ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লির দাঙ্গায় সংখ্যালঘুদের উপর পরিকল্পিত আক্রমণে পুলিশ কার্যত আক্রমণকারী দুষ্কৃতীদের সঙ্গীর ভূমিকা পালন করেছিল। পরবর্তী কালে ঘটনার তদন্তের সময়েও পুলিশ তার সাংবিধানিক আইনরক্ষকের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। দিল্লি সংখ্যালঘু কমিশনের সদ্য প্রকাশিত তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট থেকেই এই ছবিটা পরিষ্কার।
দিল্লি সংখ্যালঘু কমিশন 9 মার্চ ফেব্রুয়ারি মাসের দাঙ্গার সুলুকসন্ধানের জন্য একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি তৈরি করে। সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী এম.আর. শামসাদের নেতৃত্বে এই কমিটি গত 13 জুলাই এই রিপোর্ট দিল্লি মন্ত্রিসভা, স্পিকার এবং লেফট্যান্যান্ট গভর্নর অনিল বৈজলকে জমা দেয়। দিল্লি সংখ্যালঘু কমিশন বিধানসভায় আইন দ্বারা স্থাপিত বিধিবদ্ধ সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে সহায়তার বদলে কমিশনের কাজে নানা অছিলায় অসহযোগিতা করা হয়।
রিপোর্ট অনুযায়ী গত 23 ফেব্রুয়ারি, বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ উত্তর-পূর্ব দিল্লির মৌজপুর এলাকায়, জনৈক বিজেপি নেতার প্ররোচনামূলক বক্তব্যের পরেই পুরো এলাকা জুড়ে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর হামলা ছড়িয়ে পড়ে। এই জায়গা থেকে মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনের কাছে মহিলারা নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ধরনায় বসেছিল। জনৈক নেতা চরম হুঁশিয়ারি দেন যে, তিন দিনের মধ্যে যদি পুলিশ জাফরাবাদ এবং চাঁদবাগ থেকে বিক্ষোভকারীদের সরানোর কোনও ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে তারা বাধ্য হবে রাস্তায় নামতে। যখন তিনি এই হুমকি দেন, তখন তাঁর পাশে ছিলেন স্বয়ং উত্তর-পূর্ব দিল্লির ডেপুটি কমিশনার অব পুলিশ। সমবেত জনতা প্রবল উৎসাহে নেতাকে সমর্থন জানায়, কিছুক্ষণের মধ্যেই উন্মত্ত মানুষ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং খুন, লুঠ, অগ্নিসংযোগ শুরু হয়ে যায়। শিব বিহার, খাজুরি খাস, চাঁদবাগ, গোকুলপুরি, মৌজপুর, জাফরাবাদ, মুস্তাফাবাদ, অশোক নগর, ভাগীরথী বিহার, ভজনপুরি ইত্যাদি এলাকায় এই তান্ডব 23-26 ফেব্রুয়ারি অবধি চলতে থাকে। কিছু এলাকায় 27 তারিখেও হিংসাত্মক কার্যকলাপ জারি ছিল। কমিটির মতে শুরুতে সংখ্যালঘু মানুষ নিজেদের পরিবার, সম্পত্তি রক্ষার্থে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু আক্রমণকারী জনতা ক্রমশ বিপুল আকার ধারণ করায় তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান: বেছে বেছে সম্পত্তি হানি করা হয়েছে
শিববিহারের এক ভুক্তভোগী জানাচ্ছেন, 24 তারিখ সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত দাঙ্গাবাজরা দফায় দফায় কিছু বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তাঁর ঠাকুমার চারটি দোকান হিন্দু, মুসলিম উভয়কেই ভাড়া দেওয়া। একটি হিন্দু পরিবারকে ভাড়া দেওয়া মিষ্টির দোকানের কোনও ক্ষতি হয়নি। তার পাশেই একজন মুসলিমের ফোন সারাইয়ের দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হিন্দুর চায়ের দোকান অক্ষত, অথচ মুসলিমের মোটরসাইকেল সারানোর দোকান অগ্নিদগ্ধ। হিন্দু দোকান মুসলিমকে ভাড়া দেওয়া হয়ে থাকলে, দোকানের কোনও ক্ষতি করা হয়নি, কিন্তু সমস্ত জিনিস বাইরে ফেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশকে বহু বার ফোন করা সত্ত্বেও পাওয়া যায়নি। কিছু পুলিশ জিপসি ভ্যানে টহল দিচ্ছিল, তাদের কাছে অভিযোগ জানালে তাঁরা বলে ওপরওয়ালাদের কোনও হুকুম নেই। উল্টে তারা জনতার ‘জয় শ্রী রাম’ শ্লোগানের সাথে অভিযোগকারীদের গলা মেলাতে বলে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান: বোনের সামনে পিটিয়ে ভাইকে খুন
ভগীরথী বিহারের এক মুসলিম তরুণী জানাচ্ছেন যে, তাঁরা একটি চারতলা বাড়ির একদম উপরের ফ্লোরে থাকেন। 24 তারিখ থেকে কিছু জনতা এলাকায় সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিতে থাকে। নিচের বাসিন্দারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। জনতা সিঁড়িতে আগুন দিয়ে দেয়। তাঁরা বাড়ির মালিককে ফোন করে। 25 তারিখে জনতা পিছনের দরজা ভেঙে ঢোকে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, সিসিটিভি ভেঙে ফেলে, ঘরে ঢুকেই মহিলাকে থাপ্পড় মারে এবং পুরুষরা কোথায় জানতে চায়। মহিলা মিথ্যা বলেন, যে তাঁরা বাড়িতে নেই, যদিও আসলে কিন্তু দু’জন খাটের বাক্সে লুকিয়ে ছিল। ক্ষিপ্ত জনতা লোহার রড দিয়ে ভাঙচুর শুরু করে। নিরুপায় হয়ে এই দু’জন বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে। দুজনকে বেধড়ক মারধর করে এবং মহিলার ভাই মুশারাফকে ধরে নিয়ে যায়। মহিলা বহু বার পুলিশের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। 28 তারিখে তাঁর ভাইয়ের মৃতদেহ একটি নালায় পাওয়া যায়। মহিলা এফআইআর দায়ের করেন এবং 24 তারিখে যারা শ্লোগান দিচ্ছিল, তাদের কয়েকজনের নাম জানান। কিন্তু 25 তারিখ সবার মুখ ঢাকা থাকায় তাদের তিনি চিহ্নিত করতে পারেননি। পুলিশ মহিলাকে বয়ান দেওয়ার জন্য থানায় ডেকে পাঠায়, কিন্তু নিরাপত্তার অভাব অনুভব করায় তিনি যেতে অস্বীকার করেন। তাঁর পরিবার আতঙ্কে অন্যত্র আশ্রয়ে চলে গেছে। তাঁর অভিযোগ কোন পর্যায়ে আছে সেটার কোন হদিশ নেই।
প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান: মহিলা ও শিশুদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার
এক মহিলা জানান যে, এই বিপর্যয় তাঁর সন্তানদের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তারা এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে, মহিলা প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বাইরে বেরোতে পারেননি। আর এক মহিলা তাঁর সন্তানদের নিয়ে ছাদে চলে যান, যেখানে প্রায় একশো মানুষের ভিড় এবং প্রায় প্রত্যেকেই কাঁদছে; কারণ আশেপাশে প্রত্যেকের বাড়ি জ্বলছে। যেভাবে নিজের দেশে তাঁদের ‘পাকিস্তানি’, ‘বহিরাগত’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, শাহিনবাগ কে ‘শয়তানি বাগ’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে, বাচ্চাদের সামনে তাদের সাধের খেলনা যেভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তাতে অনেকেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যাঁদের স্বামী মারা গেছে তাঁরা জানেন না, আবার কীভাবে জীবন শুরু করবেন। অনেকেরই সমস্ত সম্পত্তি লুঠ হয়ে গেছে। ধরনাস্থলে হামলাকারীরা মহিলাদের ওপর আক্রমণ করেছে। পুলিশ হয় দাঁড়িয়ে দেখেছে, নয় তারাও হামলায় সামিল হয়েছে। মহিলারা পুরুষদের বাঁচাতে তাঁদের ঘিরে দাঁড়ায়।এইচেন ভাঙতে নানা দাহ্য পদার্থ, গ্যাস ক্যানিস্টার, টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া হয়। প্রবল বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যায়। চাঁদবাগে ধর্ণাস্থলে এক মহিলার মাথায় 35টি সেলাই পড়ে। এক অন্ত:সত্ত্বা মহিলার সামনে একটা শেল এসে পড়ে, এক বৃদ্ধ মহিলাকে মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করার ফলে তিনি বেঁহুশ হয়ে যান। অনেকের পোশাক ছিঁড়ে দেওয়া হয়, বোরখা, হিজাব কেড়ে নেওয়া হয়। সারাক্ষণ মহিলাদের অকথ্য গালাগালি করা হয় এবং তাঁরা কুৎসিত, যৌন ইঙ্গিতকারী অঙ্গভঙ্গির শিকার হন। কমিটির কাছে অনেক মহিলা অ্যাসিড আক্রমণেরও অভিযোগ করেছেন।
দাঙ্গার সময়ে এবং পরে পুলিশের ভূমিকা দাঙ্গাকারীর সহযোগীর
একটি গলিতে উচ্চতম বাড়িটিতে এক মুসলিম দম্পতি ছিল।তাঁরা দরজা বন্ধ করে ভেতরে ছিল। প্রথমে ইট-পাটকেল, পরে পেট্রোল বোমা ছোঁড়া হয়। তাঁরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং তা অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের কন্যার বিবাহের জন্য কেনা যাবতীয় সামগ্রী পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পুলিশকে ফোন করলে তারা অসহায়তা প্রকাশ করে কিংবা ‘লো তেরা আজাদি’ ইত্যাদি বলে টিটকারি করে। তাঁরা এফআইআর করেন, কিন্তু কোনও নাম উল্লেখ থাকলে পুলিশ তা নিতে টালবাহানা করে। বিএসএফ-এ চাকরিরত এক পড়শির সাহায্যে তাঁরা অন্যত্র পালিয়ে যান।
একজন ব্যবসায়ী বলেন, তাঁর তিনতলা বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তিনি সাড়ে এগারোটায় পুলিশ ডাকেন, তাঁরা আসেন বিকাল সাড়ে তিনটেয়। পুলিশ তাঁকে পাঁচ মিনিট সময় দেয় এলাকা ছেড়ে পালাতে। হামলাকারীরা তখন সেখানে উপস্থিত, কিন্তু পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয় না। তাঁকে বাড়ির জন্য পাঁচ লাখ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁর ব্যবসা, তাঁর রুটিরুজির জন্য কিছু দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন: একটি দাঙ্গা, চারটি রিপোর্ট, অজস্র প্রশ্ন
28 ফেব্রুয়ারি দিল্লি সংখ্যালঘু কমিশন জানতে পারে প্রাক্তন কংগ্রেস কাউন্সিলার ইশরাত জাহান এবং খালিদ সাইফিকে দু’দিন আগে ধরনা মঞ্চ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযোগ, তাঁদের থানায় মারধর করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজিরার সময়ে তাঁদের শরীরে নাকি মারধরের চিহ্ন পাওয়া গেছে। 6 মার্চ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এই অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার জন্য একটি কেস দায়ের করে।
পুলিশের কাছে জবাব চেয়ে উত্তর মেলেনি
কমিটি নানাভাবে পুলিশের কাছ থেকে নির্দিষ্ট তথ্য জানতে চেয়েও বিফল হয়। অবশেষে 11 জুন সংশ্লিষ্ট ডিসিপি এবং পুলিশ কমিশনারকে ইমেল করে জানতে চাওয়া হয়:
(1) ওই তারিখ অবধি যত চার্জশিট দায়ের করা হয়েছে।
(2) 23-27 ফেব্রুয়ারি পুলিশ বাহিনীর কাকে কোন এলাকায় নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল?
(3) দাঙ্গা আটকাতে প্রতিরোধমূলক কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
(4) ওই তারিখ অবধি গ্রেফতার এবং বন্দির সংখ্যা কত?
(5) জানা বা অজানা অভিযুক্ত, উভয় ক্ষেত্রেই অনুসন্ধান কী পর্যায়ে আছে?
(6) পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে যা অভিযোগ জমা পড়েছে।
(7) পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে যা এফআইআর হয়েছে।
(8) কোন পুলিশ আধিকারিকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হয়ে থাকলে তাঁদের নাম এবং পদমর্যাদা।
নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় পুলিশ প্রশাসন অন্ধ ও ব্যর্থ
কমিটির রিপোর্ট থেকে উঠে আসে দেশের রাজধানীতে নাগরিক অধিকার রক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা। ঘটনার পরেও পুলিশ ধারাবাহিকভাবে আক্রমণকারী দাঙ্গাবাজদেরই পক্ষ নিয়েছে, সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনও চেষ্টাই হয়নি।
উপরোক্ত ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে কমিটির আপাত ভাবে মনে হয়েছে যে, নাগরিকত্ব-বিরোধী আন্দোলনকারীদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য পরিকল্পিত ভাবে এই দাঙ্গা করা হয়েছে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের নিশানা করা হয়েছে।
সংখ্যালঘু কমিশনের তথ্যানুসন্ধান কমিটির সুপারিশ
দাঙ্গার আবহেও সম্প্রীতির কিছু ঝলক
বিজয়াপার্ক এবং যমুনা বিহার অঞ্চলের বাসিন্দারা সমবেতভাবে বহিরাগত কাউকে এলাকায় ঢুকতে দেননি। জনৈক রাকেশ জৈন ‘দৈনিক ভাস্কর’ পত্রিকাকে জানান যে, দাঙ্গাবাজরা নানা ফন্দিফিকির করে ঢোকার চেষ্টা করে, কিন্তু মানুষ তাদের রুখে দেয়। মসজিদ এবং মন্দির দুটোই এখানে অক্ষত আছে। মুস্তাফাবাদে মুসলিমরা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। তাঁরা হিন্দুদের রক্ষা করেন এবং মন্দিরও অক্ষত রাখেন। ইন্দিরা বিহার অঞ্চলেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। শিব বিহারে মুসলিমরা হিন্দুদের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছে। এক মুসলিম দম্পতিকে হিন্দু সাজে সজ্জিত করা হয়, যাতে তাঁদের কেউ চিনতে না পারে। একইভাবে এক মুসলিম পরিবার হিন্দুদের আশ্রয় দেয়। এইরকম আরও অনেক উদাহরণ আছে। একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জিটিবি হাসপাতালে দাঙ্গায় আহত মানুষদের পরিচর্যায় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে তিনি যে ধরণের সৌহার্দ্য এবং ঐক্য কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন, তা ভবিষ্যতের জন্য খুবই আশাপ্রদ।