রাজ্যে ভোটের দামামা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি রাজনৈতিক দলগুলিই নিজেদের মতো করে হিসাবনিকাশ শুরু করে দিয়েছিল। গত কয়েক বছরে এই রাজ্যেও যেভাবে পরিচয়ভিত্তিক, গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছে, তাতে যুযুধান সব শিবিরই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভোটকে নিজেদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করছে। এর পাশাপাশি লিঙ্গপরিচয়ভিত্তিক ভোট প্রচারের এক নয়া ধরনও এবার দেখা যাচ্ছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিটি জনসভায় ‘মা-বোনেদের জন্য’ অনেকটা সময় ব্যয় করছেন। বিজেপিকে আটকাতে তাঁদের কী কী করণীয়, তাও অনেক সময় বাতলে দিচ্ছেন৷ অন্যদিকে বিজেপিও শাসক তৃণমূলকে বিঁধে এই রাজ্যের নারী নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। বিজেপি ক্ষমতায় এলে নারীরা সুরক্ষা পাবে— এমন প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হচ্ছে বিজেপির তরফে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েদের ভোটকে পাখির চোখ করেছে রাজনৈতিক দলগুলি।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ রাজ্যে ভোট-প্রচারে এসে নিয়ম করে বলছেন, এই রাজ্যে নারীদের কোনও নিরাপত্তা নেই। নারীদের সুরক্ষা দিতে, পুরুষের ‘প্রলুব্ধ’ দৃষ্টি থেকে তাদের বাঁচাতে অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড গঠন করা হবে বলেও তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পালটা শাসক তৃণমূলের তরফে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, হাথরস সহ যোগী-রাজ্যে ঘটে যাওয়া একের পর এক নারী ধর্ষণের কথা। ধর্ষকদের সপক্ষে বিজেপির নেতামন্ত্রীদের উক্তিগুলোও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রায় হাফ ডজন মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে রাজ্যে ভোট-প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তাতে এমনিতেই এই নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের মতো গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই উন্নয়ন, পরিকাঠামোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, বিশেষত নারী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির প্রতিতুলনা টানছেন কেউ কেউ।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলছে, 2018 থেকে 2019 সালের মধ্যে, মাত্র এক বছরে মহিলাদের ওপর অপরাধের হার বেড়েছে 7.3 শতাংশ। তফশিলি জাতি এবং উপজাতি মানুষদের ওপর অপরাধ বৃদ্ধির হারও 7.3 শতাংশ। মোট নথিভুক্ত অভিযোগের ক্ষেত্রে এগিয়ে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ। এই রাজ্যে 2018 থেকে 2019, এই এক বছরে মোট নথিভুক্ত অভিযোগের সংখ্যা 59,853টি। মহিলাদের ওপর অপরাধের হারে এগিয়ে আর এক বিজেপি শাসিত রাজ্য অসম। সেই রাজ্যে মোট নথিভুক্ত অভিযোগের সংখ্যা 30,025টি হলেও, অপরাধের হার (ক্রাইম রেট) প্রতি এক লক্ষে 177.8৷ 2019 সালে পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যাটা যথাক্রমে 30,394 এবং এক লক্ষে অপরাধের হার 64। নারী ধর্ষণ নথিভুক্ত অভিযোগের নিরিখে প্রথম কংগ্রেস শাসিত রাজস্থান (5,997), দ্বিতীয় উত্তরপ্রদেশ (3,065),তৃতীয় মধ্যপ্রদেশ (2,485)। এক্ষেত্রে প্রথম দশে নেই পশ্চিমবঙ্গের নাম।
শিশুকন্যাদের ওপর অত্যাচারের জন্য পসকো আইনে উত্তরপ্রদেশে 2019 সালে 7,444টি মামলা রুজু হয়েছে, যা সারা দেশে সর্বোচ্চ। জোরপূর্বক বিবাহ-পণ বা যৌতুক নেওয়ার ঘটনাতেও উত্তরপ্রদেশ ‘এগিয়ে’! এক বছরে এমন ঘটনার সংখ্যা 2,410টি। ঠিক পিছনেই বিহার (1,120)। মহিলাদের ওপর অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনা উত্তরপ্রদেশে সর্বোচ্চ— 2019-এ সারা দেশে এমন 150টি ঘটনার 42টি ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে। 36টি পশ্চিমবঙ্গে। সারা দেশে তফশিলি জাতি, উপজাতিদের ওপর অত্যাচারের ঘটনার 25.8 শতাংশই ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে, যদিও সে রাজ্যের জনসংখ্যা সারা দেশের 16.8 শতাংশ মতো। এই নিরিখে সারা দেশে দ্বিতীয় স্থানে রাজস্থান।
বিজেপি শাসনে ‘মডেল’ স্টেটের তকমা পাওয়া গুজরাতের অবস্থাও তথৈবচ। স্টেট ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলছে 2014 সাল থেকে গুজরাতে প্রতিদিন অন্তত একটি করে ধর্ষণের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, গুজরাতের 63 শতাংশ স্কুলপড়ুয়া মেয়ে যৌন হেনস্থার কথা জানিয়েছেন। 36 শতাংশ স্কুল পড়ুয়া ছেলেও একই অভিযোগ করেছেন। এক্ষেত্রে একটা বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। গো-বলয়ের রাজ্যগুলোতে তো বটেই, বহু মেট্রো শহরেও অভিযোগকারীদের অভিযোগগুলো নথিভুক্ত করা দূরে থাক, গ্রহণই করা হয় না। উত্তরপ্রদেশেই যেমন বহু নির্যাতিতা জানিয়েছেন, তাদের থানায় অভিযোগ জানাতে ভয় করে, কেননা পুলিশও ‘প্রভাবশালী’ ধর্ষকদের পাশে থাকে। নারী অধিকার আন্দোলনের বহু কর্মীরও মত, থানায় ডেকে এনে নির্যাতিতাদের অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়। এখনও বহু জায়গায় মান্ধাতার আমলের অবমাননাকর টু-ফিঙ্গার টেস্টের মাধ্যমে ধর্ষিতার অভিযোগের সারবত্তা খোঁজা হয়।
বোঝাই যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলি নারীদের নিয়ে আদৌ ততটা ভাবিত নয়, যতটা তারা নির্বাচনী প্রচারসভা থেকে দাবি করে। তবে এক্ষেত্রে বিজেপির বিড়ম্বনাটা আরও অনেক বেশি। কেননা কেন্দ্র এবং প্রায় এক ডজন রাজ্যের শাসকদল হিসাবে জনগণের কাছে তারা ইতিমধ্যেই পরীক্ষিত। তাদের শাসনাধীন রাজ্যগুলোতে নারী সুরক্ষায় তারা এমন কোনও পদক্ষেপ নেয়নি, যা ভাঙিয়ে বা দেখিয়ে তারা এই রাজ্যে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে পারে। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গার যেভাবে ধর্ষণ-কাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েও প্রভাব খাটিয়ে যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করেছেন, নির্যাতিতার পরিবার ‘অলৌকিক’ ভাবে খুন হয়েছে, তাতে যোগী প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হাথরসের স্মৃতি তো এখনও আমাদের কাছে দগদগে ঘায়ের মতোই। বাল্মীকি সম্প্রদায়ের মণীষা বাল্মীকিকে পৈশাচিকভাবে ধর্ষণ ও খুন করার পরেও, উচ্চবর্ণের চারজন অভিযুক্তকে যেভাবে সরকারি প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর আড়ালে ধর্ষিতার দেহ পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে পুড়িয়ে দিয়েছে, তাতে মুখ পুড়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকারেরই। সেই সরকারের কর্ণধারের মুখে নারী সুরক্ষার কথা শুনলেই, এই অস্বস্তিকর তথ্য ও পরিসংখ্যানগুলো উঠে আসছে— স্বভাবতই যা বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের কাছে খুব বেশি সুখকর নয়। পশ্চিমবঙ্গ নারী সুরক্ষায় স্বর্গোদ্যান না হলেও, উত্তরপ্রদেশ বা গুজরাত মডেল যে এক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে না, পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট।