4thPillar


ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে

বিতান ঘোষ | 21-07-2020June 3, 2023
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে

প্রদীপজেঠু বেলুড়ে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতেন। লকডাউনের গোড়াতেই তাঁর চাকরিটি চলে যায়। কর্তৃপক্ষ বলেছিল, নিজের মোটরসাইকেল থাকলে এবং সেটা নিয়ে রোজ যাতায়াত করতে পারলে তবেই আবার চাকরিতে পুনর্বহাল করা হবে। লকডাউনের এই তিনমাসে 6 বছরের ছেলের প্রতিদিনের দুধ-বিস্কুট জোগাড় করতে যাঁকে নিজের পুরোনো সাইকেলটাই বিক্রি করতে হয়েছে, তাঁর কাছে এমন প্রস্তাব একপ্রকার হাস্যকরই বটে। তবু তিনি যে পাড়ায় থাকেন সেখানকার সকল অধিবাসী তাঁদের সাধ্য মতো প্রদীপজেঠুদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সীমাহীন দুর্যোগে কতদিনই বা স্বল্প অবলম্বন সঞ্চয় করে বাঁচা যায়? প্রদীপজেঠু এখন চায়ের দোকানের মাটির উনুন থেকে ছাই-আংরা বার করেন। দু'বালতি জল তুলে দেন। বিনিময়ে যৎসামান্য কিছু টাকা আর কিছু গুঁড়ো হয়ে যাওয়া বিস্কুট পান।

 

প্রদীপ জেঠু একলা নন। উৎকণ্ঠার প্রহর গোনার যেন অন্ত নেই সকলেরই। আণুবীক্ষণিক বিপদটা যেন এবার আমাদের আরও কাছে এগিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে অনেককেই সে ছুঁয়ে ফেলেছে। হয়তো কয়েকদিনের মধ্যে আমার সঙ্গেও তার যাবতীয় ব্যবধান ঘুচে যাবে। আমি যে ছোট মফঃস্বল শহরটায় থাকি, সেখানে এখন সন্ধে 7টা বাজলেই রাত ঘনিয়ে আসে। প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে যায় বাড়ির সামনের বড় রাস্তাটা। আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক, আর প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাংলা ধারাবাহিক চলার শব্দটা অবশ্য কানকে অবশ হতে দেয়না। রাতের ব্রেকিং নিউজের খবরগুলো উৎকণ্ঠা বাড়ায়, অকারণেই কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা মেপে ঘুমোতে যায় এই ছোট শহরটা।

 

কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত এই শহর। শহরের বুক চিরে চলে যাওয়া রেলপথটা বহুদিন হয়ে গেল নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে রয়েছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে হাওয়ায় ভেসে আসা ট্রেনের খবর আর শোনা যায় না, বিকেলের আলো নিভলেই কলকাতা থেকে মফঃস্বলের ছেলেরা ট্রেনে চেপে বাড়ি ফেরে না। সকালের একটা লঞ্চ, আর হাতে গোনা কয়েকটা বাস মহানগরের সঙ্গে শহরটাকে কোনওক্রমে জুড়ে রেখেছে এখন। জোয়ার-ভাটার দয়াদাক্ষিণ্য ঠিকঠাক না জুটলে এই লঞ্চই প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা পর মহানগরে পৌঁছে দেয় তার যাত্রীদের। আর বাস চলে তার মালিকদের মর্জি মাফিক। পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর তার গন্তব্য প্রতিদিন পাল্টে যায়। তাই মফঃস্বলের অনেক মানুষকেই নিজের সংস্থান নিজের মতো করেই করে নিতে হচ্ছে।

 

পেটের টানে বড় শহরের সঙ্গে ছোট শহরের সংযোগ রাখতে হয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম হলে আলাদা কথা, কিন্তু বড় শহর মফঃস্বলকে দেখাশোনা না করলে, সেই বা যাবে কোথায়? আমার পাড়ারই জনৈক উৎপলকাকু প্রতি সোমবার সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে যান ঠাকুরপুকুর। সেখানকার এক বেসরকারি সংস্থার রান্নাঘর সামলানোর গুরুদায়িত্ব তাঁর কাঁধে। সারা সপ্তাহ হেঁশেল ঠেলে উৎপলকাকু ফেরেন শনিবার রাতে। দুশ্চিন্তায় থাকা স্ত্রী যখন শনিবারের সন্ধ্যায় ফোন করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, 'কতদূর এলে?' ক্লান্ত উৎপলকাকু অক্লেশে উত্তর দেন, 'এই তো শিয়ালদহ ফ্লাইওভার।'

 

এই শহরের স্টেশনে যাওয়ার মূল রাস্তার ধারে রেল কলোনি। সেখানকার যৌনপল্লীর সার দিয়ে দাঁড়ানো টালির বাড়িগুলো এই কয়েকমাসে নিস্তব্ধ। বন্ধ দরজাগুলোয় ধাক্কাধাক্কি নেই, অচেনা মুখের আনাগোনাও না। যৌনপল্লীর কেউ কেউ এখন স্থানীয় হাটে সবজি নিয়ে বসেন। কেউ আবার বুধবার করে ফুল, বেলপাতা, আমপল্লব নিয়ে। আর যাঁরা বয়স বা অসুস্থতার কারণে সেটুকুও পারেন না, তাঁরা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দেওয়া খাবার খেয়েই দিনগত পাপক্ষয় করছেন। নিজের পেট, শরীর বিদ্রোহ করলেও এঁরা বাঁচেন, বাঁচার উপায় খোঁজেন। এঁদের কাছে মৃত্যুভয়ের কারণ কোনও আণুবীক্ষণিক জীবাণু নয়, পেটের খিদে— নিজের এবং পরিবারের বাকি সদস্যদের।

 

আমরা যারা একটা ঘেরাটোপ কিংবা আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাবোধের মধ্যে বাস করি, তারা রোগটাকে আটকানোর সমস্তরকম উপায়কে প্রয়োগ করছি। জনশ্রুতি, গরম জলে লেবুর রস মিশিয়ে খেলে করোনা হবে না, হোমিওপ্যাথির অমুক ওষুধটা কয়েক ফোঁটা পড়লেই অব্যর্থভাবে করোনাকে জব্দ করা যাবে। আমরা অন্ধের মতো মানি, সোশাল মিডিয়া খুলে দেখি, এরকম আর কিছু বাকি রয়ে গেল নাকি। কয়েক মাসের পে-কাট, সন্তানের উপযুক্ত প্লেসমেন্ট, বাৎসরিক পাহাড় ট্রিপ— সবকিছুর সঙ্গে আপস করেই এখন শরীরের ইমিউনিটি পাওয়ার গড়ে তোলাই আমাদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। যেন কোনও ফাঁকে করোনা এসে 'টুকি' বলে ধাপ্পা দিয়ে না চলে যায়। তাতেও মন সায় দেয় না, এইটুকুতে অমন মারাত্মক ভাইরাসটাকে জব্দ করা কি যাবে? আশঙ্কা হয়, দৈনন্দিন পরিসংখ্যানের একটা সংখ্যা হিসাবে আমার নামটাও হয়তো খুব তাড়াতাড়িই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে সংক্রামিতদের তালিকায়।

 

তবু এই আশঙ্কা আর উদ্বেগের বাইরেও যে একটা বৃহত্তর জীবনের স্পন্দন আছে সেটা টের পাই যখন ওই উৎপলকাকু বা প্রদীপজেঠুদের বেঁচে থাকাটাকে প্রত্যক্ষ করি। মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরেও যেমন টেলিভিশনের পর্দায় সুন্দরবনের ঘরহীন মানুষগুলোকে হাসতে দেখেছি, তেমনি আমার শহরের এই মানুষগুলোকেও স্বচক্ষে এত প্রতিকূলতার মধ্যে বাঁচতে দেখি। ইমিউনিটি কি শুধু শরীরেরই হয়? মনের ইমিউনিটি হয় না বুঝি? দীর্ঘ লকডাউনে আমাদের এই যে ভয়, মনোবৈকল্য, তার আশু সমাধান এখনই হয়তো নেই। কিন্তু অন্যরা যখন জীবনে কোণঠাসা হয়ে গিয়েও বাঁচার স্বপ্ন দেখেন, অপরকে দেখান, ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ সময়েও অদম্য জেদে জীবনতরী বেয়ে যান, তখন তাঁরা আমাদের অনুপ্রাণিত করেন। একটা অখ্যাত মফঃস্বলের আরও অখ্যাত কিছু মানুষের ইতিকথা বলে যায়, ভয় ভেঙে মন খুলে বাঁচো। শুধু শরীর নয়, মনের ইমিউনিটিও বাড়াও। মহামারীর মতো এই ইতিবাচকতা আর মনের জোরগুলোও সংক্রামিত হোক এক থেকে অপরে। এত বড় সঙ্কটের মধ্যেও মাস্কের আড়ালে থাকা মুখগুলোয় হাসি লেগে থাকুক। "মন্বন্তরেও মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি।" কবির এই সাহসী উচ্চারণের পরে আমাদেরও তো এমন দুর্বলচিত্ত হওয়া মানায় না।


New
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?
অল ইজ নট ওয়েল ইন লাদাখ


Other Writings by -বিতান ঘোষ | 21-07-2020

// Event for pushed the video