এক মাসও হয়নি দিল্লির বিজেপি সরকারের দেওয়া পদ্ম সম্মান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তা যদি না হত, তা হলেও কি এতখানি আড়ম্বর এবং সরকারি তৎপরতা দেখা যেত তাঁর দীর্ঘ, সুন্দর, সার্থক জীবনের অন্তিম অধ্যায়ে?
আমার সন্দেহ আছে।
সন্দেহ এই জন্য যে, প্রয়াত শিল্পীর মরদেহ রবীন্দ্র সদনে কতক্ষণ থাকবে এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর উত্তরবঙ্গ সফর কাটছাঁট করছেন কিনা, তার উপরই তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পর আমাদের মিডিয়ার যাবতীয় নজর নিবদ্ধ। তাঁর মৃত্যুর পর কয়েক ঘন্টার মধ্যে মূল স্রোতের বাংলা টেলিভিশনে লক্ষ লক্ষ শব্দ উচ্চারিত হল। কিন্ত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র বা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম একবারও শোনা গেল না।
অর্থাৎ, আমরা কী হারালাম, তা আমরা বুঝলামই না!
নিজের কর্ম এবং শিল্পসাধনার ক্ষেত্রে জিনিয়াস হওয়া সত্ত্বেও সন্ধ্যাদেবী সারা জীবন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি সেলিব্রিটি ছিলেন না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস সরকরের আমলে ঘরে বয়ে গিয়ে যে সম্মান দেওয়া হয়েছে, তা তিনি ওই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বাভাবিক সৌজন্যবশত গ্রহণ করেছেন। বয়সে তাঁর প্রায় নাতির সমান সুরকার সঙ্গীতকারও তাঁর প্রয়াণে কিছু কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা বলতে পারেন, বলছেনও। তিনি অনেকের দিদি, কারও মাসি, কারও বা গুরু-বোন, কারও বা সন্ধ্যা-মা। বাংলা সঙ্গীত জগতে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত বা বিচারান্তরে করে খাচ্ছেন, তাঁদের সকলেরই দেখা গেল তিনি প্রণম্য।
প্রশ্ন জাগে, এই প্রণাম তাঁর 90 বছরের জীবনে প্রতি বছর পেয়েছেন কি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়?
প্রশ্ন জাগে, গত মাসে পদ্ম সম্মান প্রত্যাখ্যান করার আগে আমরা কতজন জানতাম সন্ধ্যাদেবী কোথায় থাকেন? কীভাবে তাঁর দিন চলে? তাঁর একমাত্র সন্তান কলকাতার একটি অতি অভিজাত স্কুলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী শিক্ষিকাকে যে মিডিয়ার সামনে হামলে পড়ে বাইট দিতে দেখা যায়নি, সেটাই সঙ্গীতকে অতিক্রম করে বাঙালি ভদ্রলোকের পরম্পরায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকার।
বাকিটা সঙ্গীত। বাঙালির নান্দনিক, বৌদ্ধিক সম্পদ ও উত্তরাধিকার।
শ্যামল মিত্র মারা গেছেন 58 বছর বয়সে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় 69-এ, যদিও স্বাস্থ্যজনিত কারণে তাঁর সক্রিয় সঙ্গীত জীবন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। মান্না দে 94 বছর অবধি বেঁচেছিলেন বটে, তাঁর শেষের দীর্ঘ অংশ ব্যাঙ্গালোরে কন্যার কাছে, বাংলা গান এবং তার চর্চা, এবং তাঁর প্রাপ্য সমাদর থেকে বহু দূরে। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় 70 বছর অবধি বাঁচলেও স্বামীর মৃত্যুর পর, মধ্য পঞ্চাশেই প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান।
সর্বোপরি, এই চার মহাতারকারই সৃষ্টিজীবন সোশাল মিডিয়ার জন্মের আগেই শেষ।
বাঙালির আধুনিক গানের পঞ্চম মহানক্ষত্রের পতন হল 15 ফেব্রুয়ারি 2022, মঙ্গলবার। মোবাইল ফোনেই খবরটা সবাই জেনেছে।
সামনের বছর দিনটি মনে থাকবে তো আমাদের?