4thPillar


কালো নারী শ্বেতাঙ্গ পুরুষের বুকের উপর দাঁড়িয়ে

তরুণ গোস্বামী | 09-07-2022May 27, 2023
কালো নারী শ্বেতাঙ্গ পুরুষের বুকের উপর দাঁড়িয়ে

13 ফেব্রুয়ারি 1899 সাল। কলকাতার অ্যালবার্ট হলে একটি বক্তৃতার বিষয় কালী ও কালীপূজা। বক্তা ইংল্যান্ডের একটি স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা, বিখ্যাত সিসমে ক্লাবের সম্পাদিকা মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল, অধুনা সিস্টার নিবেদিতা। এক ম্লেচ্ছ মহিলা কালী নিয়ে বলবে, এর চেয়ে অধর্ম আর কী হতে পারে? এগিয়ে গিয়ও পিছিয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ এন ঘোষ, যাঁর সভাপতিত্ব করার কথা ছিল অনুষ্ঠানে। নিবেদিতার বক্তৃতা শোনার ন্য সেদিন উপস্থিত চিলেন ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, ডাঃ নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রমোহন ঠাকুর, সরলাবালা ঘোষালের মতো গুণী ব্যক্তিরা। স্বামী বিবেকানন্দও পৌঁছেছিলেন নিবেদিতার বক্তৃতা শুনতে। নিবেদিতা এক ঘন্টার কিছু বেশি সময় ধরে বলেন। বক্তৃতার শেষ ডাঃ সরকার বলেন, যখন ভারত থেকে কুসংস্কার তাড়নোর চেষ্টা হচ্ছে তখন ইউরোপিয়রা আবার সেটাই এদেশে চালাতে চাইছে এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। সেদিন নিবেদিতা এতটাই ভাল বলেছিলেন যে শ্রোতাদের অনেকে ডাঃ সরকারের কথার প্রতিবাদ করে ওঠেন। সেই দিন থেকেই নিবেদিতা একজন বক্তা রূপে স্বীকৃতি পান।

এর পর 28 মে 1899 নিবেদিতা কালীঘাটের মন্দিরে কালীর উপর বক্তৃতা করেন। কালীর মঙ্গলকর রূপটি তিনি তুলে ধরেন। মূর্তিপূজা সম্বন্ধে নিবেদিতা বলেন, হিন্দুরা মূর্তিকে পূজা করে না; কোনও প্রতীককে অবসন্বন করে মনকে তন্ময় করার এটি একটি উপায়। এই বক্তৃতাটি খুবই প্রশংসিত হয়। নিবেদিতা পরে ‘কালী দ্য মাদার’ নামে একটি বইও লেখেন।

নদীয়ার সুপণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বপ্নে মা কালীর পূজা অনুষ্ঠানের নির্দেশ পান। ভোর বেলায় রাস্তায় বেরিয়ে তিনি দেখেন এক মহিলা দেওয়ালে ঘুঁটে দিতে ব্যস্ত। বাইরের পুরুষকে দেখে তিনি লজ্জায় জিভ কাটেন; তাঁর ডান হাতটি দেওয়ালের দিকে ঘুঁটে দেওয়ার আগের ভঙ্গিমায় থেমে যায়। আগমবাগীশ এই মূর্তিতে মা কালীর পূজা আরম্ভ করেন নবদ্বীপে। ডান হাতটি তুলে আছেন মা – তাই বরাভয় মূর্তি। তখন কালী মূর্তি তৈরি হত দুপুরে। সন্ধ্যাবেলা পূজা শুরু হত এবং ভোর রাতে সূর্য ওঠার আগেই দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হত। মা কালীর দশটি রূপ – কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছ্ন্নিমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, কমলা মাতঙ্গী। কালীপূজা কখনও গৃহস্থ বাড়িতে হত না। শোনা যায়, ডকাতরা ডাকাতি করতে বের হওয়ার আগে কালীর আরাধনা করত। দক্ষিণ কলকাতার পূর্ণ দাস রোডে এখনও ডাকাতে কালীর মন্দির আছে।


কালো নারী শ্বেতাঙ্গ পুরুষের বুকের উপর দাঁড়িয়ে

কালীকে গৃহস্থদের আপনার জন করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে তিনি পূজা করতেন। কালী তাঁর কাছে কখনও মা, কখনও মেয়ে। কালীর আবির্ভাব সংসারীর কল্যাণের জন্য।

রানি রাসমণির জামাই মথুরামোহন বিশ্বাস শুধু শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন না, তাঁর বন্ধুও বটে। একবার কালীপূজার আগের দিন রাতে মথুরামোহন তাঁর ‘বাবাকে’ নিয়ে মা কালীর জন্য যত রকমের জিনিস কেনা হয়েছে দেথাকে এনেছেন। মায়ের রুপো আর সোনার গহনা দেখে ঠাকুর খুব খুশি।বেশ লাগবে নতুন শাড়িটা পরে। হঠাৎ ঠাকুরের নজর গেল দুটি বোতলের দিকে। মধুরের কাছে জানতে চাইলেন, বোতল দিয়ে কী হবে? মধুর বললেন, ‘বাবা, ওতে মদ আছে। তন্ত্রমতে পুজো, কারণবারি দিতে হয়।” শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, “না, না, কক্ষণো মদ দেবে না। যদি বেশি খেয়ে বেটি পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙে তো তুমি দেখবে? দু বোতল দুধ এনে দাও।” সেই থেকে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে কারণবারির বদলে দুধ দেওয়া হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ ছাগবলিও বন্ধ করেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর মাকে সর্বত্র দেখতেন। একদিন গিরীশ ঘোষকে বললেন, জানো চীৎপুরের রাস্তায় মাকে দেখে এলাম। গিরীশ বললেন, সেকী! তুমি চীৎপুরে মাকে দেখলে? তা সে মা কেমন? উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, জানো তিনি কেমন, দেখলাম মা পরিষ্কার শান্তিপুরী কাপড় পরেছেন, মাথায় খোঁপা, তাতে আবার জুঁই ফুলের মালা। মুখে রঙ মেখে, হাতে থেলো হুঁকো নিয়ে মা বহু পুরুষের মনোরঞ্জন করছেন। একদিন শ্রীরামকৃষ্ণের পূজায় মন বসছে না। দেখেন দক্ষিণেশ্বরের একটি বারবণিতা এসে মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই তার পায়ে ফুল দিয়ে সেদিনের পূজা সারলেন ঠাকুর। পরে সারদামণি যখন পাকাপাকিভাবে দক্ষিণেশ্বরে চলে আসেন তখন সেই গণিকার সঙ্গে সারদামণির পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর দক্ষিণেশ্বরের শাশুড়ি বলে।

রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত চক্রবর্তী অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন যা অন্য মাত্রা পেয়েছিল পান্নালাল ভট্টাচার্যর গলায়। কলকাতায় তখন জলসা হত। হেমন্ত মুখোপধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, নির্মলেন্দু চৌধুরী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ইলা বসুদের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। “সকলি তোমারই ইচ্ছা, ইচ্ছময়ী তারা তুমি”, “আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন”, “আমার চেতনা চৈতন্য করে দে না চৈতন্যময়ী” – গানগুলো গত শতকের পাঁচের ও ছয়ের দশকে জলসায় নতুন মাত্রা যোগ করত।

কাজী নজরুলের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী। নজরুল বহু শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেন। “শ্মশানে জাগিছে শ্যামা”, “মা গো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়”, “ও মা কালী সেজে ফিরলি ঘরে” জ্ঞান গোসাঁইয়ের কণ্ঠের জাদুতে অনন্যতা পেয়েছে।

স্বামী বিবেকানন্দ মা কালীকে দেখেছেন অনন্ত রূপে। অনন্ত তিনি, তাই তাঁর গায়ের রঙ কালো, তাই তাঁর কোনও আবরণের প্রয়োজন নেই। মৃত্যুরূপা কালী কবিতায় তিনি লিখছেন:

“পূজা তার সংগ্রাম অপার,

সদা পরাজয় তাহা না ডরায় তোমা,

চূর্ণ হোক জাত-কূল-মান,

হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা।”

1901 সালে ঢাকা থেকে স্বামীজি ফিরেছেন,।খুব ক্লান্ত। ডায়াবেটিসের তখন কোনও চিকিৎসা ছিল না, শরীর তাঁর একেবারে ভেঙে গেছে। ডাক্তারবাবুর বিশ্রাম নিতে বলছেন। শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁকে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে বলায় তিনি বললেন, “বাবা! তিনি যাকে কালী বলতেন এই শরীরে ঢুকে গেছে। আমাকে থিতু হয়ে বসতে দেয় না. শুধু কাজ করিয়ে নিয়ে বেড়ায়।” কালী স্বামীজির কাছে নিষ্কাম কর্ম, নিঃস্বার্থ ভালবাসার প্রতীক।


কালো নারী শ্বেতাঙ্গ পুরুষের বুকের উপর দাঁড়িয়ে

কালীর প্রেমে পড়েছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী স্যর জন উডরফ (1865 - 1936)। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কৃতী ছাত্র সংস্কৃত শিখেছিলেন কলকাতায়, ভারতীয় দর্শন ও তন্ত্র সাধনার উপর বহু বই লেখেন তিনি। তাঁর টীকা সহ ‘মহানির্বাণতন্ত্র’ গ্রন্থটি তাঁকে পণ্ডিত মহলে পরিচিত করে। স্যর জন কালীভক্ত ছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন যে কালী তাঁর বরাভয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের মৃত্যু ভয়কে জয় করার আশীর্বাদ করছেন।

ইংরেজ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক রিচার্ড শিপম্যান তাঁর বিখ্যাত বই ‘শ্রীরামকৃষ্ণ প্রফেট অব দ্য নিউ এজ’ গ্রন্থে অন্যভাবে কালীকে দেখেছেন। তিনি কলকাতার বাংলা ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখেন সেখানে সবচেয়ে জনপ্রিয় মা কালী। বাংলা নববর্ষে আগে খুব ধুমধাম করে হালখাতা পালন করা হত। দোকানের মালিক হাসি মুখে ক্রেতাদের আপ্যায়ন করতেন। বিদায়কালে তাঁদের হাতে তুলে দিতেন এক বাক্স মিষ্টি আর একটি বাংলা ক্যালেন্ডার। সেখানে কোনও ছবিতে শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদার পিছনে মা কালী, কোথাও বা দক্ষিণেশ্বর বা কালীঘাটের মন্দিরের মা কালী, আবার কখনও নৌকাতে শ্রীরামকৃষ্ণ মাঝি মা কালী, কোনও ক্যালেন্ডারের ছবিতে বা রামপ্রসাদের সঙ্গে মা বেড়া বেঁধে দিচ্ছেন। বহু মানুষ বছর শেষ হয়ে গেলে ক্যালেন্ডারের থেকে কেটে ছবি বাঁধিয়ে রাখত। সর্বত্রই মায়ের জয়গান। মা কন্যাও বটে, জননীও বটে।

কালীকে কতভাবে মানুষ দেখে! একবার আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আফ্রিকান-আমেরিকান অধ্যাপিকাকে নিয়ে কালী পূজার রাতে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে বেরিয়েছি। আনন্দে উদ্ভাসিত অধ্যাপিকার মুখখানি। সারা পৃথিবী ঘুরেছেন তিনি, কোথাও দেখেননি একজন কালো উলঙ্গ মহিলা একজন সাদা পুরুষের বুকের উপর দাঁড়িয়ে আছে! কালী কলকাত্তাওয়ালী! নানা রূপে, নানা ভাবে মা পূজা পাচ্ছেন বহু মানুষের। আদ্যাস্তোত্রে আছে “কালিকা বঙ্গদেশে চ” – কালীক্ষেত্র এই বাংলা।

মা এবার উঠে এলেন পাঁচতারা হোটেলের আলোচনা সভায়। তিনি আলোচনার মুখ্য চরিত্র। তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র মায়ের খাদ্য ও পানীয়ের নানা অভ্যাস নিয়ে মন্তব্য করেছেন। এগুলি কালী সাধনার গুহ্য কথা, সকলের সঙ্গে আলোচনার বা সবার সামনে বলার নয়। যেহেতু তিনি কালী মাহাত্ম্য নিয়ে কোনও সেমিনারে ভাষণ দিচ্ছেন না, সেহেতু ওই আলোচনায় তাঁর আরও বাক্ সংযম দেখানো উচিত ছিল। সাধারণ মানুষ কালীর পূজা পদ্ধতি বা ভোগের উপকরণ নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাঁদের বিশ্বাস মা তাঁদের মঙ্গল করবেন, তাই তাঁরা নিয়ম করে আদ্যাস্তব পাঠ করেন।

আর সাধক? তিনি বলেন, মা কালী অনন্ত, মন ও বাক্যের অতীত। মা কালী কেমন? “ষড় দর্শনে না পায় দরশন”!

আরও পড়ুন



New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -তরুণ গোস্বামী | 09-07-2022

// Event for pushed the video