4thPillar


সভাপতি নেই, কম্যান্ডও নেই, কংগ্রেস যেন সারথিবিহীন রথ

বিতান ঘোষ | 01-12-2021May 8, 2023
সভাপতি নেই, কম্যান্ডও নেই, কংগ্রেস যেন সারথিবিহীন রথ

প্রফেট সুকুমার রায় কবেই লিখে গিয়েছেন, ‘সাত জার্মান একলা জগাই, তবুও জগাই লড়ে’। রাহুল গান্ধীও তেমনই মোদী-শাহ ব্রিগেড এবং বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ছেন। কিন্তু দলের অন্দরে বকলমে তাঁরই নামাঙ্কিত যে ব্রিগেড, সেই ‘রাহুল ব্রিগেড’ ক্রমশ ফাঁকা হচ্ছে।

যে তরুণ, সম্ভাবনাময়, আধুনিক ছেলেপুলেদের নিয়ে তিনি এই ব্রিগেড গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁদের অনেকেই গত কয়েক বছরে পদ্মবনে গিয়ে ভিড়েছেন। তবে কি রাহুলের মধ্যে এমন কোনও নেতৃত্বগুণ নেই, যার দ্বারা তিনি বিজেপিকে না হোক, তাঁর অনুগামীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন? নাকি দীর্ঘ দিন ধরে ব্যর্থতার ইতিবৃত্ত বয়ে যাওয়া কংগ্রেসে থেকে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খাকে পরিতৃপ্ত করা যাবে না, এটা ভেবেই তাঁরা রাহুল এবং কংগ্রেসকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে নয়া প্ল্যাটফর্ম খুঁজতে বেরিয়ে পড়ছেন? প্রশ্নের উত্তরটা যা-ই হোক, কংগ্রেস এবং রাহুল গান্ধীর জন্য এ বড় সুখের সময় নয়।

দলের অন্দরে মেঘনাদের মতো অন্তরালে থেকে তিনি সবটা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন— এই অভিযোগ তুলে সনিয়া গান্ধীর কাছে বারংবার নালিশ ঠুকেছেন কংগ্রেসের প্রবীণদের নিয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী, রাজনৈতিক মহলে যেটিকে জি-23 গোষ্ঠী বলা হচ্ছে। এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিজের নিয়ন্ত্রণকে শক্তপোক্ত করতে, রাহুল এর আগে এঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই বিজেপি এবং সংঘ যোগের অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু এই প্রবীণরা বিজেপি এবং সংঘের প্রতি কতটা অনুগত তা পরখ করে দেখার সুযোগ না মিললেও দেখা গিয়েছে, রাহুলের আস্থাভাজন, তাঁর ব্রিগেডের সদস্যরাই ঢাকঢোল পিটিয়ে বিজেপিতে গিয়ে সেই দলে বড় বড় পদ অলংকৃত করেছেন।

সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেস বড় জাতীয় দল হওয়ার অভিপ্রায়ে যে ‘সম্প্রসারণ নীতি’ নিয়েছে, তাতে তারা বিভিন্ন রাজ্যে সংগঠন ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছে। এই কাজে তাদের সহায় প্রাক্তন কংগ্রেসিরাই, যাঁদের রাজনৈতিক মধুমাস প্রায় অস্তগামী কিংবা দলের অভ্যন্তরীণ সাপ-লুডোর খেলায় যাঁরা অনেকটাই পিছিয়ে। মূলত এই সমস্ত কংগ্রেসি নেতাই নিজ নিজ রাজ্যে তৃণমূলের সংগঠন বিস্তারের দায়িত্ব পাচ্ছেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে রাহুল এবং কংগ্রেস গোঁসাঘরে খিল এঁটেছেন এবং তৃণমূলের বিজেপি বিরোধিতার আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। রাহুলের এই প্রশ্ন কতটা যৌক্তিক আর কতটাই বা অবান্তর সেটি বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে দলের এই ক্ষয়রোগ রোখার কোনও দাওয়াই যে রাহুল এবং তথাকথিত রাহুল ব্রিগেড দিতে পারেনি, তা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট।

শুধু তৃণমূলকেই দোষ দেওয়া কেন, বিগত কয়েক বছরে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেস ক্রমক্ষয়িষ্ণু একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছে। সেই সব রাজ্যে শাসক হওয়া দূরস্থান, বিরোধী পরিসরটুকুও নিতে ব্যর্থ হচ্ছে কংগ্রেস। খাস দিল্লির অধিকার গিয়েছে আম আদমি পার্টির কাছে। উত্তরপ্রদেশের সাম্প্রতিক পুর-নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টি, আম আদমি পার্টি ভাল ফলাফল করলেও, বিরোধী শক্তি হিসাবে কংগ্রেসকে সেখানে দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়। ত্রিপুরা, অসমের এককালের দুর্জয় ঘাঁটিতেও এই শতাব্দী প্রাচীন দলটি এখন একটি প্রান্তিক শক্তি— অনেক ক্ষেত্রেই প্রাপ্ত ভোট ৫ শতাংশেরও কম! তা ছাড়া রাজ্য ও এলাকাভেদে কংগ্রেসের যে চিরায়ত ভোটব্যাঙ্ক, তার উপরও কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ ঘুচেছে। রাজ্য শাখার উপদলীয় কোন্দল মেটানোর মতো কোনও কুশলী ক্রাইসিস ম্যানেজারও এখন দলে নেই। এই অবস্থায় দলের মধ্যেকার যুযুধান দুই বা ততোধিক গোষ্ঠীর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কংগ্রেসের জন্য।

রাহুল গান্ধীর অনেক পূর্বানুমান হুবহু মিলে গিয়েছে। তার জন্য তাঁর মধ্যে একটা আত্মশ্লাঘাও আছে। যেমন, দেশে কোভিড সংক্রমণ শুরুর আগেই তিনি এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে সাবধান করেছিলেন। আবার রাফাল চুক্তিতে যে "গোলমাল' আছে, তা তিনি ফরাসি সংবাদমাধ্যমের অনেক আগেই দাবি করেছিলেন। কিন্তু নিজের দলের শক্তি ও দুর্বলতাগুলির জায়গা নিয়ে তিনি খুব ওয়াকিবহাল, এমনটা মনে হয় না। তাই দলের সম্ভাব্য সাফল্য নিয়ে করা তাঁর যাবতীয় পূর্বানুমান সাম্প্রতিক অতীতে ব্যর্থ হয়েছে। পাঞ্জাবের মতো 'নিরাপদ' রাজ্যেও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সিধু ও মুখ্যমন্ত্রী চন্নির মধ্যে সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হাইকম্যান্ড। অমরিন্দর সিং দল ছেড়ে নতুন রাজনৈতিক ইনিংস শুরুর প্রতীক্ষায়। মেঘালয়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা এবং প্রদেশ সভাপতি ভিনসেন্ট পালার দ্বন্দ্ব মেটাতে ব্যর্থ কংগ্রেস কনরাড সাংমার দলত্যাগ করার পথটিকে প্রশস্ত করে দিয়েছে। একই ভাবে মধ্যপ্রদেশে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া বনাম কমলনাথ, অসমে হিমন্ত বিশ্বশর্মা বনাম তরুণ গগৈ, প্রবীণ-নবীন দ্বন্দ্ব মেটানোয় অপারগ কংগ্রেস স্রেফ নিজেদের সিদ্ধান্তহীনতার দরুন শক্তিশালী আঞ্চলিক নেতাদের হারিয়েছে। রাহুল তাঁর দু’দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সঞ্জাত প্রজ্ঞা দিয়েও নিজের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা ঢাকতে পারছেন না।

সেই রাম নেই, অযোধ্যাও নেই। অতীতের স্মৃতিচারণা দিয়ে আরও অনেক কিছুর মতো রাজনীতিও চলে না। কংগ্রেসকেও ‘জলসাঘর’-এর জমিদারের মতো ভাবভঙ্গি সরিয়ে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে আরও সমন্বয় বাড়াতে হবে। এরই পাশাপাশি প্রদেশ কমিটিগুলিকেও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে আঞ্চলিক দলগুলির পাশাপাশি কংগ্রেসও সেই সব রাজ্যে নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে পারে। তবে এটা তখনই সম্ভব, যখন দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে নির্বাচনের মাধ্যমে অথবা সর্বসম্মতিক্রমে কংগ্রেস এক জন পূর্ণ সময়ের সভাপতি খুঁজে নিতে সক্ষম হবে। সারথিবিহীন রথ আর কত দিন সোজা রাস্তায় এগোতে পারবে?

 

 


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -বিতান ঘোষ | 01-12-2021

// Event for pushed the video