আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি। তিনি যা বলেন, ঠিক সেই কাজটাই করেন। শুধু মাঝে মধ্যে লোকজন বুঝতে পারে না, এই যা! তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখেন সবসময়। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে ভারতীয় অর্থনীতি থেকে কালো টাকা হাপিস করে দেবেন। সেই কথা কিন্তু তিনি রেখেছেন ‘নোট বাতিল’ নামক এক ম্যাজিক ফর্মুলা দিয়ে। যার ফলে রাতারাতি সমস্ত বড় ব্যবসায়ীরা একদিকে তাদের কালো টাকাগুলো সাদায় রূপান্তরিত করে নিল, আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর অনুৎপাদক সম্পদের (Non performing assets) বোঝা বেড়ে গেল। ফলটা সকলেই দেখতে পেল। শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকা বহু মানুষ ফলটা দেখা পর্যন্ত বাঁচতেই পারল না, এই যা!
এই ম্যাজিক ফর্মুলার মতো তিনি আরও ম্যাজিক ফর্মুলা দিয়েছেন! এই যেমন মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে আকস্মিক লকডাউন ঘোষণা করা, সঙ্গে থালা-বাসন বাজানো আর প্রদীপ জ্বালানোর মতো বুদ্ধি। অবশ্য কারও কারও বাড়িতে বারান্দা ছিল না! এমনকী কারও বাজানোর মতো বাসনও নয়! কেউ কেউ তো লড়াইটা শুরু করার আগেই পথে মারা গেলেন। তাঁরা পরিযায়ী শ্রমিক, যাঁরা বহু পথ হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন।
তারপর আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেবেন, এবং করলেনও। এবং তিনি সেটা করলেন কড়া লকডাউনের পর্দার আড়ালে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আসলে একজন অত্যন্ত বিনয়ী ব্যক্তি, তাই তো তিনি কখনওই তাঁর কৃতকর্মের কথা গর্ব করে প্রচার করেন না! কিন্তু দেশের মানুষের হিসাবটা জানা উচিত। মাত্র 227 দিনে কৃষকদের আয় সত্যিই দ্বিগুণ হয়ে গেল! সম্প্রতি প্রকাশ হওয়া অক্সফ্যামের একটি রিপোর্ট থেকে আমরা জানতে পারি যে, “পেট্রোল, টেলিসংযোগ ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সর্ববৃহৎ শেয়ার হোল্ডার তথা ভারতের সব থেকে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানী তাঁর সম্পত্তি 2020 সালের 18 মার্চ এবং 31 ডিসেম্বর দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে নিয়েছেন, যা মার্কিন ডলারে 3620 কোটি থেকে বেড়ে 7830 কোটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।” অন্যদিকে ফোর্বস-এর ধনী ব্যক্তির তালিকা অনুযায়ী তাঁর সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি, 8900 কোটি ডলার। এই সংখ্যাটি ভারতের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানির সম্পত্তির তিনগুণ। যদিও তিনিও তাঁর সম্পত্তি বাড়িয়েছেন এই সুযোগে। কিন্তু আমরা জানি আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই কৃতিত্বগুলো সর্বসমক্ষে স্বীকার করবেন না, কারণ তিনি অত্যন্ত বিনয়ী পুরুষ! তিনি এটাও জানাননি যে, এই দুই কোটিপতি আগামীদিনে সম্মানীয় কৃষক হতে চলেছেন! কারণ, কৃষিপণ্যের খুচরো বিপণন এবং সংরক্ষণের বিশাল বাজারের দখল তাঁদের হাতে আসছে। ভবিষ্যতে যখন এঁদের আয় দেশের বাকি কৃষকদের আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে তখন এক লাফে ভারতীয় কৃষকদের গড় আয় দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যাবে সহজেই! এখানকার এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (IMF), ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের কিছু প্রো-কর্পোরেট বাজারমুখী অর্থনীতিবিদ হয়তো এটা আগেই বুঝে ফেলেছিলেন! তাই তো তাঁরা বিষয়টা নিয়ে মিডিয়ায় এতটা সরব এবং আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কৃষকদের গড় আয় এক লাফে অনেকটা বেড়ে যাবে, যদি গুজরাটের এই দুই কর্পোরেট সংস্থার মালিকদের তাঁদের একজন বলে গণ্য করে নেওয়া হয়। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আরও নিবিড় হয়েছে বিমানবন্দরের কন্ট্রাক্ট, ইলেক্টোরাল বন্ড ইত্যাদির কারণে! তাই তো এই তিনটি কৃষি বিল পরিকল্পিতভাবে চালু করতে চাওয়া হচ্ছে। ভারতের এলিট সম্প্রদায় অবাক হচ্ছে এটা ভেবে যে, এই সাধারণ অঙ্কটা কেন কৃষকরা বুঝতে পারছে না! শত হলেও এই বড়লোকরা লকডাউনে যখন ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে, তখন তাঁদের সম্পত্তির বৃদ্ধি ঘটাচ্ছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র আম্বানী আর আদানির কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বাড়ার কারণে। এই জিনিসটি নজরে আনে হুরুন ইন্ডিয়া লিস্ট, একই জিনিস লক্ষ্য করে প্রাইসওয়াটার হাউজকুপার্স এবং সুইজারল্যান্ডের ইউবিএস। একমাত্র কৃষকরাই এই শেয়ার কিনে মুনাফা লোটার পথে না গিয়ে জমিতে বেশি খেটে অল্প আয়ে খুশি ছিল!
তো যখন কৃষকরা এরকম অসভ্য, বেয়াদপ ছাত্রের মতো ব্যবহার করছে, প্রকৃত শিক্ষা না নিয়ে, তখন প্রধানমন্ত্রীর আর কীই বা করার থাকতে পারে! তাঁদেরকে আটকেই তো শিক্ষা দিতে হবে নাকি! পেরেক পুঁতে, কাঁটা দিয়ে, ট্রেঞ্চ কেটে দিল্লির সিংঘু এবং অন্যান্য সীমান্ত, যেখানে কৃষকরা জমায়েত করেছেন, সেখানে বেষ্টনী দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ইদানীংকালে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে এই সন্ত্রাসবাদীরা, খালিস্তানি, শহুরে নকশাল, বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা পাল্লা দিয়ে দেশের ক্ষতি করছে! আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানেন মিডিয়া ভাইরাস কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তাই তো আমাদের প্রধানমন্ত্রী সর্বদা এই ভাইরাস থেকে সতর্ক থাকেন। উনি তাই বারংবার খালিস্তানি, আন্দোলনকারী পরজীবী, টুকরে টুকরে গ্যাং- এদের থেকে সতর্ক থাকতে বলেন। এরা সকলে দেশদ্রোহী, যারা এই কৃষক আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে কৃষকদেরও নিজেদের মতো করে তুলছে। তারা যদি দেশদ্রোহী নাও হয়, তবে সরকার বিরোধী তো বটেই। সরকার বিরোধী না হলেও, সরকার বিরোধী দলের তো বটেই। যাই হোক আমরা সকলে নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমোতে পারি, কারণ আমাদের এরকম একজন শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী আছেন (যাঁর 56 ইঞ্চির ছাতি), যিনি এসব ছোটখাটো বিভেদগুলো টানেন না!
তাই কৃষকরা আপাতত অচল ভাবেই দিল্লির সীমান্তে আছেন কাঁটা, পেরেক ও পুলিশের কড়া নজরদারিতে। সামান্যতম সন্দেহ হলেই বা কোনও কিছু ছাড়াই তাঁদের ওখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী সহ রাষ্ট্রশক্তি তৈরি আছে এই সমস্যার মোকাবিলার জন্য। যদিও, কৃষক পরিবারের মহিলা, পুরুষ, বাচ্চা সকলেই অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। তাঁদের একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে তাঁদের ট্র্যাক্টর। দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা হয়তো এই অসম লড়াই জিততে পারবেন না।
তবু, কিন্তু এই অসম লড়াইয়ের ফল যেন ক্রমশই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে! আর এই কৃষকরা যে শুধুই ভয়াবহ, একগুঁয়ে তাই নয়, তাঁদের সংকল্প বিন্দুমাত্র টলেননি এখনও। উল্টে তাঁরা যেন এক বিচিত্র পথ খুঁজে পেয়েছেন এই লড়াই চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁরা দিল্লি আসতে ইচ্ছুক নন, তাঁরা কোনওরকম বক্তৃতা শুনতে চান না, প্রধানমন্ত্রীর মন কি বাত-ও না, তাঁরা সরকারের সঙ্গে আলোচনাতেও বসতে চান না, যতক্ষণ না সরকার সত্যিই কোনওরকম আলাপ আলোচনায় বসে সমস্যাটা মেটাতে চায়। এমনকী তাঁরা সংসদে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া মৌখিক আশ্বাসও বিশ্বাস করতে চান না। তাঁরা চান যে, তাঁদের দাবিটাকে আইন হিসেবে পাশ করিয়ে দেওয়া হোক। সরকার বাহাদুর আরও ভয় পাচ্ছে এটা বুঝে যে, তাঁদের মধ্যে কোনও তাড়া নেই, তাঁরা শুধু চান যে তাঁদের দাবি মানা হোক। তাঁরা তাঁদের এই দাবি ছড়িয়ে দিচ্ছেন এবং দৃঢ় করছেন শুধুই পাঞ্জাব, হরিয়ানা আর পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের শিখ এবং জাঠ সম্প্রদায়ের মধ্যেই নয়, তাঁরা এটা উত্তর, মধ্য ভারত, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, বিহার, মধ্যপ্রদেশেও ছড়িয়ে দিচ্ছেন। মহাপঞ্চায়েতগুলি যেভাবে বহুসংখ্যক মানুষকে নিয়ে আসছে, তাতে এই আন্দোলন জাত, ধর্ম সবের উর্ধ্বে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। বিন্ধ্য পর্বতের নিচে অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক, কেরালায় রোজ নিত্যনতুন ভাবে কৃষকদের এই আন্দোলন শক্তি জোগাচ্ছে। সেখানে তাঁরা নিয়মিত মিছিল বের করছেন কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে। যদিও এখনও এই কৃষক আন্দোলনের ঢেউ পূর্ব ভারতে খানিকটা হলেও কম। কিন্তু তা যদি একবার বঙ্গোপসাগরের তীরে এসে আছড়ে পড়ে, তবে বিজেপির সমস্ত আশা ভরসা যে ডুবে যাবে তা বলাই বাহুল্য। কৃষকদের একটা উত্থান দেখা যাচ্ছে গোটা দেশ জুড়ে। তাঁদের সরকার বেষ্টনীর মধ্যে ঘিরে ফেলতে চাইছিল। কিন্তু উল্টে তারাই এখন গোটা দেশ ঘিরে ফেলছে। এখন এটা সম্পূর্ণভাবেই রাজনৈতিক দলগুলোর উপর নির্ভর করছে যে, তারা ভোটে জেতা-হারার হিসাবের ঊর্ধ্বে উঠে এই কৃষি আইনগুলি এবং তাদের নির্মাতাদের মূলোচ্ছেদ করতে পারবে কিনা!
অর্থনীতিবিদ অমিত ভাদুড়ী জওহরলাল নেহরু বিশবিদ্যালয়ের (JNU) প্রাক্তন এমেরিটাস প্রফেসর। শিক্ষা কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলোজি (MIT) এবং ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে; অধ্যাপনা সারা পৃথিবী জুড়ে। গরিব মানুষকেও উন্নয়নের জোয়ারে সামিল করার ব্রতে তাঁর কাজ।