4thPillar


কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না

বিতান ঘোষ | 08-04-2021June 3, 2023
কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না

কালের স্রোত এমনই যে, কোথায় কখন ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেক সময় তা বোঝা যায় না। গত বছর এই সময়টায় যেমন নিস্তরঙ্গ পারাবারে কূলহীন হয়ে ভেসে যাচ্ছিলাম আমরা। কূলের দেখা মিলছিল না। তারপর একটু আলো ফুটতেই কূলের রূপোলি বালি দেখা গেল। আমরা ঘর বাঁধলাম। খামখেয়ালের খেলাঘর। আগলে রাখলাম সেই ঘরকে। বসতও করলাম সেই ঘরে। ভেবেছিলাম এই ঘরকে আর ভাঙব না, ভাঙতেও দেব না। সবাই মিলে থাকব মিলেমিশে। ঝড় থেমে গেছে, কালো পিচের রাস্তায় রক্তের দাগ শুকিয়েছে, রেললাইনে পড়ে থাকা রুটিটাও হয়তো কাক-শকুনে খেয়ে নিয়েছে— কিন্তু মনুষ্যত্ব? মমত্ব? তারা তো মরেনি। হয়তো তারাও সংক্রামক হয়েছে। অন্তত হওয়ার তো কথা ছিল



এই তো একবছর আগে। মনে হয়েছিল মহামারী এসে মিলিয়ে দেবে আমাদের সকলকে। শারীরিক নৈকট্য না থাক, মানসিকভাবে আমরা সকলে বেঁধে বেঁধে থাকব। আর একটু অকৃপণ হয়ে ভালবাসব। পাড়ার উল্টোদিকের ভীষণ ঝগড়ুটে জেঠিমাকে দেখেছিলাম, চিন্তায় চোখমুখ বসিয়ে ফেলে ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়েছেন। জেঠুর 120 টাকা রোজের চাকরিটাও তখন ছিল না। কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ভিতরে। ভেবেছিলাম মনের ওই খামখেয়ালের খেলাঘরে এদের সবাইকে নিয়ে থাকব। অখণ্ড অবসরে বাড়ির বাগানে অনেকগুলো গোলাপ ফুটিয়েছিলাম সেই সময়। ক'দিন পর অযত্নে সব ঝড়ে গেল। হয়তো নতুন করে দেখা স্বপ্নগুলোও



সেদিন সবাই বাঁচতে চেয়েছিল। ত্রাণের লাইনে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল শ্যামল আর আসগর কাকু। বড় ভাল লেগেছিল। দীর্ঘ মহামারী ভয় ঘোচাল আর আমরা কেমন যেন পুনরায় ডাক্তার জেকিল থেকে মিস্টার হাইড হয়ে গেলাম। উত্তরপ্রদেশের একটা মন্দিরে জল খেতে গিয়ে মুসলিম কিশোর বেদম মার খেল। যিনি মারলেন তাঁকে সমর্থন করলেন মন্দিরের বাকি সেবাইতরা। সময় অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে বোধহয় একটু হাসল এবং নিশ্চিন্ত হল, মহামারীর ভয় কাটবার পর মানুষ আবার তাঁর আদিম পাশবিক গুণাবলীগুলো ফিরে পেয়েছে। পুরনো আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ফেরেনি। সকাল হতেই আশেপাশের বাড়িতে ঘনঘন বাসন-কোসন ঝনঝনায়। বলা ভাল বিদ্রোহ করে। তবে, পাঁচু কাকা এখন রিকশা নিয়ে বেরোয়। রাতে কোনওক্রমে রিকশা টানতে টানতে বলে, "ভাইপোওও, দাদা না দিদি কে জিতবে এবার?'



আমিও কী জানি কে জিতবে। আমি বলি তুমি কী বুঝছ? রিক্সা থেকে টলোমলো পায়ে নেমে কাকা বলে, "হিন্দু-মুসলিম করছে সবাই। তুমি বলো এটাই কি আমার ভারত?' কাকা রাতের দিকে দার্শনিক হয়ে যায়, আমি জানি। কিন্তু, সত্যিই তো এটাই কি আমার ভারত? বর্ণহিন্দু বামপন্থী পরিষ্কার বলে দেন তিনি কোনও মুসলিমকে ঘর ভাড়া দেবেন না। পাড়ার মোড়ে মঞ্চ বেঁধে, যুযুধান দুই পক্ষই বলছে, "আমরা করোনায় আপনাদের দেখেছি, এবার কিন্তু আপনাদের আমাদেরকে দেখতে হবে।' মুমূর্ষু সময়টা যখন শ্বাসকষ্টে কাতরাচ্ছে, আমরা সবাই তাকে অক্সিজেন দিয়ে সুস্থ করেছি। এখন সুস্থ সময়ের বুক থেকে সব প্রাণবায়ু বার করে নিতে হবে? কে কতটা তাকে সুস্থ করেছি, তার হিসাবনিকাশ হবে?



যারা দীর্ঘ পথ হেঁটে ঘরে ফিরেছিল, তাদের গ্রামে কাজ জোটেনি। তারা ফিরে গেছে আবার পুরনো কাজের ডেরায়। অনেকে গেছে কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঠ সাজাতে। অমানুষিক পরিশ্রমে মরেছে অনেক ক'টাই। আর এদের নিয়ে কেউ ভাবেনি। কেউ নিউজপ্রিন্ট ভরায়নি। এমনিও এরা নিজের রাজ্যে ভোট দিতে আসে না। তাহলে এদের কথা ভেবে কী লাভ!



অনেকেই এখনও মাস্কটা পরেন, রাস্তাঘাটে ঘুরে দেখি। আমিও পরি। কিছুটা সংক্রামক ব্যধি থেকে বাঁচতে আর বাকিটা লজ্জার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে। মনের সেই খেলাঘর অচিরেই ভেঙে গেছে। সেখানে সবাই মিলেমিশে বাস করে না। আমরা আবার সবাই হিন্দু, মুসলমান, বামুন, কায়েত, তৃণমূল, বিজেপিতে ভাগ হয়ে গেছি। অচেনা মহামারীর সামনে এক হয়ে বাঁচার মিথ্যে অঙ্গীকার করে, আত্মপ্রবঞ্চনা করেছি। আমরা কথা রাখেনি। কবিপ্রবর ঠিকই বলেছিলেন, কেউ কথা রাখে না। আচ্ছা, আর কতগুলো মহামারী, মহাযুদ্ধ শেষে আমরা কথা রাখতে পারব?


New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -বিতান ঘোষ | 08-04-2021

// Event for pushed the video