 

বিভ্রান্তি ও সঠিক তথ্য

 

1) ভাইরাস? কিছু কিছু কাগজে বিভ্রান্তিকর প্রচার যেগুলো চলছে তার মধ্যে একটি হল ‘ভাইরাস’- না, স্ক্রাব টাইফাস ভাইরাসজনিত রোগ নয়। এটির কারণ এক বিশেষ জাতির ব্যাকটেরিয়া, যাদের আগে রিকেটসিয়া নামে অভিহিত করা হত। এখন জানা গেছে এরা রিকেটসিয়া (Ricketssia) জাতি থেকে সামান্য আলাদা, নতুন নাম দেওয়া হয়েছে অরিএনশিয়া (orientia)। স্ক্রাব টাইফাস রোগটি প্রথম জানা যায় 1899 সালে জাপানে। রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুটির নাম Orientia tsutsugamushi। জাপানি ভাষায় Tsutsuga মানে খুদে শয়তান আর mushi মানে পোকা। Tsutsugamushi ছাড়াও আরও অনেক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়াও এই রোগ ঘটাতে সক্ষম।  

 

2) নতুন বা সাগরপার থেকে আমদানি রোগ? আর একটি বিভ্রান্তিকর প্রচার হল কোভিড বা মাঙ্কি পক্স এর মত স্ক্রাব টাইফাস ও সাগরপার  থেকে আমদানি। না, স্ক্রাব টাইফাস ভারতে আমদানি হয়েছিল কিনা জানা নেই। এই রোগটি প্রধানত পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তের এক বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে পাওয়া যায়, যার নাম Tsutsugamushi Triangle. উত্তরে জাপান, দক্ষিণে ক্রান্তীয় অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিমে প্রাক্তন সোভিয়েত দেশের দক্ষিণের রাজ্যগুলি এর সীমারেখা। ভারতীয় উপমহাদেশ পড়ে এই ত্রিভুজের ঠিক মধ্যিখানে। তাই শুরুতে যেমন বলেছিলাম, Orientia tsutsugamushi আমাদের ঘরের লোক। নদীর ধারের ঝোপঝাড় সঙ্কুল অনেক এলাকাতে এদের প্রাদুর্ভাব বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যেমন চিন-জাপানের প্রচুর সৈন্য স্ক্রাব টাইফাসে আক্রান্ত হয়, তেমনই বাংলা এবং আসাম-এও প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হয়। পঞ্চাশের দশক থেকে বাজারে নানা রকম কীটনাশক আসতে শুরু করে। ফলস্বরূপ ছয়ের দশকের শুরু থেকে গত শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত স্ক্রাব টাইফাসের নাম আর প্রায় শোনা যায়নি। 2005 থেকে আবার স্ক্রাব টাইফাসের প্রকোপের কথা শোনা গেল। প্রতি এক বছর দু’বছর অন্তর অন্তর ফিরিয়া ফিরিয়া সে আসে!

 

তাহলে জ্বর হলে স্ক্রাব টাইফাস কিনা বোঝার উপায় কী?

 

ইন্টারনেট ঘাঁটলে অনেক রকম টেস্টের নাম পাবেন। IgM বা IgG ELISA, Immune Fluorescence, PCR এই সব নাম পাবেন। কিন্তু যদি সত্যি সত্যি স্ক্রাব টাইফাসের আশঙ্কা হয়, জ্বর আসার পরে, তাহলে কি এই টেস্টগুলোর সুবিধে পাওয়া যাবে? আমার ঘোরতর সন্দেহ, পাওয়া যাবে না। পরিসখ্যান বলছে গোটা গত দশকে সারা ভারতে উনিশ হাজারের কম স্ক্রাব টাইফাস কেসের কথা জানা গেছে। অর্থাৎ এই বিরাট দেশে গড়ে প্রতি বছর দু’হাজারের-ও কম মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। আমরা সবাই জানি, ডায়াগনোস্টিকস অর্থাৎ মেডিকেল টেস্ট একটা বিরাট ব্যবসা। মাত্র এই ক’টি ঘটনার জন্য কোনও অর্থকরী প্রতিষ্ঠান এই রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা রাখবে? সরকারি কিছু হাসপাতাল, যেখানে পঠনপাঠন এবং গবেষণা হয়, বিশেষ করে যেগুলি পাহাড়ি অঞ্চলের কাছাকাছি অবস্থিত, সেখানে এই রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে পারে। কিন্তু নমুনা পাঠানো এবং রিপোর্ট পাওয়া; এতে তো বিস্তর সময় নষ্ট হবে। আগেই বলেছি, খুব তাড়াতাড়ি ধরা গেলে স্ক্রাব টাইফাস আদৌ জটিল কোনও রোগ নয়। কিছু সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক-ই এর মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু দেরি হয়ে গেলে, তখন উপায়?

 

একটা উপায় আছে বটে তা হল পোকার কামড়ের ঘা খুঁজে বের করা স্ক্রাব টাইফাসের জীবাণুবাহী এই সব পোকার জীবনে চারটি অধ্যায় থাকে- যেমন প্রজাপতি ইত্যাদি সন্ধিপদ প্রাণীদের থাকে। ডিম ফুটে যে শাবক বেরোয়, যাদেরকে বাংলায় নিকী বলা চলে (উকুনের নিকীর মত), যেটা এদের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়, সেই সময়েই এরা মানুষকে কামড়ায়। পরের দুই অধ্যায়ে তারা ঘুরে ফিরে বেড়ায়, কিন্তু কামড়ায় না। নিকীর কামড় প্রথমে বোঝা না গেলেও অনেক সময়ে দু’চার দিন বাদে সেই কামড়ের জায়গায় এক বিশেষ ধরনের ঘা হয়, যাকে ইংরেজিতে eschar (এস্কার) বলে। এস্কার হল উঁচু গোল ঘা, যার বাইরেটা লাল। কেন্দ্রে কালো অংশটা গভীর। এই রকম এস্কার সংখ্যায় বেশি হয় না, বেশিরভাগ সময়ে সারা শরীরে একটাই দেখতে পাওয়া যায়। শরীরের যে অংশে পোকা ঢোকার সম্ভাবনা কম, যেমন চামড়ার বেল্টের নিচে, সেখানে কখনওই এস্কার থাকবে না। মাটিতে বসলে এই সব পোকা সহজে কামড়াতে পারে, তাই শরীরের নিম্নাংশে এস্কার থাকার সম্ভাবনা বেশি। এই এস্কার খুঁজে পেলেই ডাক্তারের পক্ষে চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে যায়। কিন্তু এটাও খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতোই কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে যখন এখনকার দিনে খুঁটিয়ে শারীরিক পরীক্ষা করার মতো ডাক্তার বা চিকিৎসাকর্মী বিরল। এই রোগটি সম্বন্ধে সচেতনতা প্রচার করতে পারলে রোগী বা তার পরিবার নিজেরাই সক্রিয় ভাবে এস্কার খুঁজে বার করতে পারে। সুবিধার্থে একটি ছবি এখানে দেওয়া হল। এই রোগের প্রকোপ যে যে অঞ্চলে বেশি, ইংরেজিতে যাকে endemic region বলে, বা যেখানে সম্প্রতি এই রোগ ঘটেছে বলে জানা আছে, সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের সচেতন থাকতে হবে স্ক্রাব টাইফাস সম্বন্ধে। জ্বর হলে, বা ঝোপ জঙ্গলে ঘুরে এলে তারপরে খেয়াল রাখতে হবে কোথাও এস্কার বেরোল কিনা।

 


ক্ষত নিয়ে সাবধান হলে ক্ষতি করবে না স্ক্রাব টাইফাস

স্ক্রাব টাইফাস এর আসল সমস্যা অনেক গভীরে

 

এর চিকিৎসা সাধারণত যে ভাবে হয়, সেটা হল রোগ নির্ণয় না করেই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেওয়া, যেটা অন্য জ্বরের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। আগে স্ক্রাব টাইফাসের চিকিৎসায় টেট্রাসাইক্লিন গোত্রের ওষুধ দেওয়া হত। এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি বলে আজকাল অ্যাজিথ্রোমাইসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। হয়তো বলবেন, তাহলে আর চিন্তার কী আছে, অ্যাজিথ্রোমাইসিন তো সবাই খাচ্ছে। চিন্তার ব্যাপার ওটাই। আজ সবাই খাচ্ছে, ব্যাকটেরিয়া-ও খাচ্ছে। খেতে খেতে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এখনই এমন অনেক রোগাক্রান্ত মানুষ আছেন, যাঁদের শরীরে আর কোনও অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। আমরা যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার না কমালে খুন শীঘ্রই কারও জন্য কোনও ওষুধ কাজ করবে না।

 

আগেই বলেছিলাম যে, কীটনাশক ব্যবহার শুরু হওয়ার পর স্ক্রাব টাইফাসের কথা প্রায় চার দশক শোনা যেত না। তাহলে আবার তারা ফিরে এল কী করে? হয়তো বাহক পোকাগুলি কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে গেছে। চাষিদের কাছে এই রকম কথা কিন্তু হামেশাই শুনি। তাই প্রতি বছর আরও কড়া, আরও কড়া কীটনাশকের ব্যবস্থা করতে হয় তাদের। স্ক্রাব টাইফাস তো কই বন্ধ হল না, বরং ক্যান্সার বেড়ে চলেছে।

 

প্রতিরোধের  উপায়

 

উপায় হল কামড় না খাওয়া। ঝোপ জঙ্গলে যদি যেতেই হয়, বসতেই হয়, তবে যেন এমন কিছু পেতে বসা হয় যাতে মাটি থেকে কিছু কাপড়ে না ঢুকে পড়ে। উকুন বা মশা তাড়ায় এমন ওষুধ গায়ে বা পোশাকে মেখে যেতে হবে। এছাড়া জানা গেছে যে, এই সব পোকার মতো ইঁদুর-ও স্ক্রাব টাইফাসের ব্যাকটেরিয়াকে পুষে রাখতে পারে শরীরে। এবং ওদের তাতে কিছু হয় না। যেমন বাদুড় নানা রকম ভাইরাস পুষে রাখে, অর্থাৎ তাদের zoonotic host হয়। ইঁদুরের কামড় থেকে শুধু জলাতঙ্ক নয়, স্ক্রাব টাইফাস এবং আরও অনেক রোগ হতে পারে। বিশেষ করে মেঠো ইঁদুর থেকে দূরে থাকতে হবে। ঝোপঝাড়ের পোকা, ইঁদুর ইত্যাদি যখন বাহক, তখন বোঝাই যাচ্ছে এটি তেমন সংক্রামক নয়। পরিসংখ্যান-ও সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

 

এটাও খুব পরিষ্কার যে, পশ্চিমি দুনিয়ায় স্ক্রাব টাইফাস নিয়ে তেমন মাথাব্যাথা নেই। প্রতিষেধক টিকা বার করার চেষ্টা হয়েছে। প্রতিষেধক আবিষ্কারে সফল না হওয়ার একটা কারণ কিন্তু স্ক্রাব টাইফাসের জনক ব্যাকটেরিয়া কিন্তু একাধিক, এবং তারা পরস্পরের জ্ঞাতি না হওয়াতে একটার টিকা অন্যটির বিরুদ্ধে কাজ না করার সম্ভাবনা প্রবল। তাছাড়া সম্ভাব্য টিকাগুলি নাকি কার্যকরী হয়নি। একটা সন্দেহ থেকেই যায়, যদি এই রোগ পশ্চিমি দুনিয়া বা ধনীদের সমস্যায় ফেলত, তাহলেও কি অবস্থা একই থাকত?

 

 

(ড: সুস্মিতা ঘোষ ডায়াগনোরাইট-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং জৈব-রসায়নবিদ। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের প্রাক্তন পোস্ট ডক্টরাল ফেলো। সুস্মিতার ডায়াগনোরাইট সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত একটি স্টার্ট-আপ সংস্থা, যার লক্ষ্য সকলের জন্য সুলভে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ডায়গনস্টিক্স।)

 



New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -সুস্মিতা ঘোষ | 03-06-2022

// Event for pushed the video