4thPillar


সময় ও আমি

রাকিবা সুলতানা | 29-07-2020May 27, 2023
সময় ও আমি

সাহিন আর আমার কথার অন্ত নেই; কথায় কথায় ভোর হয়ে যায়। সূর্য এসে উঁকি দেয়- রাতজাগা সব কথোপকথনের  দালানে। তারপর, নীলচে আলোর পর্দা ছিঁড়ে, সাদা আলোয় ঝলকে ওঠে শহর; আছড়ে পড়ে- আমার ঘরের জানালায়। আমাদের প্রশ্ন-উত্তরের খেলায় রোজদিনই জন্ম হয় নতুন চিত্রনাট্যের-


- প্রিয় বন্ধু কি কিছুটা প্রেমিক নয়?
- কীভাবে? সব ভালবাসা কি একরকম হয়?
- তাই? কেমন আলাদা? বাংলায় "কি' ও "কী'-এর ব্যবহারিক ফারাক যতটা?
- হ্যাঁ। তেমনই বোধহয়। কেবলই প্রয়োগে ভুল করি আমরা

পাল্টা হাওয়ার স্রোতে  টুকরো কথাগুলো ভেসে উঠতো- সাইকাডেলিক স্বপ্নে। প্রায়ই আগডুম-বাগডুম গল্পের তালে আমরা "আরণ্যক’ ঘুরতে যেতাম। বিভূতিভূষণ পেরিয়ে ইজিপ্ট। মরুভূমি। আরব। লরেন্স অব অ্যারাবিয়া...

ওর চিবুকের কাটা দাগে একটা জোনাকি পুষেছিলাম। সাহিন সামনে এলেই দুটো হলুদ পাখি ক্রিসক্রস করে উড়ে এসে বসত আমার কাঁধে। একজন বলত- "গল্প হলেও সত্যি হবে এমন ইশারা’, অন্যজন বলত- "প্রেম-প্রলাপেই কবর হবে- বেচারা’। দ্বিতীয় জনের কথা ভাল লাগত না। মুখ বেঁকিয়ে বলতাম- "দুঃখে আমায় মানায় ভাল, তুই কি জানিস?’

পাখিরা উড়ে যেত। আমরা একসঙ্গে হাত ধরে দাঁড়াতাম একটা বালির বাড়ির সামনে। তারপর, সময়ের সঙ্গেই বদলে যেত আলো। উঠোনের ম্লান বাতির, হলদে আলোয় হৃদয়ঙ্গমের চেষ্টা করতাম-  "বদল’।  

সাহিন আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড়। আমাদের আলাপ হয় ইউনিভার্সিটিরই আয়োজন করা একটা ডিবেট কম্পিটিশনে। তখন আমি গ্র্যাজুয়েশনের ফার্স্ট ইয়ারে; ও সবে মাস্টার্সের শেষ সেমিস্টার দিয়েছে। আমাদের মধ্যে কেমিস্ট্রির থেকেও বেশি ছিল- কমপ্যাটিবিলিটি। বিষয়টা ‘কবিতার' মতো হয়েও কবিতা না। ‘ছোটোগল্প' হতেই পারে, আবার ‘কিছু না'ও হতে পারে। 

যদিও আমাদের প্রাত্যহিক হাঁটা, চলা, ঘুম, কান্না, অসুখ, যাপন, মৃত্যু এসব কবিতারই উপাদান। তবে সাহিন ভালবাসত গল্প, সিনেমা। সাহিনের জীবনের থেকে প্রত্যাশা অনেক। বন্ধু-বান্ধব, সম্পর্ক বা যাপনের খুঁটিনাটিতে পর্যাপ্ত রসদ না পেলে তাকে নিজের যোগ্যতর বলতে দ্বিধাবোধ করত। স্বপ্নের তাড়নায় ঘুমাতে পারত না প্রায়ই। সেসব জেদি স্বপ্নের আখ্যান, আমাকেও টেনে তুলত কখনও- ওর সঙ্গে। প্রায়ই শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আঙুলে মিনারের চূড়া তাক করে বলত- "দেখবি, একদিন আমি ঠিক এই উচ্চতায় উঠব'।

নিশ্চিত পারবি। তুই অনেক বড় হবি। সব আকাঙ্খা পূর্ণতা পাবে। আমি সাহস দিতাম। কিন্তু একবার প্রশ্ন করলাম- "তুই শহীদ মিনার হলে, আমি কি ঘাস?’ সে প্রশ্ন অযৌক্তিক, তাই হা হা হি হি হো হো-এর কলধ্বনিতেই হারিয়ে গেল। ঘাসের মতোই পায়ে দুমড়ে এগিয়ে গেল সাহিন।  

সেদিন, আমি কথা বলছি কম, ঘড়ির দিকেই তাকাচ্ছি বেশি। বাড়িতে হাতঘড়ি পরা আমার পুরনো স্বভাব; আমার মনে হয়, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মানুষের জীবনের ছন্দময়তার একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। ঘড়ির কাঁটার চলন চোখে না দেখলে আমার ছন্দপতন হবে।

"কীরে? অন্যমনস্ক কেন? হয়েছে কী তোর?' একটু ধমকের ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল সাহিন। গলা খাঁকারি দিয়ে উত্তর দিলাম "কিছু না।" আমার হাবে ভাবে অসংলগ্নতা। অস্বস্তি। বারোটা বেজে গিয়েছে। বন্ধুদের ফোন আসতে শুরু করেছে পরপর। সাহিনের হুঁশ নেই। কথার তাল হারিয়ে 'স্বাধীনতা' থেকে চলে গেছে 'সংবিধানে'। যথাসম্ভব চেষ্টা করেও আজ মন দিতে পারছি না। একেই পুরনো বন্ধুদের ফোনের লাইন পড়েছে। অন্যদিকে সাহিন কথা বলেই চলেছে। কিন্তু সেসব কথায় আতিথেয়তা নেই, কেবলই পথ্য আছে।

"ও কি ভুলে গেল? একেবারেই কি খেয়াল নেই কিছু? নাকি পরে বলবে?" এদিকে ঘড়িতে বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা হয়ে গিয়েছে। ফোন আসছে, ব্যস্ত পেয়ে তারা ফিরে যাচ্ছে। আমি দুঃখ পাচ্ছি ভিতর ভিতর। অবাকও হচ্ছি, নিজেকে নিয়ে! এই চব্বিশ বছর বয়সে এসেও জন্মদিনের উত্তেজনা গিলে খাচ্ছে আমায়? কিন্তু উত্তেজনা বা অনুভূতির যুক্তিসঙ্গত নিয়ম নেই। অস্তিত্বের প্রশ্নে আমরা সব্বাই জেদি শিশুর মতো। কথায় কথায় পরিণত মনস্কতার উদাহরণ দিই; কিন্তু ভিতর ভিতর আমরা নগ্ন। পেটের টান বা প্রেমের টানে সব্বাই একই সারির মানুষ। এই সময়, আমাদের হাত পেতে চেয়ে নিতে লজ্জা নেই। জানান দিতে পিছপা হই না, "আমি আছি।’


ধৈর্য্য হারিয়ে বলেই ফেললাম- 
"আমি ফোনটা রাখি? বন্ধুরা ফোন করবে আমায়।
সাহিন আরও কিছু বলত, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলব শুনে হকচকিয়ে "ও আচ্ছা! বেশ।" বলেই ফোন রেখে দিল।

এক এক করে ফোন সারলাম। শুভেচ্ছা বার্তা, ইয়ার্কি, ফাজলামি, স্মৃতিচারনায় আমার মনের ফাঁকা ক্যানভাস ভরে উঠছিল। কিন্তু কোথাও যেন একটা রং নেই মনে হচ্ছিল।

আমার অবচেতনের অবয়ব, অসহায়তার ব্যঙ্গ করল। তাও অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ভিতরের মানুষ, আমাকে দেখে ঠাট্টা করল, লজ্জা পেলাম। রাগ হল। পরে দুঃখ পেলাম। নিজেকে চিয়ার আপ করলাম। কিছু কিছু মনোজাগতিক বিষয়ে উপোস ভাল- এই ভেবেই ঘুমে ডুব দিলাম।    

পরদিন অনেক সকালে সাহিনের ফোন। চশমা ছাড়া স্পষ্ট দেখি- শুধু ওর নামের প্রথম অক্ষরটুকু। আমার হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গিয়েছে। ফোন ধরতেই পার থেকে একটা তীক্ষ্ণ তিরস্কার এসে, বুক বিঁধল-
"তোর সঙ্গে কাল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করছিলাম, তার মধ্যে তোকে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে হল?’ উত্তর দিইনি। সাহিন কি মজা করছে? ইচ্ছে করে এসব করছে? এমন অযৌক্তিক ব্যবহার তো এমনি দিনেই করে না, আজ জন্মদিনে কেন করছে? আমি নৈঃশব্দ্যের আবহেই আবদ্ধ রইলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, অপেক্ষা করব। নিশ্চিত ওর মাথায় অন্য কিছু চলছে।

সাহিন আগের দিনের কথা টেনে ঘোষণা করল, তার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা। এই বিজ্ঞাপনের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে, সে দিল্লি চলে যাবে; সিভিল সার্ভিসের প্রিপারেশন নিতে। আর কিছু মাসের মধ্যেই তার জীবনে অনেকরকম বদল আসবে, তাকে অন্য মানুষে পরিণত করবে স্বপ্নের সফর। এই কারণে পরোক্ষভাবে আমার জীবনেও কিছু পরিবর্তন আসবে, তার জন্য আমায় প্রস্তুত থাকতে হবে। এমন কথায় আমার বিষাদ বিভোর হতে হত কি? কে জানে! ততক্ষণে উত্তেজনা উদ্বায়ী হয়ে মিশেছে হাওয়ায়। তখন হাওয়ার গন্ধ কেমন ছিল? মনে নেই। আবছা অতীত স্মরণ করলে ভেসে ওঠে সুর। পিঙ্ক ফ্লয়েড। কমফর্টেবলি নাম্ব। সাহিন খবর রাখেনি আমার কথার। স্বপ্নের। তাই আমার প্রত্যাশা পর্বের কোনও ফেয়ারওয়েল ছাড়াই সমাপ্তি ঘটল ফোনালাপের।              

ফোন রেখে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। চুলগুলো ঘেঁটে গেছে। উদাসীনতায় ডুবে আছে চোখ। কিন্তু আমার হাসতে ইচ্ছে করছে। "Why am I so sad?' নিজেকে প্রশ্ন করলাম। এবার বিষণ্ণতা গড়িয়ে এল ঠোঁটে। লালচে পুরনো পাতার জীবনানন্দ থেকে ভেসে আসছে শব্দ-
"বেদনা পেতো না তবে কেউ আর,
থাকিতো না,
 হৃদয়ের জরা-- 
সবাই স্বপ্নের হাতে দিতো যদি ধরা।'

কিন্তু আমার স্বপ্ন,
 মানুষকে অতিক্রম করে যেতে পারে না কেন?
"উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়,
মানুষেরো আয়ু শেষ হয়।"

তবুও আমরা এমন লোভীর মতোই;
 মনে থেকে যেতে চাই। যা কিছু পাওয়া হয়নি, তার অপেক্ষা করি। অপেক্ষাই একমাত্র অবলম্বন। আমি অবাকও হই। আমার জীবনে অপেক্ষার বৃত্তে এমন অসহায়তার অভিলেপন কেন? আয়নায় মাঝে মাঝেই অতীত ধরা পড়ে। তাতেই আবার দেখতে পাই স্নিগ্ধকে। কী আশ্চর্য!  সেও কক্ষনও জন্মদিন মনে রাখতে পারেনি। প্রতি বছর দিনের শেষে জানতে পারত ফেসবুকের মারফতে। ফিরত সবার শেষে; শুভেচ্ছা জানাতে। চূড়ান্ত অপরাধবোধ নিয়ে। আমার পেছনে কসরত করতে হত না ওকে। আমি অন্যের অসহায়তায় ভীষণ দুর্বল। স্নিগ্ধকেও আমার কখনও কখনও কবিতার মতো মনে হতো। কিছু পুরনো অন্যায়ে শেকল পরিয়ে কখনও জাস্টিফাই করেছি- জিমি পোর্টার বা নিখিলেশের মারফত।

আজ, সাহিন। এখন আমার ফেসবুক নেই। মানুষকে মনে করানোর মাধ্যমও নেই তাই। জীবনে মানুষ বদলেছে আমার।  ঘটনাপ্রবাহ একই রয়ে গেছে। এখন মনে হচ্ছে আমিই শেষ কথা। আমার কালি বা তুলিই অন্য মানুষকে মুকুট জোগায়। আয়নার সামনে থেকে ফিরে এলাম। এলোমেলো ভাবনা আমায় যথেচ্ছ ক্লান্ত করেছে। অস্পষ্ট অনুভূতির কবলে পড়ে, ফোন ঘাঁটতে শুরু করলাম। নতুন মেসেজ- স্নিগ্ধর।

"শুভ জন্মদিন। আজ আর আমায় কেউ মনে করিয়ে দেয়নি।" চোখ বন্ধ করলাম। আরও ক্লান্ত বোধ করছিলাম। একটুও বিচলিত নই আমি। এ কেমন নিয়ম? যা আমি হয়তো কিছু বছর আগেও চেয়েছি, তা আজ আমায় শিহরণ দিচ্ছে না; আমি অপেক্ষা করছি অন্য কারও। সময়ের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক কি তবে ব্যস্তানুপাতিক? এ পৃথিবীতে মানুষের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ করে শুধুই সময়। আমরা সময়ের নিয়মে বাঁধা ধ্রুবক। জীবনে সময়ের আগে, তেমন কোনও কার্যকারিতা নেই। 

অপেক্ষা করতে থাকি। অপেক্ষায় আসলেই আলস্য বাড়ে। আলস্যের উঠোন বানিয়ে পড়ে থাকি দুপুর জুড়ে। সন্ধে হলে গল্পের আসর বসে বাড়িতে। আমি একের পর এক কবিতা পড়তে থাকি। মহাবিদ্রোহের কবিতা, জীবনের কবিতা, নৈরাশ্যের সংলাপ- " Life is but a poor player, a walking shadow.' শব্দের শেষে অনুসন্ধান করি নিজের; আর করি অপেক্ষা। সন্ধে পেরিয়ে রাত হয়। সাহিনের ফোন আসেনি এখনও, হাত ঘড়ি নিয়ে ছাদে যাই। তারার আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, অন্ধকার আকাশে। ঘড়িতে বারোটা বাজতে পাঁচ। দিন ফুরানোর মুখে, শেষ হওয়ার বেলায়। আমার মনের ভাব অস্পষ্ট। আমি অপেক্ষারত। কার? নিজেকে করা প্রশ্নের উত্তরের-
"আমি কে? শহীদ মিনার নাকি ঘাস?’


বাদামি আলোয় কিচমিচ করে ওঠে শব্দ- 
"সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব,--
নক্ষত্রেরো আয়ু শেষ হয়।’


New
নায়কের খোঁজে বাঙালি
নির্বাচনী বন্ড: সরকারকে সব জানালেও সুপ্রিম কোর্টকে বলতে কেন বিলম্ব স্টেট ব্যাঙ্কের
মুক্তমনের অম্লান ভাষ্যকার


Other Writings by -রাকিবা সুলতানা | 29-07-2020

// Event for pushed the video