কখনও ভেবে দেখেছেন কী যুদ্ধে জয় পরাজয় কীসের উপর নির্ভর করে? শুধুই কি বীরত্বের ওপর? ইতিহাসে সবাই পড়েছি পলাশীর যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, সিরাজের এক সেনানায়কের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য অনায়াসে জিতে গেল। আর এই যুদ্ধ জিতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের শাসনের গোড়াপত্তন করল। আফ্রিকার এক প্রবাদ: ‘সিংহের নেতৃত্বে ভেড়ার দলও ভেড়ার নেতৃত্বে সিংহের দলকে হারাতে পারে।’ এই প্রবাদের সত্য অনেক ব্যাপক। শুধু যুদ্ধের প্রান্তর নয়, অনেক গণতান্ত্রিক সরকার, অনেক নেতার বেলাতেও প্রবাদগুলো খাটে। আমরা চারদিকেই দেখছি এক জন অযোগ্য নেতা, একটা বিষাক্ত মতাদর্শ, নেতার অবাস্তব উচ্চাভিলাষ আর মিথ্যা জাঁকজমক খুব কম সময়ের মধ্যে একটা দেশের সর্বনাশ ঘটায়। সেই সর্বনাশের ক্ষয়ক্ষতি সারিয়ে দেশটার পক্ষে আবার উঠে দাঁড়ানো শুধু কঠিন নয়, অনেক সময় প্রায় অসম্ভব।
ইতিহাসে এমন উদাহরণ প্রচুর। হিটলার বা মুসোলিনির স্মৃতি এখনও ইতিহাসে তাজা। স্ট্যালিনের নেতৃত্বে লাল ফৌজ যেমন নাৎসী বাহিনীকে পরাস্ত করেছিল, তেমনই সেই একই নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপে স্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। তার ভয়ঙ্কর পার্টি-শুদ্ধিকরণ নীতিতে। সেই পঙ্গুত্বের থেকে তারা আর কোনওদিনই ঠিক বেরিয়ে আসতে পারেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার নির্ধারিত নীতি এবং সেই নীতিতে অন্ধ বিশ্বাসী নেতাদের হাতে পড়ে, আর্জেন্টিনার মতো প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশও ভিখারি হয়ে যায়। বিষাক্ত মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার বিভ্রান্তি যে কোনও দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়ে হাঁসফাঁস করছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। বেকারত্ব আকাশচুম্বী। অথচ তারই পাশপাশি গগনচুম্বী শেয়ার বাজার, গো-হত্যাকে নিষিদ্ধ করা আর রাম মন্দির বানানো নিয়ে বেজায় হইচই, আর এক বিশেষ নেতাকে ঐতিহাসিক গুরুত্ব দেওয়ার নানা চেষ্টার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অশুভ লক্ষণ এমনই এক ধরনের বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে। এ যেন আমাদের দুয়ারে দানবের হানা। চাষীরা সেই দানবের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে আমাদের সতর্ক করছেন, আয়না তুলে দেশের বর্তমান ছবি দেখাচ্ছেন।
যদি আপনি ইতিমধ্যেই টেলিভিশন, ফেসবুকে ও খবরের কাগজে প্রচারিত বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় নিজের বোধবুদ্ধি সম্পূর্ণ হারিয়ে না থাকেন, তবে রূপকথার এক রাজকন্যার মতো সেই আয়নাকে জিজ্ঞেস করুন ‘এসবের পিছনে আছেটা কে?’ আয়না কিন্তু শাসক দলের দু’জন সর্বশক্তিমান গুজরাটি নেতার ছবি দেখাবে না, বরং অন্য দু’টি মুখ দেখাবে। এই দেশেরই দু’জন, ধনীশ্রেষ্ট ব্যবসায়ীর মুখ (তারাও গুজরাটি)। এই দু’টি মুখ কার কার তা বলার জন্য অবশ্যই কোনও পুরস্কারের ঘোষণা নেই, কারণ চাষিরাই তাদের সাধারণ জ্ঞান থেকে তা বলে দিয়েছেন। দু’জনেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পুরনো বন্ধু, সেই গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময় থেকে। কিন্তু এ শুধু ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ বা পোষণমূলক পুঁজিবাদের ব্যাপার নয়। যেভাবে সম্প্রতি তিনটি কৃষি আইন প্রায় বিরোধীশূন্য আইনসভায় তড়িঘড়ি করে পাশ করানো হয়েছে, তা অন্য ইঙ্গিত বহন করে। এই সরকার এমন কাজ করেই চলেছেন। জনগণকে আলোচনার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ না দিয়ে, তাদের উপর ঝটিকা আক্রমণ চালানোর প্রবণতা সরকার আগেও দেখিয়েছেন। শুরু হয়েছিল নোট বাতিলের গেরিলা আক্রমণ দিয়ে। তারপর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থ কাঠামোতে রাজ্যগুলিকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য কৌশলগত ভাবে জিএসটি-র প্রয়োগ করা হয়। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসেছিল মাত্র চার ঘন্টার নোটিসে কঠোরতম লকডাউন, যার ফলে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক তাদের জীবন ও জীবিকা থেকে হঠাৎ ছিন্নমূল হয়। তবু এত হতাশার মধ্যেও জনগণ বিশ্বাস হারায়নি। তারা ধরে নিয়েছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার লড়াই করছে, (অ্যাকাউন্টে 15 লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়েছেন? এখন তার বদলে শুনুন কৃষকের আয় নাকি দ্বিগুণ হয়ে যাবে!)। কিংবা মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এমন লকডাউন অত্যন্ত জরুরি, এই রকমের একটা বিশ্বাসের মোহজাল যেভাবেই হোক সাধারণের মধ্যে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপরে আমরা দেখতে লাগলাম কীভাবে মহামারীকে ব্যবহার করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে ভিতর থেকে ফোঁপড়া করে দেওয়া হচ্চে। একের পর এক শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিকারক কিন্তু কর্পোরেটের জন্য সুবিধাজনক আইন আগাম নোটিস বা আলোচনা ছাড়াই চট করে পাশ করিয়ে নেওয়া হল। এখন সরকার অনেক ভেবেচিন্তেই এই মহামারীর আড়ালে তিনটি কৃষি আইনকে কার্যকর করতে চাইছে। সরকারের ধারণা ছিল- এমন চূড়ান্ত হতাশাজনক সময়ে, যখন দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, তীব্র বেকারত্ব সাধারণ মানুষকে শ্বাসরুদ্ধ করছে- সেটাই মাহেন্দ্রক্ষণ! সংসদের ভিতরে বা বাইরে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে খুব একটা প্রতিবাদ হবে না। খুব সংক্ষেপে বললে, এই তিনটি আইনের মাধ্যমে প্রচলিত মান্ডি ব্যবস্থা এবং কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু যে বিষয়টিকে আমাদের নজরের প্রায় বাইরে সাধারণ আলোচনায় রাখা হচ্ছে না সেটা হল, এই তিনটি আইন অনুযায়ী, যে কোনও রকমের বিরোধে নিষ্পত্তির ব্যাপারে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা কাজ করবে না। তার বদলে সরকারকে একতরফা ভাবে বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা, বিচারবিভাগের কাছ থেকে সরকারি আধিকারিকদের কাছে চলে যাবে। তার ফলে দু’পক্ষের মধ্যে স্বার্থের যে তফাৎ হতে পারে তা উপেক্ষা করে, অপরাধী নিজেই নিজের অপরাধের প্রকৃতি ও গুরুত্বের বিচার করবে! এ শুধু কৃষকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়, সমস্ত ভারতবাসীর অধিকারকে কেড়ে নেওয়ার সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ।
কৃষকরা তাদের প্রতিবাদ শুরু করেছেন, অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য লড়াই চালাচ্ছেন। এবং এই লড়াই সমস্ত ভারতবাসীর সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার ব্যাপকতর লড়াইয়ের সঙ্গে ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে। ভারতের হতাশ গরিব মানুষ যেন হঠাৎ করেই বুঝতে পেরেছেন যে, তাঁরা ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি হয়েছেন। কৃষির ‘কর্পোরেটকরণ’ আসলে ভারতীয় গণতন্ত্রে এবং সাংবিধানিক অধিকারে "কর্পোরেটকরণ’-এর প্রক্রিয়ার সূচনা মাত্র।
আমাদের তথাকথিত অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা অপ্রাসঙ্গিক অর্ধসত্যের বিশেষজ্ঞও বটে। ভুলভুলাইয়া ছড়ানোর কাজেই বোধহয় তারা বেশি ব্যস্ত। তাদের গুরু অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রীডম্যান বলেছিলেন, "একটি মুক্ত গণতন্ত্রের জন্য একটি মুক্ত বাজারের প্রয়োজন’। আমাদের নানা দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানপুষ্ট অর্থনীতিবিদরা প্রায়শই তাদের মুক্ত বাজারের যুক্তির সমর্থনে ফ্রীডম্যানের এই উক্তিটিকে তুলে ধরেন। তিনটি কৃষি আইন কার্যকর হওয়ার পর প্রশ্ন উঠছে - যেখানে আধিকারিকই বিচারকের ভূমিকা পালন করেন সেটাই কি গণতন্ত্রের স্বরূপ? এটাই কি মুক্ত বাজার? মুক্ত গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা? ধরুন বাজারের এক ছোট কৃষককে আম্বানী বা আদানির সঙ্গে পণ্যের দাম নিয়ে দর কষাকষি করতে হবে: সেই বাজারই কি মুক্ত বাজার? অর্থনীতির বই বলে, সমস্ত ক্রেতা ও সমস্ত বিক্রেতা কারও যখন দর কষাকষি করার ক্ষমতা থাকে না, সবাই দামটা মেনে নেয়। কেউই দাম নির্ধারণ করে না। তখনই মুক্ত বাজারে দাম নির্ধারিত হতে পারে। অর্থনীতির জেনারেল ইকুইলিব্রিয়ামের তত্ত্বতেও বাজারের ভারসাম্য দাম নির্ধারণ করে একজন নিরপেক্ষ "নিলামকারী’, সে যেন ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের কল্পিত ভগবান, যিনি বাস্তবে থাকুন বা না থাকুন, তাকে কল্পনায় অস্তিত্ব দিতেই হবে। কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য যেন এই নিলামকারী দ্বারা নির্ধারিত দামের এক অত্যন্ত অসম্পূর্ণ রূপ। কৃষকরা যদিও চান, সরকার চান না এই ন্যূনতম মূল্য। বরং সরকার চান "খোলা বাজার’, যেখানে ছোট চাষি আম্বানী বা আদানির সঙ্গে দরাদরি করবে এবং সরকার ঠিক করবে আইন কার পক্ষে! এই মুক্ত বাজারের কল্যাণকর ফল নিয়ে মূলধারার অর্থনীতিবিদরা গদগদ, এই নিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় তাদের কথা চালাচালি। সেই অবসরে মিস্টার আম্বানীর রিলায়েন্স কৃষিপণ্যের খুচরো বাজার দখল করছে। এবং জিও সমস্ত অনলাইন কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত। আদানিও কৃষিপণ্য চালানি সংরক্ষণ ও পরিবহনের ব্যবসা বাড়ানোর কাজে ব্যস্ত। সহজবোধ্য কারণে জিও নিয়ন্ত্রিত ফাইভ জি নেটওয়ার্ক সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের ডিজিটাল পুঁজিবাদ নিয়ে সরকার বিশেষ ভাবে এখন উৎসাহী। বেরিয়ে আসার পথ আছে কি?
কৃষকরা দেখিয়ে দিয়েছেন হতাশায় ডুবে যাওয়া ভুল। দিন বদলায়, কিন্তু সব সময় তা শুধু কিছু অসম্ভব বিত্তশালী ও তাদের তাঁবেদারদের ইচ্ছেমতো হয় না। দিন বদলের পালা আসে, যদি সাধারণ মানুষ তাদের স্বাভাবিক দুর্বলতা সত্বেও ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন। আর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে, যারা এমনিতে গরিবের জন্য উপযোগী উন্নয়নের কথা বলে না বা "যান্ত্রিক কর্পোরেট কৃষি ব্যবস্থাই ভবিষ্যতের এল-ডোরাডো’- এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে গলা তোলার সাহস দেখায় না। তারাও ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। কৃষকদের দীর্ঘস্থায়ী মরণপণ প্রতিরোধ পরিস্থিতিকে সেই দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। সম্ভাবনা আজ আর কল্পনাবিলাস নয়। মার্ক্সের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে রাখা দরকার যে, ‘মানুষ ইতিহাস রচনা করে কিন্তু তাদের নিজেদের তৈরি করা পরিস্থিতিতে নয়।’ সেই সময় এখন এসেছে, পরিস্থিতি প্রস্তুত। আফ্রিকার প্রবাদের সেই সিংহ এখনও ভেড়ার দলকে নেতৃত্ব দিতে পারে। পরাস্ত করতে পারে এমন এক শত্রুকে যাকে আমরা এতকাল অপরাজেয় মনে করেছিলাম।
অর্থনীতিবিদ অমিত ভাদুড়ী জওহরলাল নেহরু বিশবিদ্যালয়ের (JNU) প্রাক্তন এমেরিটাস প্রফেসর, শিক্ষা কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, আমেরিকার ম্যাসাচুসেট্স ইন্সটিটিউট অভ টেকনোলোজি (MIT) এবং ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে; অধ্যাপনা সারা পৃথিবী জুড়ে। গরিব মানুষকেও উন্নয়নের জোয়ারে সামিল করার ব্রতে তাঁর কাজ।