4thPillar


আপ্যায়নে বাঙালি ও পোর্তুগিজ

পারমিতা সেনগুপ্ত | 22-10-2020May 27, 2023
আপ্যায়নে বাঙালি ও পোর্তুগিজ

রোনার খাঁড়া মাথার উপর ঝুলে না থাকলে এই বছরেও পুজোর সময়ে বাঙালি মেতে উঠত অতিথি আপ্যায়নে। প্রতিবার দুর্গাপুজোয় প্রতিমা বিসর্জনের পর শুরু হয় নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণের ধুম। আগেকার দিনে দশমীর দিনে মা-ঠাকুমারা বাড়িতে বসে নিজেরাই ক্ষীরের গজা, বিভিন্ন রকমের নাড়ু, ইঁচামুড়া (ওপার বাংলার), এলোঝেলো প্রমুখ সব মিষ্টি বানাতেন। সঙ্গে তারা নোনতা খাবার হিসেবে পরিবেশন করতেন কুচো নিমকি বা ঘুগনি। তাছাড়া এখনও অনেক বাঙালি বাড়িতে ভরদুপুরে যদি কেউ এসে উপস্থিত হন, গৃহকর্তা তাকে বাড়ির সকলের সঙ্গে বসে খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ করে থাকেন। সব পরিবারে না হলেও এখনও কিছু বাঙালি পরিবার এগুলো বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।


অতিথি আপ্যায়ন মানেই খাওয়া দাওয়া আর রান্না। বাঙালি রান্নায় প্রভূত পরিমাণে আছে পোর্তুগিজ প্রভাব। ধরা যাক অতি পরিচিত শুক্তো রান্নার কথা, যার প্রধান উপকরণ পোস্তবাটা ব‍্যবহারের ধারণাটা এসেছে পোর্তুগিজ রান্নার রেসিপি থেকে। আমি একটি মাংস রান্নার কথা উল্লেখ করছি, যেটা বাঙালি আসলে শিখেছে পোর্তুগিজদের কাছ থেকে। পদটির নাম ‘ভিন্দালু’। ‘ভিনহ’ বা মদ আর ‘আলু’ অর্থাৎ রসুন দিয়ে মাংস ম‍্যারিনেট করা হত বলে এরকম নামকরণ করা হয়েছে। বাঙালি তথা ভারতীয়দের রান্নায় এই মদের জায়গাটা নিয়েছে ভিনিগার। পোর্তুগিজরা যখন আমাদের দেশে ব‍্যবসা বাণিজ্য করতে এসে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে শুরু করে, তখন বাঙালি তথা ভারতীয়রা এদের কাছ থেকে শেখে বাংলায় যাকে আলু বলে সেই পটেটোর ব‍্যবহার।


বর্তমানে আলু বাঙালি হেঁশেলের প্রায় যে কোনও তরকারির প্রধান উপকরণ। শোনা যায় যখন সপ্তগ্রাম বাংলার অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল, তখন পোর্তুগিজরা মেদিনীপুরে ঘাঁটি তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করে ও স্থানীয়দের সঙ্গে গভীরভাবে মেলামেশা করতে থাকে। এর পাশাপাশি পোর্তুগিজরা এদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে থাকে এবং ক্রমশ বাংলাদেশের বিবাহের রীতিনীতি, যেমন- মালাবদল, সাত পাকে ঘোরা, কুসুম ডিঙা প্রভৃতি আচার অনুষ্ঠান নিজেদের মতো করে গ্রহণ করতে থাকে। ফলে পোর্তুগিজদের নিজস্বতা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, বাঙালিদের মতো পোর্তুগিজরাও খুব অতিথিপরায়ণ। একবার একটা আন্তর্জাতিক কমিশন পোর্তুগিজদের দশটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে। সেগুলোর মধ্যে একটি হল, এরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ হন। এরা আমাদের মতোই খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসেন। এদের মধ্যে রাগ, অনুরাগ, ভালবাসা সবকিছুর প্রকাশ এত তীব্র যে, এসপানিয়ার (স্পেন) লোকেরা এদের সুসভ‍্য জাতি বলতে নারাজ। যাই হোক তাদের বাড়িতে কেউ এলে তারা মদ ও পাঁউরুটি দিয়ে অতিথিকে আপ‍্যায়ন করতে ব‍্যস্ত হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয়, বাংলা ভাষাতেও মিশে আছে অনেক পোর্তুগিজ শব্দ। যেমন- ‘কাদেইরা’ থেকে কেদারা, আর ‘জানেলা’ থেকে জানালা ইত‍্যাদি। একটি পোর্তুগিজ গীতিকবিতার বঙ্গানুবাদ থেকে তাদের আন্তরিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। কবিতাটি পোর্তুগিজ ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশিত হল। মূল গানটি পোর্তুগিজ ভাষায় গেয়েছেন বিখ‍্যাত আমালিয়া রোদরিগেজ। এখানে ওই গীতিকবিতার অংশবিশেষ দেওয়া হল।

একটি পোর্তুগিজ বাড়ি

উমা কাসা পোরতুগেসা

বাড়িটি পোর্তুগিজ, বেশ আন্তরিক
ভেতরের টেবিলে রাখা সুধা ও পাঁউরুটি
যেন পরস্পরের শরিক।
আর যদি কেউ নম্রভাবে এসে দাঁড়ায় দরজায়
আমরা সবাই তাকে জানাই আমন্ত্রণ
একসাথে আমাদের টেবিলে করতে আসন গ্রহণ।
সবটাই খোলামেলা, খোলামেলা তার পরিবেশ
এতটাই খোলামেলা যে লোকে কাটাতে পারে না তার রেশ।
ছোট্ট এই নীড়ে দারিদ্রের মাঝে
পাওয়া যায় প্রাচুর্যের আভাস।
_ _ _

নীল টাইলসে খোদাই করা সাওজোসের
সেরামিক মূর্তিতে
খেলে যায় বসন্তের প্রথম সূর্যের আলো
কী এক অদ্ভূত মাদকতায়।
এ যেন দু’ বাহু বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেউ
আমারই চুম্বনের প্রতীক্ষায়।
নিশ্চয়ই এ কোনও পোর্তুগিজ গৃহ।
নিঃসংশয়ে এটি একটি পোর্তুগিজ গৃহ।
বাড়ির নম্র পরিবেশে রয়েছে
ভালোবাসা বেশ।

ছোট্ট এই নীড়ে চাই না আর কিছুই
চাই শুধু সুধা পাঁউরুটি আর
ভালবাসার সমাবেশ।
আর উঠতে থাকুক ধোঁয়া
বাটিভর্তি সবুজ গরম স‍্যুপ ‘কালদো ভের্দের’ ছোঁয়ায়।


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -পারমিতা সেনগুপ্ত | 22-10-2020

// Event for pushed the video