জনপ্রিয় গায়ক কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ ওরফে কেকে-র আকস্মিক অকাল-মৃত্যুতে শোকবিহ্বল প্রত্যেকে। কলকাতার নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠান করার কিছু পরেই তাঁর মৃত্যুর খবর এই শোকের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শিল্প সাধনারত শিল্পীর মহাপ্রস্থান এমন রাজোচিতই তো হওয়া উচিত, মত সঙ্গীতানুরাগীদের একাংশের। কিন্তু এই শোকাবহের মধ্যেও যে বিদ্বেষ এবং সন্দেহের হলাহল উঠে আসছে, তা যদি আমাদের সমাজের একটা ঝাঁকিদর্শন হয়, তবে চিন্তার কারণ থাকে বৈকি।
কেকে কলকাতার কিছু স্বনামধন্য কলেজের অনুষ্ঠানে গান গাইতে এসেছিলেন। নজরুল মঞ্চে টানা দু'দিন তাঁর দু'টি অনুষ্ঠান ছিল। গায়ক রূপঙ্কর সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে সখেদে জানিয়েছিলেন, কেকে'রা এত ডাক পায়, অথচ তিনি এইসব কলেজ-অনুষ্ঠানে ডাক পান না। তাঁর আরও দাবি ছিল, তিনি নাকি কেকে-র চেয়েও ভাল গান গাইতে পারেন৷ রূপঙ্করের এই বক্তব্যে কতটা শ্লেষ আর কতটাই বা হৃদয়ের গোপন ব্যথা লুকিয়ে ছিল জানা নেই, কিন্তু রূপঙ্করের এমন বক্তব্যের পরের দিনই কাকতালীয় ভাবে কেকে মারা গেলেন। আশ্চর্য সমাপতন? আর যাইহোক রূপঙ্করের অমন বক্তব্য এবং কেকে-র অকালপ্রয়াণের মধ্যে কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। থাকতে পারে না। কিন্তু কেকে-র মৃত্যুর পরই তাঁর অনুরাগীরা রূপঙ্করকে তাঁদের প্রিয় গায়কের মৃত্যুর জন্য কার্যত দোষী সাব্যস্ত করে ফেললেন। নেটাগরিকরা আসরে নামলেন খানিক পরে। তাঁদের কারও বক্তব্যে উঠে এল, রূপঙ্করের অভিশাপেই নাকি কেকে মারা গিয়েছেন! হায়, একবিংশ শতকের গর্বোদ্ধত নগর সভ্যতা— যুক্তিবুদ্ধির অন্তরালে কীসব চেতনা প্রসবিত হয়েছে!
সে যাইহোক, রূপঙ্করের যেমন নিজেকে কেকে'র চেয়ে ভাল গায়ক বলে দাবি করার পূর্ণ অধিকার ও স্বাধীনতা আছে, তেমনই কেকে অনুরাগীদেরও রূপঙ্করকে গালমন্দ করার অধিকার আছে। কিন্তু সেনসেশান তৈরি করতে গিয়ে আমরা এতটাই ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান হারাব যে, নিজেদের ঔচিত্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না কেউ? সংবাদমাধ্যমের একাংশ কেকে-র মৃত্যুতে "ব্যথিত' সেলেব্রিটিরা রূপঙ্করকে কীভাবে "একহাত' নিয়েছেন, তাঁর ইতিবৃত্ত ফলাও করে প্রকাশ করতে থাকল। সেখানে নেটাগরিকদের মন্তব্য দেখে শিহরিত হতে হয় যে, আমরা এতটা অসহিষ্ণু সময়ে বাস করছি? রাজদ্বারে, শ্মশানে সর্বত্র, সর্বকাজে দোষ এবং দোষী ঠাওরে বেড়ানো (কেতাবি পরিভাষায় উইচ হান্টিং) আমাদের চেতনাকে কবে নিঃশব্দে গ্রাস করে ফেলেছে, আমরা বোধহয় তা বুঝতে পারিনি।
রূপঙ্কর না কেকে; কে বড় সঙ্গীতকার তা সঙ্গীতবোদ্ধারা বলতে পারবেন। রূপঙ্কর তাঁর বক্তব্যে হতাশার কথা তুলে ধরেছেন। আরও বাংলা গান শোনার কথা বলেছেন৷ অনেকেই তাঁর এই হতাশা এবং পরশ্রীকাতরতাকে ধিক্কার জানিয়েছেন। কিন্তু শিল্পীর মধ্যে এই সংশয় এবং দ্বিধা তো সর্বদাই থাকে যে, তাঁর শিল্পকর্ম আদৌ দীর্ঘকাল ধরে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকবে কিনা। এই সংশয়বোধ থেকেই তো কবিগুরু লিখে যাচ্ছেন, "আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি, কৌতূহলভরে।' এই সংশয়বোধ থেকেই কেকে নিজেকে নিংড়ে দিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগেও, তাঁর শেষ অনুষ্ঠানে। 2000 আসন সমন্বিত প্রেক্ষাগৃহে প্রায় 6000 দর্শক-শ্রোতার সামনে, বিকল বাতানুকূল ব্যবস্থার বদ্ধ ঘেরাটোপে, ফায়ার এক্সটিংগুইজারের ধোঁওয়ার সামনে, মঞ্চের ঝকমকে আলোর সামনে একটানা গান গেয়ে গেছেন কেকে। দর্শক-শ্রোতাদের উত্তাল কলরোলের মাঝে গানের বিরতিতে তাকে দেখা গেছে বারবার ঘাম মুছতে আর জল খেতে। শিল্পী মাত্রই জানেন, এই মঞ্চ তাঁকে যেমন খ্যাতি এনে দেবে, তেমনই কোনও ভুলচুক হলে রেয়াত করতে বিন্দুমাত্র সময় নেবে না। তাই জীবনের শেষ গানের 'ছোটি সি, হ্যায় জিন্দেগি'কে সার্থকতা দিয়ে জীবনমঞ্চের যবনিকা টেনে দিলেন কেকে, চিরকালের মতো।
প্রশ্ন উঠুক, আয়োজকদের, প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা নিয়ে। কিন্তু বন্ধ হোক দোষী ঠাওরানোর এই অসুস্থ প্রবণতা, বন্ধ হোক কল্পিত দোষীকে চিহ্নিত করে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার এই আস্ফালন। শিল্পী বলা ভাল মানুষ মাত্রই সংশয়ী। বর্তমান টালমাটাল সময়ে নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থান আগামীদিনেও পোক্ত থাকবে কিনা তাই নিয়ে একটু বেশিই চিন্তিত ওই মঞ্চে দাঁড়ানো মানুষগুলো। তাঁদের কাউকে সামাজিক ভাবে কোণঠাসা করে চরম হতাশার দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করানো কোনও দায়িত্বশীল সমাজের কাজ হতে পারে না।