বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্বামী মারা গেলে, স্বামী মদ্যপ, উড়নচণ্ডী হলে, সংসারে আয় উন্নতি না হলে, জগতের হরেক রকম মানুষের হরেক রকম চাহিদাপূরণ না করতে পারলে মেয়েরা সচরাচর অলক্ষ্মী হয়ে থাকে। তাছাড়াও অলিখিতভাবে অলক্ষ্মী সাব্যস্ত হওয়ার অনেকরকম সম্ভাবনা রয়েই যায়।
রোজ পথেঘাটে, চেনা পরিসরে কিছু লক্ষ্মীর সঙ্গে দেখা হয়। অন্নদা পিসির মাতাল বর মদ খেয়ে খেয়ে সিরোসিস অফ লিভারে আক্রান্ত, শুয়ে বসেই তার দিন কাটে। সকালে বাড়ির গোয়াল থেকে দুধ দুয়ে এনে, পাড়ায় পাঁচবাড়ি কাজ করতে আসে অন্নদা পিসি। তারপর বাড়ি ফিরে ঘরের কাজকম্ম, অসুস্থ বরের সেবাশুশ্রূষা করে। পাড়ার লোক বলে, অন্নদা পিসি অলক্ষ্মী, মাতাল বরকে ঠিক পথে আনতে পারেনি। তবু অন্নদা পিসির পায়ের ছাপ বাড়ির লাল মেঝেতে পড়লে আমার অবিকল মায়ের আঁকা আলপনায় লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ বলে মনে হয়।
দেবী লক্ষ্মী সোনা আনেন, সমৃদ্ধি আনেন। অসমের লাভলিনা বরগোঁহাইরাও অলিম্পিক্সের মঞ্চ থেকে দেশের জন্য সোনা আনেন। কিন্তু তাঁরা কি লক্ষ্মী? পুরুষালি ভাব সারা শরীরজুড়ে, পুরুষদের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা। প্রতিবেশীরা এঁদের বাবা মায়েদের উদ্দেশ্যে নিশ্চয়ই প্রশ্ন ছোঁড়েন, ‘হ্যাঁগো, মেয়ের বিয়ে ফিয়ে কি দেবে না?’ আমরা জানি যে, শহরের কর্মস্থল থেকে রাত করে বাড়ি ফেরা মেয়েরা, গোড়ালি অবধি পা ঢাকা পোশাক না পরা মেয়েরা কখনও লক্ষ্মীমন্ত হয় না, তা সে যতই বিদ্যেবুদ্ধি অর্জন করুক। আর মেয়েমানুষ অত পড়াশোনা করেই বা করবেটা কী? ক'দিন পর শ্বশুরঘরে গিয়ে বংশের প্রদীপ জ্বালাবে মেয়ে।
ইদানীং কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক প্রচারে বলা হয়ে থাকে, ‘ঘরের লক্ষ্মীকে আসতে দিন, তাকে মারবেন না।' এমনিতে সমাজ জীবনে লক্ষ্মী বিশেষণটি ছেলে মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শান্ত, বাধ্য, অনুগত, কোনও বিষয়েই দ্বিরুক্তি না করার মতো সদগুণরাজি থাকলে, সে লক্ষ্মীছেলে বা লক্ষ্মীমেয়ে হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যখনই এই লক্ষ্মী শব্দটিকে কোনও সন্তানের প্রতি, বিশেষত কন্যাসন্তানের প্রতি দেবত্ব আরোপের জন্য ব্যবহার করা হবে, তখনই নিয়মকানুনের একটা চৌকাঠ তৈরি হয়ে যাবে। সেই চৌকাঠে আলপনা পড়বে, ধূপ-ধুনোর গন্ধও থাকবে অফুরান, তবু সেই লক্ষ্মীর মধ্যে থাকবে না প্রাণের উচ্ছ্বলতা।
নারীর ওপর দেবত্ব আরোপ করে তার পরিসরটাকে সংকীর্ণ করে দেওয়ার খেলাটি অনেক প্রাচীন। নারীকে লক্ষ্মীমন্ত হতেই হবে, হতে হবে প্রচলিত ধ্যানধারণার অনুবর্তী। নারীর যদি স্বাতন্ত্র্যবোধ তৈরি হয়, স্বতন্ত্র মত, রুচি, ইচ্ছা তৈরি হয়, তবে সে চঞ্চলা হবে, চপলা হবে। ব্যাস লক্ষ্মী তখন আর গেরস্থের ঘরে বসত করবে না। এতকিছুর পরও লক্ষ্মীমন্ত হতে চায় সব মেয়ে। দৈব দুর্বিপাকে যারা লক্ষ্মীমন্ত হতে পারে না, প্রচলিত সমাজব্যবস্থা যাদের লক্ষ্মীমন্ত হতে দেয় না, তাদের খবর ক'জনই বা রাখে? কোজাগরী লক্ষ্মীর জন্য গেরস্থ বিনিদ্র রজনী কাটায়, আর অ-লক্ষ্মীরা বিনিদ্র রজনী কাটায় লক্ষ্মী হওয়ার প্রতীক্ষায়, কিংবা লক্ষ্মীমন্ত হতে না পারার আফসোস নিয়ে।