ত 24 নভেম্বর, 2020 তারিখে উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকারের মন্ত্রিসভা সে রাজ্যে বেআইনি ধর্মান্তরণ প্রতিরোধী অর্ডিন্যান্স পাশ করায়। রাজ্যপাল সেই অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেন সেই মাসেরই 28 তারিখে।
একমাসের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ এই আইন ভাঙার অপরাধে 14টি অভিযোগে 51 জনকে গ্রেফতার করেছে, যার মধ্যে 49 জন জেলে রয়েছে।1
ধর্মান্তরণ বিরোধী আইন তো এখন অনেক রাজ্যে, বিশেষ করে যেখানে বিজেপি’র সরকার, রয়েছে। তাহলে আবার ধর্ম পরিবর্তন আটকাতে আর একটি আইন কেন দরকার?
আসলে এটার উদ্দেশ্য কথিত ‘লাভ জিহাদ’ বা প্রেমের ফাঁদ পেতে সাদাসিধে হিন্দু মেয়েদের মুসলমান করার এবং তারপর তাকে একগাদা সন্তানের জননী করে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি করার ‘চক্রান্ত’ ঠেকানো!
অপরাধ প্রমাণের দায় পুলিশের নয়, নির্দোষ প্রমাণের দায় অভিযুক্তের
আইনটির মোদ্দা কথা হল— জোর করে বা লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তরণ করা চলবে না। এটি ‘কগ্নিজিবল’ এবং জামিন-অযোগ্য অপরাধ। অর্থাৎ, এই অভিযোগে যদি পুলিশ গ্রেফতার করে, তাহলে মুচলেকা দিয়ে থানা থেকে জামিন হবে না। শুধু আদালত উচিত মনে করলে জামিন দিতে পারে। আর অপরাধ প্রমাণিত হলে দোষী ব্যক্তি বা সাহায্যকারীর 10 বছর অবধি জেল হবে। অভিযুক্ত সংস্থার রেজিস্ট্রেশন খারিজ হবে ইত্যাদি।
কাজেই, ক) বিয়ের ঠিক আগে বা পরে ধর্ম পরিবর্তন চলবে না। বুঝতে হবে এখানে বিয়ে করার লোভ দেখানো হয়েছে।
খ) ধর্ম পরিবর্তনের জন্যে বিয়ে ছাড়া অন্য কোনও প্রলোভন দেওয়াও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রলোভন অনেক রকমের হতে পারে। যেমন- টাকাপয়সা, উপহার, চাকরি দেওয়া, নামজাদা স্কুল বা কলেজে ভর্তি, ভাল জীবনযাপন, এমনকি ‘ভগবান রাগ করতে পারেন’ ইত্যাদি।
গ) কেউ ধর্ম বদলাতে চাইলে তাকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দু’মাস আগে আবেদন করতে হবে। তিনি খুঁটিয়ে দেখবেন— এখানে কোনও প্রলোভন বা জোরাজুরি কাজ করছে কিনা। তারপর উনি নিঃসন্দেহ হলে তবেই অনুমতি দেবেন।
বাস্তবে ওই আবেদন ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টের নোটিশ-বোর্ডে টাঙানো থাকে দু’মাস ধরে এবং ওই দু’মাসের মধ্যে হিন্দু যুব বাহিনী বা বিভিন্ন সেলফ স্টাইল্ড সংগঠন খবরটি পেয়ে আবেদনকারী এবং নতুন ধর্মের সংস্থাকে চাপ দিয়ে মতপরিবর্তন করতে বাধ্য করায়।
কিন্তু মানুষ তো নামকরা মিশনারি স্কুল-কলেজে ভর্তি হতেই পারে, সামাজিক সম্পর্ক বা বন্ধুত্বের কারণে ‘উপহার’ নিতে পারে। অন্য ধর্মের স্কুল কলেজ বা এনজিও-তে চাকরি করতে পারে। এসব করেও ধর্ম পরিবর্তন নাও করতে পারে। আবার নিজের ভেতরের তাগিদে ধর্ম পরিবর্তন করতে পারে। কী করে বোঝা যাবে যে ধর্মান্তরণ ওই সব প্রলোভন বা জোরাজুরিতে হয়েছে?
এই অর্ডিন্যান্স কাজটা খুব সহ্জ করে দিয়েছে। ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড বা অপরাধের শাস্তি দেওয়ার বিচার পদ্ধতির মূল নীতি হল, অভিযুক্ত যে অপরাধটি করেছে সেটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করার দায়িত্ব হল অভিযোগকারীর, এখানে পুলিশ বা সরকারপক্ষের।
কিন্তু এই অর্ডিন্যান্স ব্যাপারটা উল্টে পুরো হেঁটমুন্ড উর্ধ্যপদ করে দিয়েছে। এই আইনে প্রমাণ করার দায় অভিযোগকারীর নয়, বরং অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে যে, সে জোর করে বা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তরণ করায়নি।
মজাটা দেখুন। পুলিশের কোনও দায় নেই ধর্মান্তরণের অপরাধ প্রমাণ করার। কেউ অভিযোগ করলেই পুলিশ গিয়ে সন্দেহের বশে একজনকে গ্রেফতার করবে এবং সেই বন্দিকে সাক্ষী-সাবুদ এনে কোর্টে তার সপক্ষে প্রমাণ দিতে হবে।
দুই ধর্মের পাত্রপাত্রীর মধ্যে বিয়ে হলে জোর করে বা লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তরণের অভিযোগ ‘অফিসিয়ালি’ পাত্রপাত্রীর বাবা-মা, দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন আনতে পারে। বাস্তবে এই অভিযোগ পাড়ার বা গাঁয়ের লোকজন অথবা হিন্দু যুব বাহিনী বা যে কেউ করতে পারে। এই আইনে যার ধর্মান্তরণ হয়েছে (পাত্র বা পাত্রী) তার কথা বা তার মতামতকে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তার বক্তব্য নিয়ে এই আইনে একটি শব্দও বলা হয়নি। কেন? বুঝতে হলে এই আইনের আগের দু’টো কেস দেখুন।
1. ‘লাভ জিহাদ’ বলে বিখ্যাত কেরালার হাদিয়া কেস:
6 জানুয়ারি 2016। হোমিওপ্যাথির ছাত্রী অখিলা অশোকন কলেজ থেকে নিখোঁজ। কেরালার বাইকম নিবাসী কেএম অশোকন প্রথমে পুলিশে অভিযোগ, তারপর হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাসের রিট পিটিশন দাখিল করলেন যে, তাঁর 24 বছর বয়সী মেয়েকে পুলিশ খুঁজে দিক। পুলিশ তাকে হাইকোর্টে পেশ করলে মেয়েটি জানায়, সে এখন হাদিয়া জেহান, স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে। বিয়ে করেছে শফিন জেহান বলে এক মুসলিম যুবককে। ঘর ছেড়েছিল বাবার প্রতারণায়। বাবা তাকে তার পছন্দের ধর্ম, ইসলাম অনুযায়ী আচরণ করতে দিচ্ছেন না।
ওর পরিবারের বক্তব্য, মেয়েটার ‘ব্রেন ওয়াশ’ করে একরকম জোর করে মুসলিম যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েটি এসব অস্বীকার করে বলে সে স্বেচ্ছায় জেনবুঝে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে এবং শফিনকে বিয়ে করেছে।
মে 2017। ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (NIA)-র সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা একটি রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে কেরালা হাইকোর্ট হাদিয়া বা অখিলার বিয়ে খারিজ করে জানায় যে, অখিলা ধর্মীয় প্রচার এবং ‘মনস্তাত্ত্বিক কিডন্যাপিং’-এর শিকার। তারপর হাইকোর্ট অখিলাকে তার বাবা মায়ের হাতে এই বলে সঁপে দেয় যে, ভারতীয় ট্র্যাডিশন অনুযায়ী ঠিকমতো বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত কুমারী মেয়েকে রক্ষার দায়িত্ব তার বাবা-মা’র।
শফিন জেহান এই ফয়সালার বিরুদ্ধে নভেম্বর 2017-তে সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করে। সুপ্রিম কোর্ট প্রথমে প্রাপ্তবয়স্ক হাদিয়াকে ওর কলেজে ফিরে গিয়ে পড়াশোনা শুরু করতে বলে এবং জানিয়ে দেয় যে, ও স্বাধীন, এবং ইচ্ছেমতো যার সঙ্গে চায় দেখা করতে পারে। 2018 সালে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় বাতিল করে হাদিয়া ও শফিনের বিয়েকে আইনসম্মত এবং বৈধ বিয়ে বলে রায় দেয়।
সুপ্রিম কোর্টের মতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে কার সঙ্গে মিশবে, কাকে বিয়ে করবে এবং কোন ধর্মপালন করবে– সেটা তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। বাবা-মা বা রাষ্ট্র এর মধ্যে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
2. উত্তর প্রদেশের ‘এটা’ জেলার কেসটি:
গত সেপ্টেম্বরে এটা জেলার ‘দেহাতী’ থানা সলমান ওরফে করণের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা 366 অনুযায়ী একটি এফআইআর রিপোর্ট নেয়। অভিযোগ ওই মুসলিম যুবকটি শিখা নামের হিন্দু যুবতীকে ‘অপহরণ’ করে জোর করে বিয়ে করেছে। তারপর 7 ডিসেম্বর এটা’র চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিখাকে মহিলা হোমে পাঠানোর আদেশ দেন। হোম শিখাকে তার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। গত 18 ডিসেম্বরে শিখাকে আদালতে হাজির করতে এলাহাবাদ হাইকোর্টে একটি হেবিয়াস কর্পাস রিট (ব্যক্তিকে সশরীরে আদালতে পেশ করা) দাখিল করা হয়। আদালতে শিখা জানায়, সে নিজের ইচ্ছায় সলমানকে বিয়ে করেছে এবং কোনও জোর-জবরদস্তির গল্প নেই। আদালত স্কুল পাশের সার্টিফিকেট দেখে সন্তুষ্ট হন যে, শিখা পূর্ণবয়স্ক এবং দুই বিচারপতির বেঞ্চ রায় দেয় যে, ম্যাজিস্ট্রেটের এবং মহিলা হোমের কাজগুলো আইনসম্মত নয়। শিখার অধিকার রয়েছে নিজের ইচ্ছেমতো যে কোনও ধর্মের লোককে বিয়ে করার।
নারীর ইচ্ছার মূল্যই নেই, মনুর যুগে ফিরে যাওয়া:
সম্ভবত খেয়াল করেছেন যে, ওপরের দু’টো কেসেই (আরও অনেক কেসে) বাবা-মা ও পুলিশের গল্প বিফলে যাচ্ছে মেয়েগুলির বক্তব্যে। তাই যোগী আদিত্যনাথের আইনটিতে যার বিয়ে বা যার ধর্ম পরিবর্তন হচ্ছে, সেই মেয়েটির কথা শোনার বা তার স্টেটমেন্ট নেওয়ার কোনও ব্যবস্থাই নেই। মেয়েটি কাকে জীবনসঙ্গী করবে, সেটা ঠিক করবেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, যিনি একজন সরকারি আমলা। আর আমলা এবং পুলিশ যে হরদম সরকারের ইচ্ছায় চালিত হয়, এটা ভারতের সব রাজ্যেই সত্যি। এ প্রসঙ্গে কলকাতায় প্রায় 12 বছর আগের রিজওয়ানুর এবং প্রিয়ঙ্কা তোদি পরিবারের মমর্ন্তুদ ঘটনা অনেকেরই মনে পড়বে।
খামোকাই রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ করেছিলেন-
‘নারীকে আপনভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার
হে বিধাতা!’
আমরা এখন রবীন্দ্রনাথকে তাকে তুলে রেখে মনুসংহিতার ধুলো ঝেড়ে টেবিলে নামিয়ে এনেছি। মনু বলছেন-
স্ত্রীলোক বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। স্ত্রীজাতির স্বাধীনতা নেই। (5/148) এবং ‘ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি’ (9/3)।
গৃহে বালিকা, যুবতী ও বৃদ্ধা নারী স্বাধীনভাবে কিছু করবেন না। (5/147)।
পতি দুশ্চরিত্র, কামুক এবং গুণহীন হলেও সাধ্বী স্ত্রী কর্তৃক দেবতার ন্যায় সেব্য। (5/154)।
রবীন্দ্রনাথ ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে মৃণালের মুখ দিয়ে সতী অনসূয়ার কুষ্ঠরোগী স্বামীর ‘ইচ্ছেপূরণ’ করতে ওকে পিঠে করে পতিতালয়ে পৌঁছে দেওয়ার কাহিনিটিকে তুলোধোনা করেছিলেন।
‘লাভ জিহাদ’ বলে আদৌ কিছু আছে কি?
প্রায় 100 বছর আগে উইমেন প্রোটেকশন লিগ বা নারী সুরক্ষা সমিতি বলে একটি সংস্থা এই ধুয়ো তুলেছিল যে, মুসলমান ‘গুন্ডা’র দল সমানে হিন্দু মেয়েদের অপহরণ করে, জোর করে তাদের বিয়ে করছে। এই প্রচারে কিছু অপহরণের বিক্ষিপ্ত ঘটনার সঙ্গে দু’পক্ষের সম্মতিতে হওয়া বিয়ের ঘটনাগুলোকে গুলিয়ে দেওয়া হয়, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েটির বক্তব্য অভিযোগের বিরুদ্ধে যায়। এতে দাঙ্গা হয়নি ঠিকই, কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি নষ্ট হয়ে তিক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
গত 4 ফেব্রুয়ারি, 2020-তে সংসদে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জি কিষেন রেড্ডি একটি প্রশ্নের উত্তরে জানান যে, দেশের কোনও আইনে ‘লাভ জিহাদ’ বলে কিছু বলা নেই। এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে সংগঠিত লাভ জিহাদ চক্রান্তের কোনও তথ্য নেই বা এমন কোনও ঘটনার খবর নেই।2
মজার ব্যাপার হল, যোগী আদিত্যনাথ নিজে উত্তরপ্রদেশে ‘লাভ জিহাদ’ চক্রান্তের পর্দাফাঁস করতে গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম (SIT) গঠন করেছিলেন। তারা 14টি এই ধরনের কেসের তদন্ত করে রিপোর্ট দেয় যে, কোনও কেসেই আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বা হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করা মুসলিম যুবকেরা বিদেশ থেকে টাকা পেয়েছে, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।3
তাহলে? দুই ধর্মের ছেলেমেয়েরা যদি ধর্মীয় আইনে বিয়ে না করে স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট বা চালু শব্দে ‘সিভিল ম্যারেজ’ করে? ওতে তো পাত্র-পাত্রীর ধর্ম নিয়ে কোনও ধারা-উপধারা নেই। ঠিক কথা, কিন্তু বাস্তবে সম্ভব নয়। কারণ, এই আইনে একমাস আগে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে নোটিশ দিতে হয়। এবং সেই নোটিশ অফিসের নোটিশ বোর্ডে টাঙানো হয়। আর সেটা পড়ে যে কোনও লোক, স্থানীয় বা সাধারণ জনতা এতে আপত্তি পেশ করতে পারে যে, আবেদনকারী পাত্রপাত্রী যে তথ্য দিয়েছে, তাতে গলদ রয়েছে। ব্যস, সেই উগ্র, ধর্মান্ধ যুব বাহিনীর নাক গলানোর রাস্তা পরিষ্কার।
নন্দিনী প্রবীণ বলে কেরালার একজন আইনের ছাত্র সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন করেছে যে, স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্টের আবেদনকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সাধারণের গোচরে রাখার ধারাটি নাগরিকের প্রাইভেসির পরিপন্থী, কাজেই তা খারিজ করা হোক। তার বক্তব্য, ম্যারেজ রেজিস্ট্রার তথ্যগুলো ‘ভেরিফাই’ করুন, কিন্তু সাধারণ মানুষ কেন করবে? সুপ্রিম কোর্ট এটি বিবেচনা করে দেখছে।4
ভারত সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে কাজ করা 104 জন প্রাক্তন আইএএস অফিসার এবং আমলা যোগী আদিত্যনাথের কাছে খোলা চিঠি লিখে এই লাভ জেহাদ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন শিবশঙ্কর মেনন, বজাহত হবিবুল্লা, টিকেএস নায়ার, সুজাতা রাও, দুলাতের মতো পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের অভিজ্ঞরা।5
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মদন লোকুর বলছেন, এই আইন সংবিধানের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার অধিকারের বিরোধী। কাজেই এটি ধোপে টিকবে না।
সুপ্রিম কোর্ট এই লাভ জেহাদ এবং ধর্ম পরিবর্তন আইনের সাংবিধানিকতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করা পিটিশনগুলো শুনতে রাজি হয়ে উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখন্ড সরকারকে নোটিশ পাঠিয়েছে।6 সেসব একমাস পরের কথা। আসুন, আপাতত আমরা এই আইনের প্রথম বলির গল্পটি শুনি।
নতুন আইনে প্রথম গ্রেফতার:
অর্ডিন্যান্স পাশ হওয়ার 24 ঘন্টার মধ্যে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ অ্যাকশনে নেমে পড়ে। এই আইনে প্রথম অভিযুক্ত হয় বরেলি শহরের 21 বছরের মুসলিম যুবক উবেইশ আহমদ।7
নভেম্বর মাসের 28 তারিখে দেওরানিয়া থানার পুলিশ তাকে শরিফনগর নিবাসী টিকারাম রাঠোরের অভিযোগে উত্তর এই আইনের 3 ও 5 নং ধারায় গ্রেফতার করে। বলা হয় যে, সে এক বিবাহিত হিন্দু মেয়েকে, যে তার সঙ্গে ছোটবেলায় স্কুলে পড়ত— তাকে ধর্ম বদলে বিয়ে করার জন্যে চাপ দিচ্ছে।
এখানে অভিযোগকারী মেয়েটিরর বাবা টিকারাম, স্বামী বা শ্বশুর নয়। অভিযোগকারী আরও বলে যে, উবেইশ আহমদকে অনেক বোঝালেও সে মানছে না। সে নাকি অভিযোগকারীদের ধমকাচ্ছে, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
আহমদ জানায় যে সে নির্দোষ। মেয়েটির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল বটে, কিন্তু কিছুদিন আগে একটা ঘটনা ঘটে। অক্টোবর 2019-এ মেয়েটি বাড়িতে না জানিয়ে কোথাও চলে যায়। মেয়ের বাবা টিকারাম তখন উবেইশ তার মেয়েকে অপহরণ করেছে বলে এফআইআর দায়ের করে। কিন্তু, উবেইশ তখন একই গ্রামে নিজের বাড়িতেই ছিল। পুলিশ মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনলে সে জানায় যে, সে নিজের ইচ্ছায়, ব্যক্তিগত কারণে ঘর ছেড়েছিল। তারপর 2020 সালের মে মাসে মেয়েটির অন্য গ্রামে বিয়ে হয়ে যায়। উবেইশ জানায় যে, ওই আদালতের ঘটনার পর ওদের দুজনের ভাব-ভালবাসা সব চুকেবুকে গেছে। উবেইশ বিএসসি বায়োলজির পড়া ছেড়ে দিল্লি এসে একটা ছোটখাটো চাকরি করতে থাকে। ওর কথা– মেয়েটির কোন গ্রামে বিয়ে হয়েছে তাও জানা নেই। ওকে যখন গ্রেফতার করে তখন ও ভগ্নিপতির বাড়িতে ছিল। মেয়েটির ভাই উবেইশের বক্তব্যকে সমর্থন করে।
তার কথা হল- মেয়ে বা ওর স্বামী কারও অভিযোগ নেই। ও গাঁয়ে ফেরেনি, তাহলে কীভাবে মেয়ের বাবাকে ধমকাবে, ঝগড়া করবে? একটা গাঁয়ের লোক বলুক, এমন কিছু হয়েছে।
মেয়ের ভাই বলে যে, একটা ঘটনা গত বছর হয়েছিল বটে, সে তো আদালতে মিটমাট হয়ে গিয়েছিল।
কোর্টে কোনও প্রমাণের অভাবে ও তিন সপ্তাহ পরে জামিনে ছাড়া পেয়েছে। কিন্তু ওর আফশোস, একবার ক্রিমিনাল কেসে জেলে ঢুকেছে— কোনও সরকারি চাকরি বা মিলিটারিতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন জীবনের মতো অধরা রয়ে গেল।
তার প্রশ্ন, কেন আমাকে মিথ্যে মামলায় গ্রেফতার করল, বদনাম করল— শুধু আমি মুসলিম বলে?
এর উত্তর আমাদের জানা নেই। আমরা আপাতত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতীক্ষায়।
তথ্যসূত্র:
----------------------------------------
1 ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 29 ডিসেম্বর, 2020
2 ইন্ডিয়া টুডে, 18 নভেম্বর, 2020
3 ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 24 নভেম্বর, 2020
4 ইন্ডিয়া লীগাল, 25 সেপ্টেম্বর, 2020
5 ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 30 ডিসেম্বর, 2020
6 ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 7 জানুয়ারি, 2020
7 দি হিন্দু, 28 ডিসেম্বর, 2020