বাচ্চাটা সকাল থেকেই খুব কাঁদছে, রেখা কিছুতেই সামলাতে পারছে না। খিদের কান্না। রেখাই বা কী করে! বাচ্চার মুখে দেওয়ার মতো একমুঠো আনাজও ঘরে নেই। সে নিজেও দু’দিন ধরে প্রায় জল খেয়ে আছে। ছুটকিটার এখনও তিন বছর হয়নি। অভুক্ত রেখার বুকের দুধও শুকিয়ে আসছে। বাচ্চাটা খিদের চোটে ঠাঠা করে চিৎকার করছে। রেল লাইনের ধারের ছোট্ট ঝুপড়িটায় রেখা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। বড়কিটা ফিরে এল। এসে মাকে বলল, “মা কোই কুচু নেহি দিয়া।''
রেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের জলটা কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে নিল। কাকেই বা দোষ দেবে? সবারই তো এক কষ্ট। এই ঝুপড়ির বেশিরভাগ লোকই টিরেনে হকারি করে। রেখার বরও টিরেনে টিপ, সেফটিপিন, চিরুনি, চুড়ি এসব বিক্রি করত। মোটামোটি সব ঠিকই ছিল। খেয়ে-পরে চলছিল, কিন্তু এই নতুন রোগ আর লকডাউন পুরো বস্তির মাজার হাড়টা ভেঙে দিল। প্রায় সাত মাস লোকাল টিরেন বন্ধ। টিরেনের গড়গড়ানিতে এখানে জীবনের চাকা ঘোরে। এত মাস লোকাল টিরেন বন্ধ থাকাতে এখানকার জীবনও মুখ থুবড়ে পড়েছে।
বেশিরভাগ ঘরেই আর হাঁড়ি চড়ার মতো অবস্থা নেই। রেখার বাইশ বছরের জীবনে এরকম পরিস্থিতি সে আগে দেখেনি। বিহারের পূর্নিয়াতে তার বাপের বাড়ি। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় বাড়ির লোকেরা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল। তারপর এই শহরের ঝুপড়ি। এখানকার ভাষা বুঝতেই অনেক দিন সময় লেগে গিয়েছিল। এখন রেখা ভাল বাংলা বলে। কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে মাতৃভাষাতেই কথা বলে।
বড়কির মুখের দিকে তাকালে মায়া হয়। পাঁচ বছরের মেয়েটা কী জানি কী বুঝেছে, খাওয়ার কথা আর বলে না। বড়কির তেল না পরা লাল শুষ্ক খোলা চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে রেখা বলে, ”উস তরফ রাহুল কী মা সে পুছা?” বড়কি হ্যাঁসূচক ঘাড় নাড়ায়। কেউ একমুঠো আটা বা চাল দিতে রাজি নয়।
ছুটকির কান্নাটা একঘেয়েমি ফোঁপানোতে এসে থেমেছে। আর কাঁদারও শক্তি নেই মেয়েটার।
রেখা বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। রেল লাইনের ওই দিকে রেকের মধ্যে একটা ক্ষতবিক্ষত মৃত বাচ্চা বিড়াল পড়ে আছে। মুন্নি খিদের জ্বালায় নিজের বাচ্চাকে খেয়ে নিয়েছে। এখন পরম আয়েশে থাবায় লেগে থাকা রক্ত চাটছে। রেখা একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওই দিকে তাকিয়ে, ছুটকিকে কোলে তুলে নেয়। তারপর বড়কি কে বলে, “বাজার সে আতে হ্যায়।“
বাজারটা ঝুপড়ি থেকে একটু দূরে। বিকেল বেলার দিকে প্রায় ফাঁকাই হয়ে যায়। ওখানে হিন্দোলের কিছু বন্ধু আছে। তাদের বলে যদি কিছু খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু তারাও তো মহা ঢ্যামনা। এমনি এমনি কি আর খাবার দেবে?
হিন্দোলকে গালাগালি দিতে দিতে বাজারের দিকে চলল রেখা। কোলে বাচ্চাটা প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছে। টিরেন বন্ধ হওয়ার পর, মাস দু’য়েক সব ঠিকই ছিল। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে সব বিগড়ে গেল। হিন্দোলের মদের নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। রোজই বাড়িতে এসে তাকে মারত। যা সঞ্চয় ছিল, চারজনের পেট চালাতে চালাতে আস্তে আস্তে শেষ হয়ে গেল। লকডাউন উঠল, কিন্তু টিরেন চলল না। হিন্দোল এদিক-সেদিক নিজের মাল বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কেউ কেনেনি। মানুষের কাজ গেল, সুখ-শান্তি গেল, পেটের ভাতের জোগাড় করতে হিমশিম খায় সব, টিপ, চুড়ি, চিরুনি আর কে কিনবে? সপ্তাহ দু’য়েক আগে, নেশার ঝোঁকে হিন্দোল ছোট মেয়েটাকে খাট থেকে ছুঁড়ে ফেলে ছিল। রেখা বঁটি নিয়ে হিন্দোলের গলার ওপর পা তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। পরদিন সকাল থেকে হিন্দোলকে আর পাওয়া যায়নি।
রেখা মনে মনে বিড়বিড় করে, ছেলে তো তাই সংসার ফেলে পালাতে পেরেছে। সে তো মেয়ে। বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে কোথায় যাবে? মরতে হলেও এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে মরবে।
বাজারের মিষ্টির দোকান থেকে শিঙারা ভাজার গন্ধ আসে। হাতে একটা টাকাও নেই। রেখা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, প্রাণপণ সেই ঘ্রাণ নেয়। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে গন্ধটাকে নিজের নাকের মধ্যে দিয়ে টেনে পেট ভরাতে চায়। কিন্তু মহা হারামি পেট, এ ফাঁকি বেশিক্ষণ সহ্য করে না। পেটকে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ নয়। খিদেটা আলি আলি করে ধরে।
বাজারের মুখেই সুরেশের পান, সিগারেটের দোকান। রেখা সেখানে গিয়ে খুব আস্তে বলে, “দাদা কুছু টাকা উধার দেবে। বাচ্চা দুটাকে খাওয়াব। দো দিনসে কুছু না খেয়েছি।”
সুরেশ বিরক্তি নিয়ে বলে, ”ভাবি, তোমার বর পালানোর আগে আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে গেছে। সেটা আগে ফেরত দাও। তারপর আবার টাকা চেও।”
রেখা অবাক হয়। সুরেশ আর হিন্দোল জিগরি দোস্ত আছে। কতদিন রাতে মদের আসরে ওদের জন্য মাংস রান্না করে দিয়েছে সে। আর আজ...হিন্দোল টাকা নেয়নি। সুরেশ যা কঞ্জুস...এত টাকা ও কিছুতেই দেবে না। রেখা মাথা নিচু করে ফিরে আসছিল। তখন সুরেশ বলল, “ভাবি কিছু কাজ কাম করো। এভাবে চেয়েচিন্তে কতদিন টানতে পারবে।”
রেখা যে সে চেষ্টা করেনি তা নয়। বাবুর বাড়িতে বাসন মাজার কাজ সে করতেই পারে, কিন্তু এখন কেউ লোক রাখছে না। যারা করত তাদের অনেকের কাজ চলে গেছে। আরও বড় কথা সে বাচ্চা দু’টোকে কোথায় রাখবে? গতবছর ছুটকির দস্ত (ডায়ারিয়া) হয়েছিল। বড়কিকে পাড়ার এক বুঢ্ঢার কাছে রেখে ছুটকিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল ওরা। ফিরে আসার পর, বড়কি খুব কান্নাকাটি করেছিল। রেখা দেখেছিল বড়কির গায়ে, বুকে, থাইতে নখের আঁচড় ছিল। কয়েকদিন পেচ্ছাপ করতে গেলেই মেয়েটা খুব কাঁদত। হিন্দোলকে বলাতে হিন্দোল পাত্তা দেয়নি। বলেছিল, “ও সব তুমারা দিমাগ কা ব্যাহেম আছে। ও বুঢ্ঢা আদমি ক্যায়া করেগা? আনপড় হোতি তো ইয়ে সব ব্যাহেম না হোতা...লড়কিও কো শালা লিখাই-পড়াই শিখানা হি নেহি চাহিয়ে।”
কোন সাহসে সে মেয়েদের রেখে যাবে! তপনের ফুলের দোকানে গিয়ে সে একই কথা বলল। তপনতো প্রায় তেড়ে মারতে এল। বলে, ”হিন্দোল কি তোমাদের দায়িত্ব আমার ওপর দিয়ে গেছে নাকি? ব্যবসা চলে না একেই, নিজের সংসার চালাতে...ছিঁড়তে হয়, আবার টাকা ধার দেবে। তোমরা মেয়ে মানুষ, আর কিছু না হোক শরীর বেচে খেতে পারো। আমরা পুরুষরা কি বেচে খাব?” রীতিমতো গলাধাক্কা দেয় রেখাকে। রেখা কিছুটা এগিয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে। এদের সঙ্গেই কি সে এতকাল ছিল? এরাই কি সেই মানুষগুলো যারা হাসত, গল্প করত, ভাবি ভাবি বলে চা বানাতে বলত? সব কিছু তীব্র গতিতে বদলে যাচ্ছে। রেখার মনে হচ্ছে সে যেন ছোটবেলার মতো তাদের গ্রাম্য মেলার নাগরদোলায় উঠেছে। এখন মাটিতে নেমে মনে হচ্ছে ওই এক পাক নাগরদোলা ঘোরার মধ্যে পুরো দুনিয়া বদলে গেছে।
মেয়েটা আবার ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করেছে। বাজারে একটা ভাতের হোটেল আছে। কপাল ঠুকে, রেখা সেখানেই যায়। নিজের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে বাচ্চাগুলোর জন্য খাবার চায়। বুড়োলোকটা রেখাকে আপাদমস্তক মাপে। তারপর বাসি রুটির ঝুড়ি থেকে দু’টো রুটি রেখার হাতে দিয়ে বলে, “বাচ্চাটাকে কোথাও রেখে আয়। তাহলে আরও খাবার পাবি।“
রেখা ফুঁসে উঠে বলে, “হামাকে কি ওয়সা লেরকি ভাবছো?” দোকানি হলুদ দাঁতে হেসে বলে, “আরে আমার বয়স তো দেখ।”
তারপর আরেকটু হেসে বলে, ”যেমনি হোক মেয়েছেলে তো। শুধু একটু হাত সেঁকব গরম তাওয়ায়। যা বাচ্চাটাকে রেখে আয় কোথাও।“
রেখা কিছুক্ষণ, ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা বাজারের ময়লা মেঝেতে ঘষে। লোকটা তাড়া দিয়ে বলে, “নয়তো রুটি ফেরত দিয়ে যা। আমার অনেক কাজ আছে।”
রুটি দু’টো হাতের মুঠোতে আঁকড়ে ধরে সে। তারপর সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে বাজারের পেছন দিকে যায়। এখানটা মাছ আর মাংসের বাজার। একটা খালি ভ্যান রিক্সার ওপর, রেখা ছুটকিকে বসিয়ে, তার হাতে রুটি দু’টো দিয়ে বলে, ”পকড়কে বৈঠিরাহ ইধার। ম্যায় আভি আয়ি।”
ছুটকি ভ্যানের মধ্যে বসে। ছোট ছোট আঙুলগুলো দিয়ে কাগজের ঠোঙা থেকে রুটিটা বের করে। রুটি দু’টো হাত থেকে ভ্যানে পড়ে যায়। ছুটকি সেখান থেকে একটা রুটি তুলে খেতে শুরু করে। ছোট ছোট কামড়ে গোগ্রাসে রুটি খায়। রুটিটা যখন অর্ধেকের বেশি খাওয়া হয়ে গেছে, রেখা তখন হন্তদন্ত হয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে আসে। দোকানি রাতে এখানে ভাত খেয়ে যেতে বলেছে। কতদিন যে গরম ভাত খায়নি রেখা। হাতে আরও চারটে রুটি। হঠাৎ মনে পড়ে, পাঁচ/ দশটা টাকা চেয়ে আনতে পারত। শুকনো রুটি বাচ্চাগুলো কীভাবে খাবে? একটা সসের ছোট প্যাকেট কিনলে সস মাখিয়ে রুটিগুলো খাওয়া যেত। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজের ওপর রেগে যায় রেখা। সামনে তাকিয়ে দেখে ছুটকি রুটি খাচ্ছে। কিন্তু রুটিতে লাল লাল কী লাগানো।
মাকে দেখে, সারা মুখে লাল মাখানো ছুটকি, বাকি রুটির টুকরোটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল। রেখা জিজ্ঞেস করে, “সস কাহাসে আয়া।” ছুটকি ভ্যানের উপর আঙুল দেখাল। রেখা দেখল, সারা ভ্যানটাতে রক্ত শুকিয়ে গদের আঠার মতো থিক থিক করছে। ভ্যানের সামনের দিকে বস্তার মধ্যে রাখা ছাল চামড়া থেকে এখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। সেই রক্তে রুটি দু’টো লাল হয়ে গেছে। রেখা নিচে পড়ে থাকা রুটিটা হাতে অন্য রুটিগুলোর মধ্যে মিশিয়ে ছুটকিকে কোলে তুলে ফিরে চলল। রাতে গরম ভাত খাবে। বাচ্চা দু’টো অনেক দিন ভাত খাইনি। ঝুপড়িতে গিয়ে দেখল, বড়কি বিছানাতে ঘুমিয়ে আছে। বড়কিকে জাগিয়ে তার হাতে দু’টো রুটি দিয়ে রেখা বলল, “অব ইয়ে দো খা লে, রাতমে আচ্ছা খানা মিলেগা।'' বড়কি রুটিটার দিকে তাকিয়ে ছিল। রেখা বলল, ""সস হ্যায়, খা লে।”